মৃত্যুর দুয়ারে আমরা

বরফে আচ্ছাদিত কবরস্থানে হিমশীতল পরিবেশে চিরবিদায়। ছবি: সংগৃহীত
বরফে আচ্ছাদিত কবরস্থানে হিমশীতল পরিবেশে চিরবিদায়। ছবি: সংগৃহীত

১.
যে দেহে প্রাণ আছে তা জীবন্ত। শ্বাস-প্রশ্বাস সচল রেখে জীবিত কোষের মাধ্যমে দেহে অনুভূতিকে বাঁচিয়ে রাখাটাই জীবন। সব শ্রেণির জীবে প্রাণের স্পন্দন আছে। অনুভূতি আছে। মানব জীবনের শুরুটা একটি শুক্রাণু আর একটি ডিম্বাণুর জাইগোট থেকে। বাবার থেকে পাওয়া শুক্রাণু আর মায়ের ডিম্বাণু দিয়ে তৈরি হয় একটি ভ্রূণ। মায়ের গর্ভাশয়ে নিরাপদে বড় হওয়ার প্রয়োজনীয় সবকিছুর উপস্থিতিতে পরম যত্নে এই ভ্রূণের বৃদ্ধি হয়। মমতাময়ী মায়ের এক দেহে দুই জীবন। নিজের জীবনের সবকিছু শেয়ার করে এই মা তাঁর দেহে সেই আরেকটি জীবনকে পরিপূর্ণ রূপ দিতে সীমাহীন সতর্কতায় দিনাতিপাত করেন। গর্ভাশয়ে নিরাপদে বড় হয়ে গঠনে পূর্ণতা পেলে জন্ম হয় একটি মানব শিশুর। পৃথিবীতে একটি নতুন জীবনের যাত্রা শুরু।

যাত্রা শুরুর এই জন্ম শব্দটিতে আনন্দ আছে। একসময় এই আনন্দের শেষ হয় শোকে, চিরবিদায়ে, ব্যথায়, জীবনের মৃত্যুতে। জীবনের শেষ মানেই হলো মৃত্যু। বিশেষ অবস্থায় একটি দেহ জীবিত নাকি মৃত তাৎক্ষণিকভাবে বলা যায় না। বলা সহজও নয়। কোমায় থাকা হলো জীবন ও মৃত্যুর মাঝামাঝি অবস্থা। মৃত্যুটা একটা প্রক্রিয়া। মস্তিস্ক, হৃদযন্ত্র আর শ্বাস–প্রশ্বাস দেহের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ তিনটি বিষয়। সব কয়টি মুহূর্তেই একসঙ্গে থেমে যায় না।

২.
২০১৭ সালের মার্চে। সুস্থ, সবল আর শাশ্বত স্বভাবের মেধাবী আলতাফ সেদিন নিজ বাসায় বিছানায় বসে কম্পিউটারে প্রোগ্রামিংয়ের কাজ করছিলেন। কানাডায় তখনো কনকনে ঠান্ডা। বাইরে ভারী তুষারবৃষ্টি। প্রোগ্রামিংয়ের কাজ, আর কঠিন জীবনসংগ্রামের বাস্তবতায় চেহারাতে তাঁর বেশ ক্লান্তিরšছাপ। হঠাৎ হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া থেমে গেল। হেলে পড়লেন তিনি। মুখে অস্বাভাবিক ফেনা উঠছে। তখন রাত প্রায় ১০টা। তাঁর স্ত্রী কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লেন। সঙ্গীর জীবন ফিরে পেতে সুচ দিয়ে হাত ও পায়ে ছিদ্র করলেন। কাজ হচ্ছে না। পাশের ফ্ল্যাট থেকে ছুটে এলেন বন্ধু। কল দেওয়া হলো ৯১১-এ। অপর প্রান্তে এই জরুরি বিভাগের দক্ষ সদস্যরা ফোনে নির্দেশনা দিচ্ছেন। আর প্রাণপনে ছুটে আসছেন। কানাডায় সরকারি ব্যবস্থাপনায় ৯১১-এর এই জরুরি বিভাগ একটি অত্যন্ত কার্যকর সার্ভিস। প্রায় নয় মিনিটে তাঁরা হাজির। দক্ষ হাতে এখন তাঁরা চেষ্টা চালাচ্ছেন রোগীকে বাঁচাতে। আর সাইরেন বাজিয়ে মুহূর্তেই ফাঁকা করে দেওয়া রাস্তা দিয়ে সর্বোচ্চ গতিতে ফিরে যাচ্ছেন হাসপাতালের পথে। হৃদযন্ত্র চুপসে যাওয়া সেই মুমূর্ষ রোগীকে বাহ্যিক মৃত মনে হলেও উন্নত দেশের দক্ষ ও তড়িৎ ব্যবস্থাপনায় আর বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের এক মাসের নিরলস প্রচেষ্টায় সুচিকিৎসা পেয়ে জীবন জয়ী হয়েছে।

