লুজার্ন যাত্রার শেষটা ছিল মনে রাখার মতো

লুজার্ন শহর দেখতেই এক ভালো লাগা কাজ করতে শুরু করল। ছবি: লেখক
লুজার্ন শহর দেখতেই এক ভালো লাগা কাজ করতে শুরু করল। ছবি: লেখক

সুইজারল্যান্ডের একটি বিখ্যাত শহর লুজার্ন। রওনা দিয়েছিলাম দেশটির হাড়কাঁপানো শীতের শহর সেন্ট মোরিজ থেকে। সুপার ফাস্ট গতিতে চলছে ট্রেন। দুই পাশের স্বচ্ছ কাচ দিয়ে মুগ্ধ নয়নে বাইরের দৃশ্য দেখছি, এ সময় পাশের সারিতে এক ভদ্রলোক এসে বসলেন। ভদ্রলোকের পা টলছে, চোখ ঘোলা এবং ভাবভঙ্গি অপ্রকৃতস্থের মতো। বোঝাই যাচ্ছে, পাঁড় মাতাল অবস্থায় ট্রেনে উঠেছেন।

ওই লোক আমাদের দিকে তাকিয়ে হ্যালো, নাইস ওয়েদার, এনজয়িং—এসব বলা শুরু করলেন। আমি অতি কষ্টের একটা হাসি দিয়ে ঘাড় নাড়িয়ে সম্মতি দিয়ে টান টান হয়ে গেলাম। এমন ভাব যেন সামান্য কাত হলে লোকটি আমাকে বিশাল জোরে একটা ধমক দেবেন। ফিসফিস করে বরকে জিজ্ঞেস করলাম, এখন কী করব? বলল, কী করব মানে কি? আর ফিসফিস করছ কেন? তোমার বাংলা এখানে কেউ বুঝবে না। যা ইচ্ছা সশব্দে বলো। বললাম, ওই মাতাল বেটাকে দেখো, কীভাবে যেন তাকাচ্ছে। বর বলল, লোকটা কিছুই করছে না, সে নিজের মতো। তুমি অন্য দিকে তাকিয়ে থাকো। জাস্ট বি নরমাল। কিছু হবে না।

পরের স্টেশন থেকে পাশের সারিতে একজন মধ্যবয়স্ক নারী এসে বসলেন। তাঁর সিট ওই ভদ্রলোকের একেবারে পাশে। নারী নিজের সিটে বসে আমাদের সবাইকে মিষ্টি হেসে হাই হ্যালো করলেন, আমরাও করলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে বেচারির করুণ অবস্থা হলো। মাতাল লোকটি একটু পরপর উঠে বাথরুম যাচ্ছেন। নিজের মনে বিড়বিড় করে কথা বলছেন। নারী মহাবিরক্ত। একপর্যায়ে নিজের সঙ্গে কথা বলে বলে লোকটি সম্ভবত বোর হয়ে গেলেন। তখন তিনি শুরু করলেন পাশের নারীটিকে গল্প শোনানো। নারীর বিন্দুমাত্র উৎসাহ নেই, কিন্তু লোকটি বলবেনই। ব্যাটা নিজের হুঁশে নেই, কাজেই তাঁকে নিষেধ করেও লাভ নেই। নারী হাল ছেড়ে দিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে হতাশ গলায় বললেন, ‘টু মাচ অ্যালকোহল, নট গুড। নট গুড অ্যাট অল।’

লুজার্নে এপ্রিলে ঝকঝকে রোদ, মোটামুটি গরমকালে ভ্রমণে গিয়েছিলেন লেখক ও তাঁর স্বামী। ছবি: সংগৃহীত
লুজার্নে এপ্রিলে ঝকঝকে রোদ, মোটামুটি গরমকালে ভ্রমণে গিয়েছিলেন লেখক ও তাঁর স্বামী। ছবি: সংগৃহীত

