বেড়ানো: আল্পবাখের বাঁকে

আল্পবাখ। ছবি: লেখিকা
আল্পবাখ। ছবি: লেখিকা

হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বাস ধরলাম। সোনালি মোচওয়ালা ড্রাইভার ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে। ‘এই বাদামি ছেলে-মেয়েগুলোর কোনো সময়জ্ঞান নেই, ধুর!’ তার মনের ভাব কপালের ভাঁজে অতি স্পষ্ট।

অথচ সকাল আটটা বাজতে আরও মিনিট পাঁচেক বাকি। ঘড়িবিহীন কবজিটা কায়দা করে তাই যেন বোঝাতে চাইলাম। অনিচ্ছায় হার মেনে ভদ্রলোক মোচে একটা তিন শ ষাট ডিগ্রি মোচড় মেরে আমার ছোট লাল স্যুটকেসটা বাসের পেটে ঢুকিয়ে দিল।

বিরক্তিটা আরও চাগিয়ে দিয়ে বললাম, ‘আমি কি এক ছুটে গিয়ে অফিস থেকে জরুরি একটা জিনিস নিয়ে আসতে পারি?’ কয়েক গজ দূরের প্যাথলজি ভবনটা দেখে সে এক সেকেন্ড কী ভেবে সায় দিয়ে দিল। আমিও পড়িমরি করে ছুট।

কপাল ভালো, হিঁচড়েপাচড়ে সিঁড়ি ভাঙতে হলো না। কলিগ পেত্রাকে জানালায় দেখে আকার-ইঙ্গিতে বোঝাতেই সে অফিসে রাখা পেনড্রাইভটা এনে ছুড়ে দিল। আনাড়ি হাতে লুফে নিতে ব্যর্থ হয়ে কুড়িয়ে তুলে ভোঁ-দৌড়ে বাসের কাছে ফিরে এলাম।

আটটা তখনো বেজে সারেনি। যদিও বাস ড্রাইভার সত্যিকারের এক লেট লতিফের অপেক্ষায় দাঁত কিড়মিড়াচ্ছে।

মিউনিখ থেকে অস্ট্রিয়া। অস্ট্রিয়ার আল্পবাখ বলে এক পাহাড়ি গন্তব্যে যাচ্ছি সবাই। সবাই বলতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যানসার রিসার্চ কনসোর্টিয়ামের লোকজন। আল্পবাখে আমাদের বার্ষিক সম্মেলন। সেখানে যে যার গবেষণার খতিয়ান দেবে আরকি।

এই খতিয়ান তৈরিতে টানা দুই সপ্তাহ দারুণ খাটাখাটুনি গেছে। শেষ মুহূর্তে আরও কিছু যোগ করতে হতে পারে ভেবে পেনড্রাইভটা নেওয়া। তবে সামনের কটা দিন কনফারেন্সের ফাঁকে প্রচুর খেয়ে-দেয়ে এই খাটুনি সুদে-আসলে পুষিয়ে নেব। আপাতত এটাই ফন্দি।

জার্মান নিয়মানুবর্তিতাকে কাঁচকলা দেখিয়ে আটটার বাস সোয়া আটটায় আস্তে-ধীরে ছাড়া হলো। কোনো লতিফ আদৌ বাদ গেছে কি না কে জানে। তোয়াক্কা না করে জোড়া আসন দখলে নিয়ে আরাম-আয়েশে ব্যস্ত হয়ে গেলাম।

দুই

জানুয়ারির শেষ প্রায়। মিউনিখ এখনো তুষারশূন্য। অবশ্য শহর ছাড়িয়ে আধা ঘণ্টার মাথায় জানালার বাইরেটা তুষারশুভ্র হয়ে গেল। তার মানে আল্পবাখ হতাশ করবে না। ইচ্ছেমতো বরফে হুটোপুটি করা যাবে। অনুকাব্যের আদলে বেশ কয়েকটা অনুঘুম ঘুমিয়ে সময়টা ফুস করে উড়ে গেল। খালি রাস্তা পেয়ে দুই ঘণ্টার পথ অনায়াসে দেড় ঘণ্টায় পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম তুষার রাজ্য আল্পবাখ।

বাস থেকে নেমেই বরফে হোঁচট খেয়ে বুঝলাম, কেন ডরোথি সঙ্গে করে ভালো জাতের হাইকিং শু আনতে বলেছিল। ডরোথি আমাদের রিসার্চ কনসোর্টিয়ামের কো-অর্ডিনেটর। জুতা সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ—সব কাজে সে এক নম্বর। এই সম্মেলনের সমস্ত বন্দোবস্ত সে করেছে। তার প্ল্যান মোতাবেক একদিন আমাদের হাইকিংয়ে নেওয়া হবে। আরেক দিন নিয়ে যাওয়া হবে স্নো-শু হাইকিংয়ে।