না, সব জীবন এভাবে জয়ী হয়ে ফিরে আসে না। ফিরে আসেননি অমিত। বাংলাদেশে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে কয়েক বছর চাকরি শেষে মেধাবী ছেলে অমিত তাঁর ছোট্ট পরিবার নিয়ে পাড়ি জমিয়েছিলেন ২০১৬ সালে টরন্টোতে। নতুন দেশ কানাডায় এসেই জীবনসংগ্রামে তাল মেলাতে উচ্চতর লেখাপড়া শুরু করে নিজেকে প্রস্তুত করছেন। লেখাপড়া আর খেলাধুলাপ্রিয় ছেলে তিনি। শরীর ঠিক রাখতে অনেক দৌড়াতেন। পরের বছর হাড়কাঁপানো শীতের আবহাওয়ার মাঝে কোনো একদিন বুকে ব্যথা নিয়ে হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে চিকিৎসক দেখিয়েছেন। মাত্র কদিন পর সেই ২০১৭-এর মার্চ মাসে এক সন্ধ্যাবেলায় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে হঠাৎ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন। জরুরি বিভাগ ৯১১-এর প্যারামেডিক আর চিকিৎসকদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে। শোকের ছায়া নেমে এল সবার মাঝে।

৩.
জীবনের মৃত্যু অনিবার্য। সত্যটিকে ভুলে যাই আমরা। সুস্থ–সবল সাদাসিধা এক বিচক্ষণ মানুষ মঞ্জুর মামা। হালকা গড়নের মানুষটির সদা হাস্যময় মুখের দিকে তাকিয়ে বয়স ঠাওর করা বেশ কঠিন। কিন্তু আসলে তিনি প্রায় ৬০ বছর বয়সী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসির গ্র্যাজুয়েট। যেমনটা তীক্ষ্ণèবুদ্ধিসম্পন্ন, তেমনি পরিশ্রমী। এই তো সেদিন শনিবার তাঁর বাড়িতে অনেকের মাঝে রাতের দাওয়াতে ছিলাম। প্রায় চার ঘণ্টায় বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ হলো। দুই দিন পর প্রথম আলোতে প্রকাশিত আমার লেখা ‘বরফে বাংলাদেশি প্রতিভাবানদের জাপানি ছায়া’ নিয়েও কথা হলো। এতে তাঁর কথাও আছে। ১২ ফেব্রুয়ারি বুধবার রাত ১০টায় ফোন এল অসম্ভব ভালো এই মানুষটি আর জীবিত নেই!

ফোনে মিথ্যা শুনছি না তো? মনকে বোঝাচ্ছি, এ হতেই পারে না। সপরিবারে ছুটলাম টরন্টোর সেই বাড়িতে। ততক্ষণে সেখানে আত্মীয়, বন্ধু, আর কমিউনিটির অনেক মানুষ। কিন্তু তিনি কোথায়? নিজ কর্মক্ষেত্রে অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা—গাড়ির ধাক্কায় তাঁর তৎক্ষণাৎ মৃত্যু হয়। মর্মান্তিক। নিজ পরিবারকে সীমাহীন মমতায় আগলে রাখা সচেতন এই মানুষটি প্রতিদিন কাজের বিরতিতে তাঁর স্ত্রীকে ফোন দেন। আজ সেটা হয়নি। ঘটনা ঘটে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায়। নিজ বাড়ি থেকে ঘটনাস্থল মাত্র ১৫ মিনিটের পথ। এই উন্নত দেশে। অথচ পরপারে চলে যাওয়ার এ বেদনাদায়ক খবরটি পুলিশের দল তাঁর পরিবারকে এসে জানিয়েছে তিন ঘণ্টা পরে। বাস্তবতা মেনে নিতেই হবে। কানাডাতে পুলিশ অত্যন্ত দায়িত্ব সচেতন, সব বিপদে তারা জনগণের ভরসার প্রতীক। একটি অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনায় সব প্রমাণাদি জব্দ করা শেষে পরিবারকে অতি সচেতনতায় দুঃসংবাদ দেওয়া হয়। একটি দুঃসংবাদ যেন আরও করুণ নতুন কোনো দুঃসংবাদের জন্ম না দেয়!

খুব কঠিন এ দুঃসংবাদ। মেনে নেওয়া যায় না। নিঃশব্দ আর নীরবতা কিছুক্ষণ। নিকশ কালো অন্ধকার ঘিরে ফেলল আত্মীয়–পরিজনকে। গগণবিদারী চিৎকারের শুরু। করোনায় অটোপ্সিতে আরও সময় নিল। শীতপ্রধান এই দেশে সেদিন শুক্রবারের মাইনাস ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের হাড়কাঁপানো ঠান্ডার মাঝে সন্ধ্যাবেলা হিমায়িত দেহটাকে দেওয়া হলো লাইসেন্সধারী একটি প্রতিষ্ঠানকে (টরন্টো ইসলামিক সেন্টার, নাগেট মসজিদ)। মৃতদেহ পরিবারকে দেওয়া হয় না। আত্মীয়, বন্ধু, শুভাকাঙ্ক্ষী আর কমিউনিটির সম্মানিত সদস্যদের দোয়া ও উপস্থিতিতে ১৫ ফেব্রুয়ারি সেই নাগেট মসজিদে জোহর নামাজের পর মোহাম্মদ মঞ্জুর হাসানের জানাজা শেষে এজাক্স-এর বরফে আচ্ছাদিত কবরস্থানে সমাহিত করা হয়েছে। চিরবিদায়। হাসিখুশি থাকা জ্ঞানী এই মানুষটি বড় অসময়েই চলে গেলেন। জীবনভর কষ্টের ফসল দেখা হলো না।

