এক পড়ন্ত বিকেলে রিজরভিসে

সিঙ্গাপুরের সেলেটারি রিজরভিসে সূর্যাস্ত। ছবি: লেখক
সিঙ্গাপুরের সেলেটারি রিজরভিসে সূর্যাস্ত। ছবি: লেখক

গত একটা মাস বাসায় বসে থাকা এক অস্বস্তিকর পরিবেশ। বিশেষ করে করোনাভাইরাসের কারণে অহেতুক বাসা থেকে কেউ বের হয় না। সেই ডিসেম্বর থেকে শুরু, মানুষের চলাচল ঢালাওভাবে কমতে শুরু করল জানুয়ারির শেষ দিকে, যখন পত্রিকায় প্রকাশিত হলো সিঙ্গাপুরে করোনাভাইরাসে সংক্রমিত রোগী পাওয়া গেছে।

জানুয়ারি থেকে ধরে নেওয়া যায় একপ্রকার নিজেকে নিজেই গৃহবন্দী করে রাখা। অফিস–বাসা এবং বাসা–অফিস—এই হলো সিঙ্গাপুরে প্রবাসজীবনের কিছুটা ছন্দপতন। দিনের পর দিন আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমেই বাড়তে থাকবে।

এদিকে এরই মধ্য দেশে-বিদেশে পরিচিত বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন ফেসবুকের ইনবক্সে খোঁজখবর নেওয়া শুরু করলেন। কেমন আছি? সাবধানে চলছি কি না? নানান জনের হাজারো উৎকণ্ঠা আমাকে নিয়ে। তাঁদের আশ্বস্ত করলাম, আমি বেশ ভালোই আছি। যতটুকু সাবধানতা অবলম্বন করে চলা দরকার, সেই নিয়মনীতিগুলো অনুসরণ করে চলছি।

লেকের এক পাশে গলফ মাঠ আর অপর পাশে সংরক্ষিত জঙ্গল এবং সিঙ্গাপুর চিড়িয়াখানা। লেকের পাশের সুন্দর পাকা পিচ রাস্তায় বিকেলে স্বাস্থ্যসচেতন লোকেরা ব্যায়াম করেন। ছবি: লেখক
লেকের এক পাশে গলফ মাঠ আর অপর পাশে সংরক্ষিত জঙ্গল এবং সিঙ্গাপুর চিড়িয়াখানা। লেকের পাশের সুন্দর পাকা পিচ রাস্তায় বিকেলে স্বাস্থ্যসচেতন লোকেরা ব্যায়াম করেন। ছবি: লেখক

আমি আবার বরাবরই ঘুরে বেড়ানো মানুষ। সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোয় ঘুরতে বের না হলে মনে হয় কতকাল ঘুরি না। নিজের ভেতরে কেমন যেন এক অস্থিরতা কাজ করে। মনে মনে অনেক যুদ্ধ করে সিদ্ধান্ত নিলাম, কোথাও ঘুরতে বের হব। চিন্তা করতে করতে শেষে সিদ্ধান্ত নিলাম, সেলেটারি রিজরভিস যাব। ইদানীং দিনের বেলার রোদের তেজটা হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় ভাবলাম, বিকেলের দিকে বের হওয়াটা ভালো। দুপুরে খাওয়ার পর বিছানায় শরীরটা একটু নুয়ে দিয়ে ঘুম থেকে উঠেই দেখি, ঘড়িতে বিকেল চারটা বাজে। এরপর গুগল ম্যাপে শুরু এবং শেষ ঠিকানা দিয়ে বাসের নম্বর দেখে, বাসস্টপেজে বাসের জন্য অপেক্ষা করলাম। বাসটি মোটামুটি পাঁচ-ছয় মিনিটে হাজির হলো। উঠে পড়লাম। গুগল ম্যাপ ধরে বাসের গতিপথ অনুসরণ করতে করতে যেতে লাগলাম। যদিও গুগল ম্যাপ বলে দিল, এক বাসে সরাসরি যাওয়া যাবে না, মাঝে অন্য নম্বরের বাস অনুসরণ করতে হবে। একটি বাসস্টপেজে নেমে আরেকটি বাস ধরে নিলাম। সেই বাস ধরে যেতে গিয়ে বুঝলাম, আমার কোথাও ভুল হয়ে গেছে। বাস থেকে নেমে হাঁটা শুরু করলাম। হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর চলে এলাম। আশপাশে জঙ্গল হওয়ায় বাসস্টপেজগুলো বেশ দূরে দূরে। যাইহোক, আবারও গুগলের সহযোগিতা নিলাম। পরে আবার যে বাসে উঠলাম সেই বাস থেকে এমন একটি স্টপেজে নামলাম, যেটা হলো সিঙ্গাপুর চিড়িয়াখানায় যাওয়ার ব্যস্ত রাস্তা, যেটা গুগল ম্যাপ দেখে ভুল স্টপেজে কোথাও নেমে পড়েছি। তার বিপরীতে যে বাসস্টপেজ ছিল সেই পাশে দুই পুলিশ স্পিড ক্যামেরা নিয়ে গাড়ির গতি মাপার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। সাহস করে রাস্তা পার হতে পারলাম না। এ–ও জানি, সিঙ্গাপুরে ক্রসিং ছাড়া রাস্তা পার হলে জরিমানা দেওয়া লাগে ৩০ ডলার। পরে আবার হাঁটতে হাঁটতে পরে স্টপেজে গেলাম, সেখান থেকে বিপরীত স্টপেজে গিয়ে সেখান থেকে ১৩৮ নম্বর বাস ধরে সেলেটারি রিজরভিসের দিকে রওনা হলাম।

