সুখ-কল্পনা

মাস কয়েক আগে আমি একবার অযাচিতের মতো অন্যদের কথার মাঝে ঢুকে গিয়েছিলাম (এ রকম পরিস্থিতিতে মনে হয় কম–বেশি সবাই তাদের লাইফটাইমে অন্তত একবার হলেও পড়ে)। সেখানে বিবাহিত এক রমণী বলেছিলেন, ‘বিয়া করিস না ভাই, অনেক ঝামেলা!’ অবিবাহিত একজনের কৌতূহলী প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘হ্যাপিলি এভার আফটার বলে কিছু সংসারে নাই।’ সিনেমাতে বহুল ব্যবহৃত একটা সাধারণ কথোপকথন, যেটা বাস্তব জীবনেও ভালোই পরিলক্ষিত হয়, সেটার উদাহরণ হচ্ছে—

-আর ইউ ম্যারিড?
|-ইয়েস।
-(একটা ভুরু উঁচু করে) হ্যাপিলি ম্যারিড?
-অ্যা অ্যা অ্যা অ্যা…ইয়েস?
দুই সেকেন্ড পর: ইয়েস…

আরও দুই সেকেন্ড পর: ডেফিনেটলি…
তারও এক সেকেন্ড পর: অফকোর্স, হোয়াই নট?
যে প্রশ্ন করেছিল সে এবারে দুষ্টুমির হাসি দিয়ে, ‘আই বিলিভড ইউর ফার্স্ট ইয়েস।’
উত্তরদাতা আবারও কনফিউজড: ইয়েস?

এই ইয়েস, হ্যাঁ ইত্যাদির কাহিনি চলতে পারে আরও সেকেন্ড দশেক। দুষ্টুমির ছলে হলেও আমার সামনে আমি বেশ কয়েকজনকে এ প্রশ্নের মুখোমুখি হতে দেখেছি। একজন ছেলে ছাড়া বাকি সবাই দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে অন্তত দুই-তিন সেকেন্ড সময় নিয়েছে। এখন সেই ছেলের বিয়ের বয়স ছিল মাস তিনেক, তাই তার উত্তর সার্ভেতে নেওয়া যায় কি না, সেই যুক্তি প্রশ্নবিদ্ধ।

প্রথম প্রশ্নের উত্তর দিতে একমুহূর্তের কয়েক শ ভাগের এক ভাগ সময় লাগলেও দ্বিতীয় প্রশ্নে মানুষ কেন আটকে যায়? লেখক ও সিনেমার ডিরেক্টররা এই আটকানোতে বড্ড খুশি হন; কারণ এতে মানুষের সিদ্ধান্তকে ন্যায্য প্রতিপন্ন করা সহজ হয়, দারুণ টুইস্ট আনা যায় কাহিনিতে। কারণ, জীবনের ক্লাসিক ডাইলেমা হচ্ছে, কোনো কিছুই যুক্তিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। এমনকি খুনের মতো জঘন্য অপরাধ নিয়েও তর্কের অবকাশ থাকে, সে কী নিজেকে বাঁচাতে গিয়ে খুন করতে বাধ্য হয়নি? এখন তা হতেই পারে। এ রকম উদাহরণ অতীতে যথেষ্ট আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। তবে যেই শব্দটির কারণে সবচেয়ে বেশি আমরা যন্ত্রণায় থাকি, সেটা হচ্ছে ‘সুখ’। আমার ধারণা, মানবজাতির জিনের মাঝে প্রোথিত হয়ে আছে বেঁচে থাকার অন্তত একটি লক্ষ্য, আর সেটা হচ্ছে সুখী জীবন প্রাপ্তি। তবে কালে কালে এবং যুগে যুগে সুখের সংজ্ঞা বদলেছে এবং বদলাচ্ছে, এটাই হচ্ছে পার্থক্যটা।

