বেড়ানো: অ্যারিজোনা হট স্প্রিং

হট স্প্রিং। ছবি: লেখিকা
হট স্প্রিং। ছবি: লেখিকা

বাঙালিদের নিয়ে একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে অনেক দিন ধরে। বাঙালিরা নাকি ‘ঘরকুনো’। আর এই বিশেষ ট্যাগ বাঙালিদের দিয়েছিল ব্রিটিশরা।

সে যাইহোক। বাঙালিরা ঘরকুনো, সেই দিন কি আর আছে? দিন বদলেছে না? ঘরকুনো প্রবাদ ঘুচিয়ে প্রয়োজনের তাগিদে বাঙালিরা এখন পাড়ি জমাচ্ছে হাজার হাজার মাইল দূরে। নিজ পরিমণ্ডল থেকে বাইরে বেরিয়ে পৃথিবীটা দেখতে সবারই ভালো লাগে। শুধু চাই ইচ্ছা, টাকা ও অবসর সময়।

ভ্রমণ পছন্দ না এমন মানুষ পাওয়া এখন দুষ্কর। ভ্রমণ যাদের স্বপ্ন, তাদের জন্য আমেরিকা ও ইউরোপ খুবই উপাদেয়। অনেক কারণের মধ্যে অন্যতম হলো খুবই কম সময়ে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়ার ব্যাপারটা। বইসি স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে ট্রান্সফার হয়ে ইউনিভার্সিটি অব নেভাদা-লাসভেগাস এসেছি মাত্র দুই সপ্তাহ হয়েছে।

সেমিস্টার মোটে শুরু হয়েছে তখন। এর মধ্যেই একদিন ঠিক হলো শনিবার সবাই মিলে হাইকিংয়ে যাব অ্যারিজোনা হট স্প্রিংসে। এটাকে রিংবোল্ট হট স্প্রিংসও বলা হয়। হুভার বাঁধ তৈরির আগে কলোরাডো নদীর ওপর রিংবোল্ট রাপিডস নামে বড় বড় র‍্যাপিড ছিল। শিলাটিতে অনেক রিংবোল্ট রয়েছে, যেখানে স্টিমবোটগুলো তাদের কেপগুলো র‌্যাপিডগুলোর ওপরে টানতে সংযুক্ত করা হয়।

হট স্প্রিং। ছবি: লেখিকা
হট স্প্রিং। ছবি: লেখিকা

নেভাদা স্টেট থেকে অ্যারিজোনা স্টেটের এই জায়গায় যেতে সময় লাগে মাত্র ৪০ মিনিট (ঘণ্টায় ৩৮ মাইল বা ৬১ কিলোমিটার)। ঠিক হলো আমরা রওনা দেব সকাল আটটায়। যেহেতু আমরা হাইক করব, তাই সঙ্গে নিতে হলো পানি আর কিছু হালকা খাবার।

অ্যারিজোনা হট স্প্রিংসে যাওয়ার তিনটি উপায় রয়েছে। প্রথমটি হলো হাইওয়ে ৯৩ ধরে হোয়াইট রক ক্যানিয়ন ট্রেলহেড থেকে আনুমানিক তিন মাইল দূরে যাত্রা করা। দ্বিতীয়টি হুভার বাঁধ থেকে চার মাইল দূরে ভাসমান। এর জন্য পারমিট ও ফি প্রয়োজন। তৃতীয় বিকল্পটি হলো উইলো বিচ থেকে আট মাইল আপ্রিভার প্যাডেল করা, যার জন্য যানবাহনপ্রতি প্রবেশ ফি ১০ ডলার প্রয়োজন।

ট্রেলটি মূলত ১৯৬০-এর দশকে তৈরি। কিন্তু এটি ১৯৯৩ সালে পুনরায় সাজানো হয়। এখানে হাইক করতে সময় লাগে দুই থেকে চার ঘণ্টা। সময়টা নির্ভর করে আপনি কত দ্রুত হাঁটছেন। কতক্ষণ রেস্ট নিচ্ছেন এবং কত সময় ধরে হট স্প্রিং উপভোগ করছেন, তার ওপর।

জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এটি প্রচণ্ড গরমের জন্য বন্ধ থাকে।

