এক রোদঝলমলে সুন্দর সকালে তিন বন্ধু পাভেল, মিশু আর আমি মেলবোর্ন থেকে গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম। গন্তব্য ৩ হাজার ৮০০ কিলোমিটার দূরের ডারউইন। শুরুতে যদিও অনেক বেশি মনে হয়েছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ার মরুভূমি, রত্নপাথর, পাহাড় আর ভয়ংকর সব কুমির দেখার রোমাঞ্চে দূরত্বটা খুব কম বলেই মনে হয়েছে।
প্রথম দিনেই প্রায় ১০ ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে অ্যাডিলেড পার হয়ে আমরা পৌঁছে গেলাম পোর্ট অগাস্টায়। শুরুতে রাস্তার দুই পাশ সবুজ থাকলেও মাটি এখন লাল বর্ণ ধারণ করতে শুরু করেছে। রাস্তার দুধারে চোখে পড়ছে অসংখ্য ক্যাঙারু, ঘোড়া, গরু আর ভেড়ার পাল। আরও দেখলাম লবণের লেক। গ্রীষ্মের গরমে লেকের পানি শুকিয়ে যাওয়ায় পড়ে রয়েছে শুধু লবণের আস্তরণ। সাদা ধবধবে লবণের ওপর সূর্যের আলো পড়ায় এক গোলাপি আভার সৃষ্টি হয়েছে। আহ! সে এক মনোমুগ্ধকর দৃশ্য।
মাটির নিচে অন্ধপুরীতে ঘুম
পরদিন রওনা দিলাম কুবের পেডির উদ্দেশে। পথে দেখলাম উইপোকার ঢিবির মতো হাজারো মাটির স্তম্ভ। খোঁজ নিয়ে জানলাম অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে বেশি রত্নপাথর পাওয়া যায় এই অঞ্চলে। তাই সব জায়গায় খোঁড়াখুঁড়ি করে চলছে রত্নপাথরের খোঁজে। আরও জানলাম, মরুভূমির তপ্ত বালুর তীব্র গরম থেকে বাঁচতে এখানকার মানুষ মাটির নিচে বসবাস করেন। আমাদেরও মাটির নিচেই থাকতে হলো। সুড়ঙ্গ দিয়ে যখন নিচে নামছি, সামনে তাকিয়ে দেখি মিশুর কাঁপুনি শুরু হয়ে গেছে। কাঁপুনির কারণ কি ছিল মাটির নিচের ঠান্ডা, নাকি মাটির নিচে জীবন্ত চাপা পড়ার ভয়, তা গা–ছমছমে আবছা আলোয় ঠিকমতো ঠাহর করতে পারিনি। তবে রাতে বাতি নিভিয়ে মাটির নিচের গাঢ় নিকষ কালো অন্ধপুরীতে যখন ঘুমাতে গেলাম, মৃত্যুভয়ে বুক যে দুরুদুরু কাঁপছিল, তা বলতে আর দ্বিধা নেই। এভাবে কিছু সময় পার হতেই শুনি বদ্ধ ঘরে এক গমগমে আওয়াজ। ভয়ে প্রায় বিছানা থেকে লাফিয়ে পড়ার দশা। এমন সময় বুঝতে পারলাম, ওটা আসলে বন্ধু পাভেলের নাক ডাকার শব্দ। যদিও প্রতি রাতে নাক ডাকার কারণে বন্ধুকে অনেক গালাগালি করেছি। কিন্তু ওই রাতে যতবার ঘুম ভেঙেছে, ততবার বন্ধুর নাক ডাকার শব্দ শুনে মনে মনে বলেছি, ‘যাক, তাহলে এখন বেঁচে আছি!’