এমন চৌদ্দ পদের হাইকিং দিয়ে কী হবে, সেটা আমার মাথায় ঠিক খেলছে না। কলিগদের কাছে বুদ্ধি-শুদ্ধি নিয়ে বনেদি জার্মান ব্র্যান্ড জ্যাক উলফিস্কনের দামি এক জোড়া হাইকিং শু কিনে এনেছি। এখন জুতা তার কোম্পানির মান রাখে কি না দেখার বিষয়।

সময়ের আগে আল্পবাখ চলে এসেছি। কনফারেন্স হলের বাইরে সবাই যে যার মতো উসখুস বেকার ঘুরছে। পর্দার আড়ালে চা-কফি সাজানো ছিল চা-বিরতির জন্য। এতগুলো লোকের হট্টগোল সামাল দিতে সেগুলোকে আগেই সামনে আনা হলো। আমরাও হামলে পড়ে চোঁ চোঁ করে কফি টানতে থাকলাম।

পরিপাটি বেশভূষার ওয়েটার মুচকি হাসছে। বুঝে গিয়েছে যে মিউনিখ থেকে এক দঙ্গল হাভাতে বিজ্ঞানী এসেছে। এরা যা পাবে, তাই খেয়ে ফেলবে।

তিন.

কথা জমাতে না পারা মুখচোরা স্বভাবের আমি কফি হাতে এক টেবিলের চারপাশে উপগ্রহের মতো ঘুরপাক খাচ্ছি। জনাদুয়েককে চিনি। একজনের সঙ্গে একটা প্রজেক্টও চলছে। কিন্তু অস্বস্তির খোলসটা খুলে এগিয়ে গিয়ে একটা ‘হ্যালো’ বলতে পর্যন্ত পারলাম না। এই অসুখের দাওয়াই কী, জানা নেই। এই স্বভাব নিয়ে কবি-সাহিত্যিক হওয়া চলে, কিন্তু গবেষক-বিজ্ঞানী একেবারেই না। ঘরের চিপায় চুপকে বসে তাড়া তাড়া কাগজ লিখে ভরিয়ে ফেলার একটা বিনে বেতনের চাকরি করলে এভাবে টেবিলের চারপাশে ঘুরে গণসংযোগের ব্যর্থ চেষ্টা করতে হতো না।

কথাটা মনে হতেই মাথায় ষাট ওয়াটের বাতি জ্বলে উঠল। হাতের সময়টা কাজে লাগাতে নিরিবিলি এক কোণ খুঁজে ল্যাপটপ খুলে বসলাম। বইয়ের ফ্ল্যাপ লিখে শেষ করতে হবে।

টুকটাক ইতং বিতং লেখালেখির অভ্যাস আছে। এই কাছেপিঠে কোথাও ঘুরতে গেলাম। ফিরে এসে সপ্তাহান্তের অবসরে তাতেই রং চড়িয়ে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে লিখে ফেললাম কাঁচা হাতের ভ্রমণকাহিনি। যেটা আদতে ভ্রমণকাহিনির ‘ভ’ও হয় না। কদিন আগে কী ভূত চেপেছিল, এক শুভাকাঙ্ক্ষীর জবরদস্তিতে পড়ে তেমনি কতগুলো লেখার সঙ্গে আরও কিছু নড়বড়ে গল্প জুড়ে একটা পাণ্ডুলিপি পাঠিয়েছিলাম এক প্রকাশক বরাবর।

ঝড়ে যে টুপ করে বক মরে যাবে, ভাবিনি। প্রকাশক অতি দ্রুত বইয়ের ফ্ল্যাপ লিখে পাঠাতে বলেছেন। বইমেলায় বই আসবে। বইয়ের একটা জুতসই নামও পাঠাতে বলছেন। শতভাগ হতবাক আমি কথাটা বন্ধু কী পরিবার—কাউকেই বলতে পারছি না। সবাই পেট চেপে হা হা করে হাসবে। গাঁটের পয়সা খরচ নেই, কিচ্ছু নেই, এত সহজে নবিশ লোকের বই ছাপা হয়—এমন তো ইদানীং শুনিনি।