অবশেষে যখন আমাদের ট্রেনযাত্রা শেষ হলো, সবাই মোটামুটি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলামই বলা চলে। আমরা তো তবু যাত্রা কিছুটা উপভোগ করেছিলাম প্রথম দিকে, ওই ভদ্রমহিলা তো সেটুকুও পারেননি। সারাটা পথ উনাকে মাতাল লোকটির উদ্ভট অসামঞ্জস্যপূর্ণ গল্প আর গান শুনতে হয়েছে। আমরা একে অপরকে বিদায় জানাচ্ছি। লোকটি আমাদের কাছে সরে এসে হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত বাড়িয়ে বললেন, জার্নিটা দারুণ ছিল। তোমাদের সবাইকে ধন্যবাদ, খুব এনজয় করেছি। ছেলে আসবে আমাকে নিতে, তোমাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব, দাঁড়াও। আমার বর তাঁর সঙ্গে হাত মিলিয়ে জবাব দিলেন, শুনে ভালো লাগল আপনার ছেলের কথা, আজকে হয়তো হবে না, নেক্সট টাইম মিট করব, ইউ টেক কেয়ার। এরপর আমরা লাগেজ নিয়ে নেমে গেলাম।

ট্রেন থেকে নামার সময় বরের সঙ্গে দুষ্টুমি শুরু করলাম। বললাম, আহা, বেচারা এত শখ করে তোমাকে ছেলের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতে চাইছিল, থাকলেই পারতে। উত্তর দিল, আরে তুমি কি সত্যি ভেবেছ নাকি ওর ছেলে আছে? নেশার ঘোরে কী বলছে নিজেই জানে না। বর হয়তো আরও কিছু বলত, কিন্তু তার আগেই দেখতে পেলাম একটি হ্যাংলা পাতলা ১৯–২০ বছরের চশমা পরা ছেলে হাত ধরে লোকটিকে ট্রেন থেকে নামালেন। দুজনের চেহারার মিল আমাদের বুঝিয়ে দিল, লোকটি মাতাল হলেও মিথ্যুক নন। অবাক হয়ে দেখলাম, ছেলেটি কী সুন্দর করে বাবার হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে নিজের কাঁধে ঝোলালেন। এরপর বাবার হাত ধরে স্টেশনের বাইরের দিকে হাঁটা শুরু করলেন। দৃশ্যটির মধ্যে অদ্ভুত এক আবেগ ছিল। আমরা কিছুক্ষণ বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলাম। কে বলে ওয়েস্টার্ন দেশগুলোতে ১৭-১৮ বয়স থেকেই ছেলে-মেয়েরা মা–বাবাকে ছেড়ে চলে যায়। তাদের মধ্যে কোনো ভালোবাসা, দায়িত্ববোধ কিছুই থাকে না? এই তো নিজের চোখে দেখলাম, একটি ছেলে তাঁর মদ্যপ পিতার জন্য তাঁর হৃদয়ে কতটা মায়া জমা করে রেখেছেন, নিজের চোখকে অবিশ্বাস কী করে করি?

নতুন শহরে পা দিতেই অমন মায়াবী একটি মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে মনটা অন্য রকমভাবে পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। তাই লুজার্নের প্রতি শুরু থেকেই এক ভালো লাগা কাজ করতে শুরু করল। শহরটির মধ্যে যা–ই দেখলাম তা–ই ভালো লাগল। দিনটি ছিল ২৬ এপ্রিল। ওই দিন লুজার্নে ঝকঝকে রোদ, মোটামুটি গরমকালই বলা চলে। সবাই সুতির আরামদায়ক পোশাক পরে ঘুরছেন। ব্যাপারটা বড়ই মজার! সেন্ট মোরিজ নামে সুইজারল্যান্ডের যে শহর থেকে আমরা এসেছি, সেখানে তুমুল তুষারপাত হচ্ছিল, কনকনে শীত। আর সেই একই দেশের আরেকটি শহরে লোকে সামারের আরামদায়ক রোদ সেঁকছে। যাইহোক, লুজার্ন সম্পর্কে এক কথায় বলতে গেলে বলা যায়, আধুনিক ঝলমলে একটি শহর। সুইজারল্যান্ড ট্রিপের মধ্যে সবারই লুজার্ন দর্শন অন্তর্ভুক্ত থাকে। কারণ, এ শহরের কয়েকটি জিনিস খুবই বিখ্যাত। এর মধ্যে ১৩ শ শতকে তৈরি চ্যাপেল ব্রিজ, ওয়াটার টাওয়ার, লায়ন অব লুজার্ন, মাউন্ট পিলাটস, মাউন্ট রিগি, সুইস মিউজিয়াম অব ট্রান্সপোর্ট অন্যতম। মাউন্ট রিগি ও মাউন্ট পিলাটস চূড়া থেকে দেখার জন্য বা চূড়ায় যাওয়ার জন্য নির্দিষ্ট ট্রেন আছে। ওই লালরঙা ছোট ছোট ট্রেনগুলো পাহাড়ি রাস্তার ভেতর দিয়ে যখন ওপরে ওঠে, তখন ভীষণ অ্যাডভেঞ্চার অ্যাডভেঞ্চার ভাব হয়।