দুই পাশে সবুজ সারি সারি গাছের মধ্য দিয়ে রাস্তাটিকে অপূর্ব সুন্দর লাগছিল। মনের অজান্তে গুনগুন গান গেয়ে উঠি, ‘এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হতো তুমি বলো তো?’ শেষে ‘লওয়ার সেলেটারি রিজরভিস’–এর বাসস্টপেজে নামলাম। বেঞ্চে বসে কিছুক্ষণ প্রকৃতির সান্নিধ্য নিলাম। এই রিজরভিস হলো বদ্ধ পানির লেক। রোদে পানি অন্যরকম আলোকচ্ছটা ছড়াচ্ছিল, সে এক অপরূপ সৌন্দর্য।

লেকের পাড়ে অনেকেই সূর্যাস্ত দেখেন। ছবি: লেখক
লেকের পাড়ে অনেকেই সূর্যাস্ত দেখেন। ছবি: লেখক

লেকের এক পাশে গলফ মাঠ আর অপর পাশে সংরক্ষিত জঙ্গল এবং সিঙ্গাপুর চিড়িয়াখানাটি। এই লেকে রিভার সাফারি করে ভ্রমণপিপাসু লোকজন। লেকের পাশ দিয়ে সুন্দর পাকা পিচ রাস্তা, যেখানে বিকেলবেলায় স্বাস্থ্যসচেতন লোকেরা ব্যায়াম করতে আসেন। পাশাপাশি প্রকৃতির সৌন্দর্যের জন্য অনেক যুগল পেশাদার ফটোগ্রাফারকে নিয়ে ছবি তুলে, জীবনের খাতায় স্মৃতি হিসেবে রেখে দেওয়ার চেষ্টা চালায়। আমিও চারপাশ অবলোকন করতে করতে পাকা পিচঢালা পথ ধরে এগোতে থাকি। তবে আজকে আমার বিশেষ লক্ষ্য সিঙ্গাপুরের সূর্যাস্ত দেখার। এক জায়গায় ঘুরতে যাওয়ার প্রাক্কালে গুগল করে যে তথ্য পেলাম, তা হলো সূর্যাস্ত দেখা যায়, যেটা সিঙ্গাপুরের অন্য জায়গার চেয়ে অন্য রকম সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। আমি হাঁটতে হাঁটতে পুরো শেষ প্রান্তে পর্যন্ত এসে কিছুটা বিশ্রাম নিলাম। পানির পিপাসাও লাগল। শেষ মাথার বিশ্রামাগারে শৌচাগার এবং বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করা আছে। লেকের পানি দেখে নিজের মাতৃভূমির কথা মনে পড়ে গেল। এই তো আমাদের রা ঙামাটি লেক, ঢেউ একটার পর একটা আসছে, তীরে এসে আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। সে এক অপূর্ব দৃশ্য।

এরপর সূর্য ডোবার পালা। মাহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত হওয়ায় আমার ফোনের ক্যামেরা দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে কিছু ছবি ধারণ করলাম। মনে পড়ে যায়, দেশের মাটি ও মানুষের কথা। শৈশবে চেঙ্গীর নদীর পাড়ে বিকেলবেলা রাখাল বালকের গরুর পাল নিয়ে ফেরা আর এদিকে সূর্য সারা দিনে তপ্ত গরম মাড়িয়ে আলুটিলা পাহাড়ে আঁচড় লেগে হারিয়ে যাওয়া।

তবুও প্রবাসজীবনে কর্মের টানে, জীবিকার তাগিদে একটু ভালো থাকার আপ্রাণ প্রচেষ্টা।