৪.
জীবনভর বহু কষ্টের ফসল দেখে যেতে পারেননি আমার জীবনের শিক্ষক, মা। বিদেশের মাটিতে বসে তখন ২০০৫–এ প্রথম টের পেয়েছি হৃদয়ের গহিনে স্টিমরোলার চলা তীব্র ব্যথাটা। বুক ফাটা যন্ত্রণাটা। প্রিয় মুখগুলো একে একে হারিয়ে যাচ্ছে। চলে যাওয়ার এই সারিটা দিন দিন দীর্ঘ হচ্ছে। পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে হারিয়ে গেছেন পিতৃতুল্য চাচারা, মাতৃতুল্য খালা ও ফুফুরা। বংশের মাথা প্রতাপশালী মতলেব চাচা, চেয়ারম্যান গুধা চাচা, আশরাফুল চাচাসহ অনেকে। চলে গেছেন সাদামনের মানুষ ইসরাইল স্যার।

জীবনের মৃত্যু অনিবার্য।
জীবনের মৃত্যু অনিবার্য।



স্যারের স্বনামধন্য চিকিৎসক ছেলে প্রিয় বন্ধু আব্দুল্লাহ (অর্থোপেডিক, ট্রমা ও ইলিজারোভ সার্জন) পারেননি এই বাবাকে বাঁচিয়ে রাখতে। রাশিয়ান ইলিজারোভ ফেলোশিপ ও জয়েন্ট রিপ্লেসমেন্ট ইন্ডিয়ান ফেলোশিপসহ অনেক অভিজ্ঞতা দিয়ে মেধাবী এই চিকিৎসক রোগীদের সুচিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছেন। তবে পরকালে চলে যাওয়ার সেই ডাক পড়লে কেউই আটকে রাখতে পারবেন না। তাই বাবাকেও না। হারিয়েছি অনেককে। বারবার চোখ ভিজে আসে, বড় শূন্যতা অনুভব করি।

কিছুদিন আগে প্রথম আলোতে প্রকাশিত আমেরিকার কেন্টাকি স্টেটের একটি ঘটনা শেয়ার করি। আজ থেকে আট বছর আগে ২০১২ সালে ট্রেসি তাঁর ক্যানসারে আক্রান্ত স্বামী রিচকে হারান। স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসা ছিল প্রগাঢ়। আবেগপ্রবণ মানুষ রিচ তাঁর জীবন সায়াহ্নের আগেই সুন্দর এক ব্যবস্থা করে গিয়েছেন। মৃত্যু–পরবর্তী বছরগুলোতে ট্রেসির জন্মদিনে শুভেচ্ছা আর ভালোবাসার কথাসহ ফুলের তোড়া আসে। ২৬ বছর একসঙ্গে পথচলার সেই সঙ্গী রিচের কাছ থেকে।

৫.
চলে যাওয়া প্রিয় সব মানুষগুলো আমাদের জন্য তাঁদের সব ভালোবাসা নিংড়িয়ে দিয়ে গেছেন। আমরা বেঁচে আছি। সুন্দর একটি পৃথিবী গড়ার মহান দায়িত্ব এখন আমাদের কাঁধে। নতুন প্রজন্মের জন্য। নিজ নিজ জায়গায় থেকে আপনজন আর কাছের মানুষদের মুখে হাসি ফোটাতে প্রতিনিয়ত কাজ করা দরকার। পরিবার সবার আগে। একদিন আমরাও থাকব না। জীবনের মৃত্যু অনিবার্য। প্রায় ছয় বছর বয়সে বাড়ির পেছনে ডোবার পানিতে সহোদর জামান ভাইয়ের সঙ্গে কলার ভেলা নিয়ে খেলতে গিয়ে ডুবে গিয়েছিলাম। অস্বচ্ছ সেই ঘোলা পানিতে খোঁজাখুঁজি করে উঠিয়ে এনে পেট চিপে গিলে খাওয়া সেই প্রচুর পানি বের না করলে এই গল্প লেখকের জীবন ওখানেই শেষ। এরপর আরও দুবার মৃত্যুর দুয়ার আমি দেখেছি। যে জীবন যাচ্ছে সে তো বোনাস। উপভোগ করা দরকার। ভালো কাজে। বহুকাল মানুষের হৃদয়ে বেঁচে থাকতে।

ড. সাদেকুল ইসলাম পিএইচডি: রিসার্চ সায়েন্টিস্ট, টরন্টো, কানাডা। [email protected]