লুজার্ন আধুনিক ঝলমলে একটি শহর। এ শহরে ১৩ শ শতকে তৈরি চ্যাপেল ব্রিজ, ওয়াটার টাওয়ার, লায়ন অব লুজার্ন, মাউন্ট পিলাটস, মাউন্ট রিগি, সুইস মিউজিয়াম অব ট্রান্সপোর্ট অন্যতম। মাউন্ট রিগি ও মাউন্ট পিলাটস চূড়া থেকে দেখার জন্য বা চূড়ায় যাওয়ার জন্য নির্দিষ্ট ট্রেন আছে এ শহরে।
লুজার্ন আধুনিক ঝলমলে একটি শহর। এ শহরে ১৩ শ শতকে তৈরি চ্যাপেল ব্রিজ, ওয়াটার টাওয়ার, লায়ন অব লুজার্ন, মাউন্ট পিলাটস, মাউন্ট রিগি, সুইস মিউজিয়াম অব ট্রান্সপোর্ট অন্যতম। মাউন্ট রিগি ও মাউন্ট পিলাটস চূড়া থেকে দেখার জন্য বা চূড়ায় যাওয়ার জন্য নির্দিষ্ট ট্রেন আছে এ শহরে।

আমার সবচেয়ে পছন্দ হয়েছে লেক লেজার। বিশাল এক শিপে করে আমরা লেক লেজার ঘুরেছি। ঘণ্টা দুইয়ের এই জাহাজের অভিজ্ঞতা অত্যন্ত আনন্দদায়ক। লেক লুজার্ন সুইজারল্যান্ডের সবচেয়ে আকর্ষণীয় লেক। আর আমরা যেহেতু সূর্যের দিনে গিয়েছিলাম কাজেই ওই আলোয় পানির রং যে কতটা অপূর্ব লাগছিল, তা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। এত সুন্দর নীল আর সবুজের মিশ্রণ আমি জীবনে আর কোথাও দেখিনি। এ হ্রদ থেকে রিগি পাহাড়ের অপরূপ সৌন্দর্য প্রাণভরে অবলোকন করা যায়। পাহাড়ের কোলে দারুণ সব ঘরবাড়ি, হোটেল, স্টেশন। আর এদিকে পানির রং একবার নীল থেকে সবুজ, আবার সবুজ থেকে নীলে রূপান্তরিত হচ্ছে। একটু গরম অনুভূত হতে না হতেই আরামদায়ক হাওয়া এসে মনকে শীতল করে দিচ্ছে। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির ডাইনিং হলে অনেকে বসে পেটপূজা করলেও আমরা বসেছিলাম খোলা আকাশের নিচে। কারণ, সেখান থেকেই চারপাশটা দেখতে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয় লাগে। খাওয়াদাওয়া করে সময় নষ্ট করতে মন চাইছিল না।

আমাদের হোটেলটি ছিল চ্যাপেল ব্রিজের একদম পাশেই। জানালা খুললেই মুখটা আপনাতে হাসি হাসি হয়ে যেত। যদিও সেটা শহরের সবচেয়ে ব্যস্ততম এলাকা। তারপরও ভালো লেগেছিল। একটি রাত ও দেড়খানা দিন কাটিয়েছিলাম এই শহরে। সুইজারল্যান্ডে অনেক কোলাহলমুক্ত গ্রাম, নৈঃশব্দ্যের নগরী দেখার পর লুজার্নের ওই ব্যস্ততা মন্দ লাগেনি। একই দেশে এতখানি বৈচিত্র্য দেখার সৌভাগ্য জীবনে বড় একটা আসে না, সে জন্যই হয়তো। লুজার্ন আমাদের আট দিনের সুইজারল্যান্ড ভ্রমণের সর্বশেষ নগরী ছিল। কথিত আছে, শেষ ভালো যার সব ভালো তার। তারই রেশ টেনে বলতে গেলে বলতে হয়, শেষটা ষোলো আনা মনে রাখার মতো ছিল।