নারী দিবসে মানুষের প্রত্যাশা

আসলে মানুষকে যোগ্য সম্মান দিলে নারী দিবসের কোনো প্রয়োজন থাকবে না। ছবি: সংগৃহীত
আসলে মানুষকে যোগ্য সম্মান দিলে নারী দিবসের কোনো প্রয়োজন থাকবে না। ছবি: সংগৃহীত

নারী দিবস উদযাপনের পেছনে রয়েছে নারী শ্রমিকের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের ইতিহাস। ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দে মজুরিবৈষম্য, কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করা, কাজের অমানবিক পরিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের রাস্তায় নেমেছিলেন সুতা কারখানার নারী শ্রমিকেরা। কিন্তু আজ একবিংশ শতাব্দীতে এসেও কি এই কোনো তাৎপর্য আছে? আসলে প্রতিদিন আমরা প্রত্যেক মানুষকে যদি তার কাজের জন্য যোগ্য সম্মান দিতে পারি, তাহলে এক দিনের জন্য বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করা এ দিনটির কোনো প্রয়োজনই থাকবে না।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো নারীর নিজের প্রতি নিজের এবং নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির ইতিবাচক পরিবর্তন। সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি, যা নারীর বোর্ডরুম থেকে করপোরেট পর্যন্ত বিস্তৃত, পরিবর্তনের জন্য করণীয় হচ্ছে সম্পত্তির অধিকার থেকে রাজনৈতিক কাঠামোতে নারীর অংশগ্রহণের অধিকার, সামাজিক অধিকার থেকে নারীর মানবাধিকার সব ক্ষেত্রেই যেন সুরক্ষিত হয় তা নিশ্চিত করা।

নারী নিজের প্রতি নিজের দৃষ্টিভঙ্গির কথা বলতে গেলে চলে আসে শৈশব থেকেই নারীর প্রতি পরিবার তথা সমাজের প্রত্যাশিত আচরণ। যেমন পরিবার থেকেই একটি কন্যাশিশুর হাতে পুতুল তুলে দিয়ে তাকে তার মনোজগতে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় যে গৃহকর্ম আর রান্নাবান্নাই তার ভবিতব্য। ছেলেশিশুর মতো বিমান দিয়ে খেলতে খেলতে তাকে মহাকাশ জয়ের স্বপ্ন দেখানো হয় না। নারীকে তার পরিবার শুধু সংসার সামলানোর শিক্ষা প্রদানের পরিবর্তে তাকে শিক্ষা দেওয়ার প্রয়োজন কীভাবে সে বিশ্ব সংসারের নেতৃত্ব দেবে।

শম্পা বণিক।
শম্পা বণিক।

নারী তুমি দুর্বল, এটা পিতৃতান্ত্রিক সমাজ কন্যাশিশুর মগজে আর মননে ঢেলে দেয়। নারীর শারীরিক শক্তি পুরুষের তুলনায় কম বলে মনে হলেও প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকার ক্ষমতা পুরুষের চেয়ে নারীর বেশি। পৃথিবীর সব দেশেই নারীর গড় আয়ু পুরুষের চেয়ে বেশি। নারীকে দুর্বল মনে করার তাই কোনো যৌক্তিক কারণ নেই।

নারীরা যদি পরনির্ভরতা কমিয়ে মানসিকভাবে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেন, তবে সেদিন নারী দিবসের আর প্রয়োজন হবে না। নারীরা কখনো বাবা, কখনো স্বামীর পরিচয়েই নিজেকে গৌরবান্বিত করে থাকেন। নিজেকে নিজের পরিচয়টি শক্তভাবে তৈরি করতে হবে, যেন আত্মমর্যাদার জায়গায় তিনি নিজেকে সম্মানের অবস্থানে রাখতে পারেন। নারীর সামাজিক নিরাপত্তা একটি তাঁর মৌলিক অধিকার। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে কর্মস্থল—সর্বস্থানেই একটি স্বাভাবিক পরিবেশ তাঁদের প্রাপ্য।

পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ২০১৯ সালে বাংলাদেশে ১ হাজার ৪১৩ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ২০১৭ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৮১৮ জন নারী। এদিকে ২০১৯ সালে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৭৬ জনকে। আর আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন ১০ জন নারী। এই ছোট্ট পরিসংখ্যানটা কি বলে দেয় না যে আমরা নারীদের কতটুকু সামাজিক নিরাপত্তা প্রদান করতে সক্ষম হচ্ছি? বিশ্বের যেসব দেশ নারীকে মানুষ হিসেবে বাঁচার নিরাপত্তাটুকু এখনো দিতে পারেনি, সেসব দেশে আসলে নারী দিবসটা হাই সোসাইটির স্ট্যাটাস সিম্বল আর টক শোর বাক্সবন্দী ঝাঁজালো বক্তৃতা ছাড়া আর কিছুই না।

বিশেষ অধিকার চাই না, চাই না কোনো বিশেষ ট্রিট। চাই শুধু মানুষ হিসেবে মানুষের হাত ধরে নিজের, পরিবার, সমাজ ও দেশের জন্য কাজ করে যেতে। তাই নারীদের জন্য প্রতিটি দিনই সমান ঠিক, যেমনটি একজন পুরুষের জন্য। কারণ, দিনের শেষে নারী-পুরুষ সবাই মানুষ। আর মাথা উঁচু করে বাঁচার অধিকার সব মানুষেরই আছে। এক দিনের জন্য নারীকে স্পেশাল না করে সারা বছর মাথা উঁচু করে বাঁচতে দেওয়ার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করাটাই রাষ্ট্র ও সমাজের কাছে সবার চাওয়া হওয়া উচিত।