সাধু সাবধান

ফারহানা আহমেদ লিসা।
ফারহানা আহমেদ লিসা।

বৃষ্টি শেষে বিশাল এক রংধনু উঁকি দিচ্ছে আকাশে। অনেক দিন পর ব্রুকলিন থেকে লং আইল্যান্ড যেতে রাস্তায় ভিড় কম। কাজে আজ অনেক কষ্ট হয়েছে। তাই রংধনু, সঙ্গে মাইলসের ‘মায়াবী আলোয় নীল দুই নয়ন, কেন যে...’ গান মনের আকাশকেও রংধনুর রঙে রাঙিয়ে দিচ্ছে আপাতত। নার্স হিসেবে সপ্তাহে চার দিন কাজ করেন শিরিন। কত রকম রোগী দেখেন তিনি। ভালো–মন্দ মিলিয়ে ১২ ঘণ্টার কাজগুলো দারুণ উপভোগ করেন। কিন্তু মাঝেমধ্যে কিছু ঘটনা মনটাকে খুব বিষণ্ন করে দেয়।

এক বছর ধরে এক রোগী আসছেন ছোট্ট একটা বাবু নিয়ে। উপসর্গগুলো অদ্ভুত। চুল পড়ে যাচ্ছে, রুচি নেই খাবারে, বিষণ্ন, দুর্বল। যে টেস্টগুলো সাধারণত করা হয় রোগ নির্ণয় করতে, সবগুলো স্বাভাবিক আসছে। ডায়াগনোসিস হচ্ছে বিষণ্নতা রোগ, ছোট বাচ্চাটা জন্মের পর থেকে এমনটা শুরু হয়েছে। অবাক করা কিছু না। কিন্তু ওই নারী বিষণ্নতার ওষুধ খেয়েও বিন্দুমাত্র উপকার পাচ্ছেন না। ঘুরে ঘুরে শুধু হাসপাতালে চলে আসছেন, শুকিয়ে যাচ্ছেন, মাঝেমধ্যে স্থান–কাল–পাত্র ভুলে যাচ্ছেন। সবাইকে বলেন, ‘আমি জীবনকে ভালোবাসি, আমার ছোট্ট মেয়েটাকে বুকের সব ভালোবাসা দিয়ে বড় করতে চাই, আমার রোগটা তোমরা ধরতে পারছ না।’

প্রায় প্রতি মাসে একই কাহিনি, রোগী ওই নারী দুর্বল থেকে দুর্বল হচ্ছেন। বিষণ্নতায় মারা যাবেন তিনি? এমন সময় একজন চিকিৎসক সন্দেহ হওয়ায় কি এক রক্তের পরীক্ষা দিলেন। কয়েক দিন পর তাঁর সন্দেহ প্রমাণিত হলো। হঠাৎ শিরীন দেখলেন রোগীর স্বামী তাঁকে দেখতে এলে গোপনে ভিডিও করছে সাদাপোশাকের পুলিশ। তারপর একদিন পুলিশ রোগীর স্বামীকে ধরে নিয়ে গেল। ঘটনা কী? সব চিকিৎসক–নার্স হতবাক। তাঁকে কেন ধরে নিয়ে গেল?

জানা গেল, ওই নারীর রক্তে কীটনাশক পাওয়া গিয়েছিল। পুলিশ নারী ও তাঁর স্বামীর অজান্তে তাঁদের বাসায় গিয়ে খুঁজে পেয়েছিল কীটনাশক। তারপর হাসপাতালের গোপন ভিডিওতে দেখেছে স্বামী নারীর অজান্তে কি জানি মিশিয়ে দিয়ে যান খাবারে। ওই খাবার পরীক্ষা করে পাওয়া গেছে কীটনাশক। পরিমাণ খুব অল্প।

পুলিশ তদন্ত শেষে জানা গেল, রোগী নারীর স্বামীর গোপন প্রেম আছে। সমাজের কাছে নিজেকে ভালো প্রমাণ করতে নারীকে কিটনাশক মিশিয়ে পাগল প্রমাণ করে বিবাহবিচ্ছেদ দেবেন। তারপর প্রেমিকাকে বিয়ে করতে কোনো বাধা নেই আর। পুলিশ জেরা করেছিল, কেন সরাসরি বিবাহবিচ্ছেদ দিতে বাধা কোথায় ছিল? রোগীর স্বামী বলেছিলেন, তাঁর মতো উচ্চশিক্ষিত লোক নিজের পদস্খলন কেন স্বীকার করবেন সমাজের কাছে?

শিরিন অনেক দিন রোগীর সেবা করেছেন। অনেক সান্ত্বনা দিয়েছেন, রোগীর কান্না দেখে অনেক বিষণ্ন হয়েছেন। কিন্তু মানুষের নিষ্ঠুরতায় হতবাক হয়েছেন আজ আবার। সারা জীবন বিছানায় পড়া রোগীর স্বামী তাঁদের সেবা করে ভালোবাসার নিদর্শন দেখিয়ে অবাক করেছেন শিরীনকে। কিন্তু আজ কোনো ভালোবাসার রং তাঁর বুকের হাহাকারকে থামাতে পারছে না। কেন এত রঙের মানুষ পৃথিবীতে?

গোধূলির মৃদু আলোয় বাসার গ্যারেজে চলে এলেন ওই রোগী। ভালোবাসা নিয়ে কেউ যেন অপেক্ষা করে আছেন তাঁর জন্য। কিন্তু সারা জীবন তিনি বুক পেতে থাকবেন তো? অপূর্ব সুন্দর সেই রোগী আর তাঁর ছোট্ট পুতুল মেয়েটার মতো কাঁদতে চান না। মানুষ যদি তার ভবিষ্যৎ দেখতে পেত। তবে সৃষ্টিকর্তা সব দেখেন, বাঁচিয়ে রাখেন তাঁর নিস্বার্থ ভালোবেসে যাওয়া অবোধ মানুষকেও।

*গল্পটা সত্য ঘটনার ছায়া অবলম্বনে।