পৃথিবী বদলে দেওয়া ১০ অগ্রগতি থেকে যা শেখার আছে

লেকচার কিংস কলেজের লেকচারের ২০২০ সালের বিষয় হচ্ছে ‘চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য বিপ্লব’। এ বছরের বক্তা অধ্যাপক স্যার রবার্ট লেচলার। চিকিৎসাশাস্ত্রের পৃথিবী বদলে দেওয়া সেরা ১০ আবিষ্কার থেকে যা শেখার আছে, তা নিয়ে আলোকপাত করা হয়েছে লেকচারে। ছবি: সংগৃহীত
লেকচার কিংস কলেজের লেকচারের ২০২০ সালের বিষয় হচ্ছে ‘চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য বিপ্লব’। এ বছরের বক্তা অধ্যাপক স্যার রবার্ট লেচলার। চিকিৎসাশাস্ত্রের পৃথিবী বদলে দেওয়া সেরা ১০ আবিষ্কার থেকে যা শেখার আছে, তা নিয়ে আলোকপাত করা হয়েছে লেকচারে। ছবি: সংগৃহীত

কয়েক বছর ধরেই কিংস কলেজ লন্ডন আয়োজন করে আসছে কিংস লেকচার সিরিজ। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে, কিংস কলেজ লন্ডনের প্রথিতযশা শিক্ষকদের কয়েক দশকের অর্জিত অভিজ্ঞতার আলোকে সমসাময়িক কোনো বিষয়ের চুলচেরা বিশ্লেষণ করে তা তিনটি লেকচারের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া।

কিংস কলেজের তিনটি ভিন্ন ক্যাম্পাসে স্বাস্থ্য নিয়ে লেকচারের আয়োজন করা হয়। যাতে লন্ডনের বিভিন্ন এলাকার মানুষ এতে অংশ নিতে পারে। ২০২০ সালের বিষয় হচ্ছে ‘চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য বিপ্লব’। এ বছরের বক্তা অধ্যাপক স্যার রবার্ট লেচলার। তিনি কিংস কলেজের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট/প্রভোস্ট (স্বাস্থ্য) এবং কিংস হেলথ পার্টনারস একাডেমিক হেলথ সায়েন্সেস সেন্টারের নির্বাহী পরিচালক। সিরিজের প্রথম লেকচারটি হয়ে গেল গত ২৭ ফেব্রুয়ারি। মূলত চিকিৎসাশাস্ত্রের পৃথিবী বদলে দেওয়া সেরা ১০ আবিষ্কার থেকে আমাদের যা শেখার আছে, তা নিয়ে আলোকপাত করা হয়েছে এ লেকচারটিতে।

শুরুতেই রবার্ট লেচলার দেখালেন, আসলেই কেন সবাই স্বীকার করে নিয়েছেন চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য খাতে বিপ্লব সাধিত হয়েছে। মূল কারণ হচ্ছে, গত ১০০ বছরে পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই গড় আয়ু বেড়ে দিগুণ হয়েছে (৩৫ বছর থেকে বেড়ে তা এখন ৭২ বছর; জাপানে সর্বোচ্চ ৮৪ বছর)। উন্নত বা অনুন্নত সব দেশের ক্ষেত্রেই তা সমান প্রযোজ্য। তাই একে বলা হচ্ছে ‘বিপ্লব’।

রবার্ট লেচলার শুরু করলেন টিকা আবিষ্কার দিয়ে। ফলে পৃথিবী থেকে অনেক রোগবালাই বিদায় নিয়েছে। তারপর তুলে ধরলেন নিরাপদ পানির ব্যবহার এবং মল–নিষ্কাশনব্যবস্থার উন্নতি কীভাবে পানিবাহিত রোগবালাই থেকে আমাদের রক্ষা করে চলেছে। তারপর একে একে বলে গেলেন গর্ভকালীন স্বাস্থ্য ও প্রসবব্যবস্থার উন্নতি, জন্মবিরতীকরণ পিল, ধূমপানের সঙ্গে ক্যানসারের নিবিড় যোগাযোগ, অ্যানাসথেসিয়া এবং জীবাণুনাশকের ব্যবহার, অ্যান্টিবায়োটিক এবং অ্যান্টিভাইরালস, মেডিকেল ইমেজিংয়ের মাধ্যমে রোগনির্ণয়, চিকিৎসাশাস্ত্রে রেন্ডোমাইজড কন্ট্রোলড ট্রায়ালের ব্যবহার এবং সবশেষে অঙ্গ প্রতিস্থাপনে সফলতা কীভাবে পর্যায়ক্রমে এ বিপ্লবকে এগিয়ে নিয়ে গেছে।

চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য খাতে ১০০ বছরে পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই গড় আয়ু বেড়ে দিগুণ হয়েছে। তাই একে বলা হচ্ছে ‘বিপ্লব’। ছবি: সংগৃহীত
চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য খাতে ১০০ বছরে পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই গড় আয়ু বেড়ে দিগুণ হয়েছে। তাই একে বলা হচ্ছে ‘বিপ্লব’। ছবি: সংগৃহীত

সবশেষে স্যার লেচলার তুলে ধরলেন, এ ১০টি অগ্রগতি থেকে আমাদের কী কী শেখার আছে। প্রথমেই বললেন, প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই হলো সবচেয়ে ভালো পদ্ধতি জনস্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য। এতে সমষ্টিগতভাবে অনেক বড় বড় সমস্যা মোকাবিলা করা যায়। ভ্যাক্সিনেশন, নিরাপদ পানির ব্যবহার, স্বাস্থ্যসম্মত পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থার উন্নতি, ধূমপানসহ অন্যান্য ক্ষতিকারক অভ্যাস এড়িয়ে চলাই চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যক্ষেত্রে এ বিপ্লবের প্রধান নিয়ামক ছিল। মূলকথা হচ্ছে পলিসি মেকার, বিভিন্ন স্তরের প্রফেশনালি এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে একত্র করে এগিয়ে আসাতে সহজ হয়েছে সমস্যা মোকাবিলায়। তারপর তুলে ধরলেন কীভাবে ছোট ছোট বিষয় থেকে বড় কিছু লাভ করতে গেলে সব সময় মানসিক প্রস্তুতিটা থাকতে হবে। উদাহরণ হিসেবে বলেন স্যার আলেকজান্ডার ফ্লেমিংয়ের পেনিসিলিন আবিষ্কারের গল্প। ১৯২৮ সালে ছুটি থেকে ফিরে তিনি দেখলেন পেট্রি-প্লেটে একটি বড় মোল্ড সাথে অনেক ব্যাকটেরিয়ার কলোনি। মোল্ডের কাছেরগুলো ছিল মৃতপ্রায় আর দূরেরগুলো বর্ধনশীল। যারা প্লেটে মাইক্রোব গ্রো করেছে, তারা জানে প্লেটে যারা গ্রো করে, তাদের মধ্যে নিউট্রিয়েন্ট নিয়ে একধরনের প্রতিযোগিতা থাকে। কম নিউট্রিয়েন্ট যারা পায়, তাদের গ্রোথ কমে যায়। মোল্ড যেহেতু অনেক বড় ছিল, তাই তার পাশের ব্যাকটেরিয়াগুলো নিউট্রিয়েন্ট কম পেয়ে মৃতপ্রায় ছিল, এটাই হতে পারত ব্যাখ্যা। কিন্তু ফ্লেমিং অন্যভাবে ভাবলেন এবং পরবর্তী সময়ে তার ব্যাখ্যার সপক্ষ প্রমাণ করতে সমর্থ হয়েছিলেন যে মোল্ড থেকে পেনিসিলিন নিঃসৃত হয়, যা ব্যাকটেরিয়াগুলোকে মেরে ফেলে। ফলে ১৯৪০ সালে অক্সফোর্ডের একটি টিম, যার নেতৃত্বে ছিলেন স্যার হাওয়ার্ড ফ্লোরি, ইঁদুরে পেনিসিলিন কেমোথেরাপিউটিক হিসেবে ব্যবহার করে সফলতা পান। যাঁর হাত ধরেই শুরু হয়েছিল অ্যান্টিবায়োটিক যুগের সূচনা।


এত এত সাফল্যের পরও আমাদের অনেক কিছু কম অর্জিত হয়েছে। লেচলারের কথায় সেটা হচ্ছে আমাদের গড় আয়ু দ্বিগুণ বেড়েছে কিন্তু রোগশোক ছাড়া বেঁচে থাকার সময় দিগুণ হয়নি। ৮০ বছরের অনেকটা সময়ই হয়তো অনেক ধরনের দুরারোগ্য ব্যাধির সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতেই পার করতে হচ্ছে। ১১ মার্চ পরবর্তী লেকচারে তুলে ধরবেন চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য খাতের এই বিপ্লবের পথে যা কিছু ভালো, মন্দ ও প্রশ্নবিদ্ধ।

লেখক: শিক্ষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং পোস্ট গ্র্যাজুয়েট গবেষক, কিংস কলেজ লন্ডন, যুক্তরাজ্য