যা হোক, ঘাড়ের রগ ফুলিয়ে হাতে থাকা বিশ মিনিটের ভেতর ফ্ল্যাপ লেখার কাজ কিছুটা এগিয়ে আবার গা ঝাড়া দিয়ে ভোল পাল্টে বসলাম। লেখক সত্তাটাকে একরকম খ্যাঁক খ্যাঁক করে খেদিয়ে প্লাস পয়েন্ট টু ফাইভ পাওয়ারের রিডিং গ্লাসটা নাকে চাপিয়ে আবার বিজ্ঞানীর ভেক ধরলাম। এই শ-খানেক তাবড় তাবড় বাঘের পালের ভেতর আমি যে একটা বাঘডাসা, সেটা লুকাতে এই ভেকটুকুর দরকার হয় বৈকি।

আল্পবাখ। ছবি: লেখিকা
আল্পবাখ। ছবি: লেখিকা

গুরুগম্ভীর আলোচনা চলছে। অনেকগুলো প্রেজেন্টেশন। কোথায় যেন পড়েছিলাম, মানুষের মনোযোগের মাত্রা পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মতন। সকাল সাড়ে দশটায় শুরু হওয়া জ্ঞানগর্ভ আলোচনা বেলা দেড়টায় এসে মাথায় আর না ঢুকে শিস কেটে কানের পাশ ঘেঁষে বেরিয়ে যাওয়া শুরু করেছে। ক্যানসারের ওপর দীর্ঘ আলাপ শুনে নিজেরও কেমন অসুখ অসুখ লাগছে।

পাশে বসা পিএইচডি স্টুডেন্ট মেয়েটা নিরুপায় বড় বড় হাই তুলছে। আর আমার পেয়েছে খিদে। সম্মেলন শুরুর আগে হামলে পড়ে চা-কফি মেরে দিয়েছিলাম বলে চা-পর্বের পাট চুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। দুইটার দিকে নাকি একবারে লাইট লাঞ্চ হয়ে যাবে।

দুইটার দিকে টেবিল লাগানো হলো। আমরা তড়াক করে লাফিয়ে চলে এলাম ধোঁয়া ওঠা খাবারগুলোর কাছে। প্লেট কে প্লেট লাইট লাঞ্চ গলা দিয়ে নামিয়ে হেভি হয়ে যেতে সময় লাগল না।

খানিক বাদে তৃপ্তি নিয়ে সন্তুষ্ট চিত্তে ফিরে যাচ্ছি। কে যেন পিছু ডাকল, ঘুরে তাকালাম। ‘হাই, আমি দীপ্তি, দীপ্তি আগরওয়াল।’ তার পাশ থেকে আরেকজন বলে উঠল, ‘আর আমি মণিকা’। তাদের আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে আসা দেখে ইতস্তত করলাম। অনেক জোর করে জড়তা কাটিয়ে ফিরতি জবাব দিলাম, ‘হ্যালো, আমি সাবরিনা। পোস্টডক। ডক্টর কাতিয়া ষ্টাইগারের ল্যাবে আছি’।

তাদের সঙ্গে বাতচিত যা হলো, তার বিষয়বস্তু আজকে রাতের হাইকিং। পাহাড় চূড়ায় রেস্তোরাঁ আছে। সেখানে আজকের ডিনারের আয়োজন। মেয়ে দুটি একটু ধন্দে আছে, এক হাঁটু তুষার ঠেঙিয়ে ঘোর অন্ধকার পথে ঘণ্টাখানেক হেঁটে যাওয়া তাদের ভারতীয় জানে কুলাবে কি না। তাই এই বঙ্গসন্তানকে পেয়ে তারা দল ভারী করতে চায়। জার্মান আর বাকি ইউরোপীয়গুলো তো বরফ ডিঙিয়ে খরগোশের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে এগিয়ে যাবে। পিছিয়ে পড়া দু-একটা কচ্ছপের দিকে যে ফিরেও তাকাবে না—এ তো চোখ বুজে বলে দেওয়া যায়।

নাম মনে না থাকার রোগ আছে। দীপ্তি আর মণিকা—নাম দুটি তাই ইস্ট নামের মতো জপতে জপতে লেকচার হলে বসলাম। একটানা সন্ধ্যা পর্যন্ত চলা ম্যারাথন কয়েকটা সেশন শেষ হওয়ার পর দুজনকে খুঁজে নিয়ে হাসিমুখে বললাম, ‘হাই দীপা, হাই মারিয়া’। দুজনই মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে দেখে চলে গেল ওদের গলায় ঝোলানো আইডি কার্ডে। চট করে নাম শুধরে নিয়ে বললাম, ‘কী দীপ্তি, প্ল্যান ঠিক আছে তো? হোটেলে চেক-ইন করে ঠিক আটটায় দেখা হচ্ছে তাহলে, মণিকা’। আধা ঘণ্টার একটা সংক্ষিপ্ত বিদায় নিয়ে কাতিয়ার গাড়িতে চেপে বসলাম। তাকে আর আমাকে একই হোটেল দেওয়া হয়েছে।