উলুরুর: অস্ট্রেলিয়ার অন্যতম পর্যটন এলাকা
পরদিন সকালে আমরা রওনা দিলাম উলুরুর উদ্দ্যেশে, যা অস্ট্রেলিয়ার অন্যতম প্রধান পর্যটক আকর্ষণ। কুবের পেডিতে দেখা ঝলমলে সব রত্নপাথরের রেশ কাটতে না কাটতেই প্রকৃতির আরেক অসাধারণ রূপ দেখে আমরা বিমোহিত হয়ে গেলাম। বিস্তীর্ণ ধু ধু মরুভূমির মাঝে বিশাল আকারের এক পাথর, এত বিশাল যে পুরো পাথর এক চক্কর ঘুরে দেখতে প্রায় দেড় ঘণ্টা সময় লাগে। কথিত আছে, পাথরটা ক্ষণে ক্ষণে রং বদলায়। কথাটা অতিরঞ্জন মনে হলেও সূর্যাস্তের সময় শত শত পর্যটকদের সঙ্গে আমরাও অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখলাম, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাথরের রং আসলেই বদলে যাচ্ছে। সেই অপরূপ দৃশ্য বর্ণনার ভাষা আমার জানা নেই বলে চেষ্টাও করছি না।
এবারের গন্তব্য এলিস স্প্রিংস। সেখানে সুমন ভাই আর কান্তা ভাবি মজাদার সব খাবার নিয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। সেখানে পৌঁছে দুপুরে খেলাম স্যামন মাছ, চিংড়ি, মুরগি, গরুর মাংসসহ আরও কত–কী। সন্ধ্যায় বাসায় বানানো মিষ্টি-সন্দেশ খেয়ে আর রাতে সবাই মিলে বারবিকিউ করতে করতে খুব সুন্দর কিছু সময় কাটালাম। পথের ক্লান্তি তত দিনে একটু একটু করে চেপে বসতে শুরু করেছিল। কিন্তু এ দিনটা আমাদের আবার পুরোপুরি চাঙা করে তুলল।
উটের পিঠে ঘুরে বেড়ানো
পরদিন মরুভূমির বাহন উটের পিঠে ঘুরে বেড়ানোর পালা। মরুভূমির তপ্ত বালুর মাঝে উটের পিঠে ঘুরতে ঘুরতে মনে হয়েছিল জীবনটা বেদুইনদের মতো কাটিয়ে দিতে পারলে হয়তো খুব বেশি মন্দ হতো না। কিন্তু মরুভূমির লু হাওয়ায় তাপমাত্রা ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছালে বেদুইন হওয়ার সাধ মুহূর্তেই মিলিয়ে গেল। তাই আবার ছুটে চললাম ডারউইনের উদ্দেশে। পথিমধ্যে মাতারাঙার এক বনের মধ্যে দেখলাম স্বচ্ছ টলটলে পানির এক প্রাকৃতিক জলাধার, যা দূর থেকে কৃত্রিম সুইমিং পুল বলে আমাদের ভ্রম হয়েছিল। শুরু হয়ে গেল পানিতে নেমে আমাদের দাপাদাপি, আহ! কত দিন পর পানি পেয়েছি। এরপর কিছু দূর এগিয়ে যেতে দেখলাম দুই পাহাড়ের মাঝে বিশাল এক জলপ্রপাত, নাম এডিথ ফলস। প্রকৃতির অসাধারণ রূপ দেখে আরেকবার আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে গেল। ঘণ্টাখানেক আগের দাপাদাপির কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে আমরা আবার নেমে পড়লাম পানিতে। এবারে অবশ্য একটু ভয় করছিল, কারণ আমরা ততক্ষণে ঢুকে পড়েছি কুমির অধ্যুষিত এলাকায়। যদিও সবাই বলছিল এ সময়ে কুমির খুব একটা দেখা যায় না, তবু কোথাও একটু শব্দ হলেই চমকে পেছন ফিরে তাকিয়েছি।
হাজার কুমিরের বাস অ্যাডিলেড নদীতে
অবশেষে যাত্রা শুরুর ৬ দিন পর আমরা এসে পৌঁছালাম ডারউইনে। চারপাশ ঘিরে থাকা সমুদ্র দেখে যখন মুগ্ধ হয়ে গেছি, তখনই জানলাম সমুদ্রসৈকতগুলোয় নামা সম্পূর্ণ নিষেধ, কারণ এখানে রয়েছে কুমিরের আনাগোনা। তাই দূর থেকে সমুদ্র দেখেই ঘরে ফিরতে হলো। পরদিন সকালে আমরা গেলাম অ্যাডিলেড নদীতে, যেখানে প্রায় কয়েক হাজার কুমিরের বাস। ইঞ্জিনচালিত নৌকা নিয়ে কিছু দূর যেতেই দেখা মিলল ‘ভয়ংকর সুন্দর’ সে প্রাণীর। পৃথিবীর সবচেয়ে হিংস্র লোনাপানির কুমিরগুলো যখন নৌকার চারপাশে ঘুরঘুর করছিল, তখন ভয়ে আমাদের অন্তরাত্মা খাঁচাছাড়া হওয়ার জোগাড়। একই সঙ্গে নৌকা থেকে ছুড়ে দেওয়া মাংসের টুকরা খাওয়ার জন্য কুমিরগুলো যখন লাফিয়ে উঠছিল, তা ছিল অভিভূত হওয়ার মতো এক দৃশ্য।
এবারে ফেরার পালা। হাশেম ভাই আর মহুয়া আপুর বাসায় রাতের খাবার খেয়ে যখন বিমানবন্দরে যাচ্ছি, গাড়িতে তখন সুনসান নীরবতা। মরুভূমির সৌন্দর্য আর ভয়ংকর সব কুমির দেখে সবাই যেন ভাষা হারিয়ে ফেলেছেন। এখন সিডনি ফেরার প্লেনে বসে এ লেখা লিখছি আর মনে মনে প্ল্যান করছি আবার কবে আসব।