হট স্প্রিং। ছবি: লেখিকা
হট স্প্রিং। ছবি: লেখিকা

হাইকের সব রাস্তাই ছিল নুড়িপাথর দিয়ে ভর্তি। মূল ট্রেলটি হোয়াইট রক ক্যানিয়নকে অনুসরণ করে। প্রথমে পাথর এবং কিছু বালুর ওপর দিয়ে যেতে হয়।

একটি বিশেষ ব্যাপার হলো ট্রেলটি বিশেষ কোনো লুপ নয়। হট স্প্রিংটি দুটি ট্রেলের মাঝখানে। সুতরাং হট স্প্রিংয়ে দুই দিক দিয়েই যাওয়া যায়। হাইকের ট্রেলটি পার করে পেলাম কলোরাডো নদীর অপরূপ দৃশ্য। তারপর হট স্প্রিং।

হাইক করতে করতে আপনি কলোরাডো নদীর নিচে হেঁটে যেতে পারবেন এবং জায়গাটি খুবই মনোরম। আপনি এখানে মাঝেমধ্যেই থামবেন এবং দর্শনগুলো দুর্দান্ত হওয়ায় নদীর দিকে ফিরে তাকাবেনই। এটি সত্যিই একটি অনন্য ও স্মরণীয় অভিজ্ঞতা।

ছোটবেলায় আমরা ভিউকার্ড ও অপূর্ব সুন্দর দৃশ্যের ছবি আছে, এমন খাতা কিনতাম। সেসব অসাধারণ দৃশ্য এখন চোখের সামনে। কিছু লোক এখানে পিকনিক, নদী দেখতে, এমনকি সাঁতার কাটতে থামে। আমরাও ৩ দশমিক ২ মাইল হাইক করে এখানে কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম নিয়ে, হালকা নাশতা করে আবার রওনা দিলাম হট স্প্রিংয়ের দিকে।

হট স্প্রিং। ছবি: লেখিকা
হট স্প্রিং। ছবি: লেখিকা

হট স্প্রিংয়ে ওঠার জন্য একটি সিঁড়ি আছে। ২০ ফুটের সিঁড়ি দিয়ে ওঠার পরে যে পুল পড়ে, সেখানকার পানি থেকে তার পরের পুলের পানিগুলো বেশি উষ্ণ থাকে। পুলটিতে বাঁধ দেওয়ার জন্য দর্শনার্থীরা বালুর ব্যাগ ব্যবহার করেন।

মনে রাখতে হবে, হট স্প্রিংয়ের পানি যেন নাকে বা মুখে না যায়। কারণ, পানিতে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া থাকে।

মই দিয়ে ওঠার পর যে পুল পড়ে, সেখানকার পানি থেকে তার পরের পুলের পানিগুলো বেশি উষ্ণ থাকে। এখানকার পানি গড়ে প্রায় ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস হয়। তবে হট স্প্রিংয়ের উৎসটি বর্তমানে অজানা। হট স্প্রিংয়ের পানি যদিও ইনিশিয়ালি খুব গরম অনুভূত হয়, কিন্তু পরে এটাই আরামদায়ক লাগে।

হট স্প্রিংয়ে লেখিকা ও তাঁর সঙ্গীরা
হট স্প্রিংয়ে লেখিকা ও তাঁর সঙ্গীরা

বেশ কিছুক্ষণ পুলটিতে উষ্ণ পানির ছোঁয়া নিয়ে আমরা ফিরে এলাম। সারা দিন অবিরাম হাঁটাহাঁটি আর চোখের অনিঃশেষ খোরাকের পর আমরা তখন ক্লান্ত আর অভিভূত। তারপরও বলতে ইচ্ছা করে, ‘প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে/ মোরে আরো আরো আরো দাও প্রাণ’।

সৃষ্টির আনন্দে তৃপ্তি আসেনি এমন কখনো কারও হয়েছে কি না, বলা মুশকিল। আরও বেশি মুশকিল, সেই আনন্দ কাছের বন্ধুদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে স্বস্তি আর সার্থকতা পায়নি, এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া। তাই এই ভ্রমণকাহিনি লিখতে বসা। জীবনের বহু কিছু সময়ের ফেরে মহাতলে হারিয়ে গেলেও কিছু কিছু ব্যাপার চিরকালের জন্য হৃদয়ে গেঁথে রয়। এই ট্রিপে পেলাম স্মরণীয় কিছু মুহূর্ত, দেখলাম অপূর্ব কিছু জায়গা এবং সময় কাটালাম অসাধারণ কিছু মানুষের সঙ্গে।