কাঠের দোতলা মচমচিয়ে ভাঙতে গিয়ে নাকে চন্দনের চমৎকার ঘ্রাণ ভেসে এল। এই শীতের রাজ্যে চন্দন এল কোত্থেকে। কাউকে যে জিজ্ঞেস করব, তার উপায় নেই। এক অতি বয়স্কা বৃদ্ধা একলা থাকেন নিচতলায়। তাকে ঘাঁটানো বারণ। দোতলার বাড়তি ঘর দুটি ভাড়া দেওয়া হয় আল্পবাখে স্কি করতে আসা পর্যটকের কাছে। তাদের দেখভালের জন্য দিনে একবার কেয়ারটেকার আসে। আশপাশের হোটেলগুলোও নাকি এমনই। লোকজন নিজের ঘর ভাড়া দিয়ে রেখেছে। স্থানীয়দের অনেকেরই নাকি এই ব্যবসা। ব্যাপারটা খারাপ লাগল না। ঘরোয়া ভাব আছে। চন্দনের উদাসী ঘ্রাণটা টেনে নিয়ে ঘরের চাবি ঘোরালাম।

হাতে সময় কম। তবু ছোট্ট বারান্দাটা কী সম্মোহনে ডেকে নিয়ে গেল। হালকা ঝিরি ঝিরি তুষারে কাঠের মেঝে ঢেকে গিয়েছে। তাতে খালি পায়ের ছাপ এঁকে চারপাশটা অবাক চোখে দেখছি। মেঘে ঢাকা আকাশে সন্ধ্যাতারা নামেনি। তার বদলে পেঁজা তুলোর মতো ঝরছে অযুত তুষার কণা। আকাশ থেকে তারাদের দল আলতো হয়ে খসে পড়ে পড়লে বোধ হয় এমনই দেখাত। আঁধারের বদলে নীলাভ আলোয় ছেয়ে গেছে সন্ধ্যাটা।

বিমূঢ় দাঁড়িয়ে কতক্ষণ কেটে যেত বলা মুশকিল। মুঠোফোনটা একবার বেজে উঠে ঘোর কাটিয়ে দিল। দীপ্তি, মণিকারা বেরোচ্ছে। সাধের হাইকিং শু পায়ে গলিয়ে আমিও কাতিয়ার সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম। কাতিয়া চুপচাপ স্বভাবের। আর আমি চুপচাপের বাপ। সুতরাং, নিঃশব্দে চলছি দুজন। পথের পাশে স্কিয়িংয়ের সরঞ্জামের দোকান। রাইফেলের দোকানও দেখছি সারি সারি। স্কি করতে এসে এত বন্দুকবাজির কী দরকার বুঝলাম না।

পাহাড়ি উঁচু ঢালু পথঘাট যেন ভুলভুলাইয়া। একই রকম তুষারস্নাত চেহারা সব অলিগলির। সাহস করে একাও বেরোনো যেত। নতুন শহরে নিজের সঙ্গে ঘুরে বেড়ানোর রোমাঞ্চ অন্য রকম। একটা ‘চলে মুসাফির’ ভাব আছে। তবে এই গুঁড়ি গুঁড়ি তুষারের আবছায়া সাঁঝে পথ হারিয়ে হাঙ্গামা হুজ্জত বাধানোর কী দরকার। আর আজকে হারালেও কেউ খুঁজতে আসবে না। পাহাড় চূড়ার রেস্তোরাঁয় পেটপূজার পর গ্লাস গ্লাস পাগলা পানি গিলে টাল হয়ে থাকা কেউ খেয়ালই করবে না তাদেরই একজন আল্পবাখের কোনো বাঁকে হারিয়ে গিয়ে খাবি খাচ্ছে। (বাকি অংশ পরবর্তী পর্বে)
---

ড. রিম সাবরিনা জাহান সরকার: গবেষক. ইনস্টিটিউট অব প্যাথলজি, স্কুল অব মেডিসিন, টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি মিউনিখ, জার্মানি।