ডক্টর রাস হ্যারিস ‘হ্যাপিনেস ট্রাপ’ বইটি শুরু করেছিলেন কিছু বহুল প্রচলিত বিশ্বাসের প্রতি আঙুল তুলে, যেটা আদতে কল্পকথা কিংবা পুরাকথা ছাড়া কিছুই না। প্রথম বিশ্বাস: সুখ মানবজীবনের একটি স্বাভাবিক অবস্থা। আরেকটি বিশ্বাস: তোমার অবশ্যই নিজস্ব চিন্তা এবং অনুভূতির ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকবে, না থাকলে তোমার সমস্যা আছে। এখন ঝামেলাটা হচ্ছে, মানবজাতি কাগজে–কলমে মেশিন হলেও আদতে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের অস্তিত্ব। একেবারে সোনার চামচ মুখে এবং সোনার জুতা পরে জীবনে হেঁটে চলে বেড়ানো মানুষও কষ্ট পাবে, কিছু একটাতে দুর্বল থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। কারণ আর কিছু হোক না হোক, আমরা সবাই জরার কাছে কাবু। জরাকে এড়ানোর কোনো উপায় অতিসত্বর বের হবে এ রকম সম্ভাবনাও দেখি না। তাহলে প্রথম বিশ্বাসের সত্য হওয়ার উপায় কী? আর পরের প্রশ্ন হচ্ছে–সুখটা আসলে কী?

এ দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর প্রচুর ফিলোসফার এবং ধর্মীয় ব্যক্তি আগেই দিয়ে গেছেন, ‘এটি সত্তার স্বতন্ত্র চিন্তা।’ অর্থাৎ প্রতিটি ব্যক্তির সুখের সংজ্ঞা আলাদা। এই জায়গাটাতেই আমরা মার খেয়ে যাচ্ছি বলে আমার মনে হয়। আমি, আমরা, সবাই। বর্তমানে আমরা কেউ ব্যক্তিসত্তার সুখের সংজ্ঞায় বিশ্বাসী নই, আমরা বিশ্বাসী সামাজিক সংজ্ঞায়। সেই আদ্যিকালে কৃষিজীবী সমাজে আবহাওয়ার বৈরূপতার কারণে যখন শুধু তিন বেলা খাওয়াকে সুখ ধরা হতো, সেই সংজ্ঞা থেকে আমরা আজও বের হতে পারিনি। সেই সূত্র ধরেই শিল্পায়নের যুগে অর্থ এবং বর্তমান যুগে অর্থোপার্জনের হাতিয়ার শিক্ষা। আর সামাজিক সংজ্ঞার মূল সমস্যা? সেই সংজ্ঞার প্রতিটি ধাপ পূরণ করার নির্ণায়ক হচ্ছে একটি মাত্র উপায় তুলনা।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে একজন ব্যক্তি সুখী কি না, সেই সিদ্ধান্ত তাকে নিতে হয় সমাজে তার গণ্ডির মানুষজনের সঙ্গে নিজেকে তুলনা করে। ছেলে পরীক্ষায় অঙ্কে নব্বই পেয়েছে, বাড়ির সবার মন খারাপ। কারণ, পাশের বাড়ির ছেলে পঁচানব্বই এবং ওপরের তলার মেয়ে পেয়েছে আটানব্বই। নব্বই পাওয়া ছেলে ভুগছে হীনম্মন্যতায় আর আটানব্বই পাওয়া মেয়ে আতঙ্কে সেই রাত্তিরেই পড়তে বসেছে, পাছে কেউ তার স্থান দখল করে নেয়। কারণ, তুলনাপ্রধান জগতের প্রসিদ্ধ সূত্র হচ্ছে, ততক্ষণই তুমি অনন্য, যতক্ষণ অন্য কেউ সেটা করতে পারছে না, অন্য কেউ সেটা করামাত্র সেটা সাধারণ। এটা একটা ছোট্ট উদাহরণ মাত্র। এবার এটা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে দেখুন তো কিছু মেলে কি না—বেড়ে ওঠা, শিক্ষা, চাকরি, বিবাহ, সংসার ইত্যাদি।

যেটা বলার চেষ্টা করছি, সেটা হচ্ছে, শুধু ‘ম্যারিড’ শব্দটির সামনে নয়, যেকোনো শব্দের সামনে ‘হ্যাপিলি’ শব্দটি যুক্ত করলেই সবাই সত্য উত্তরটা কী হবে, সেটা নিয়ে হকচকিয়ে যায়।
-এমপ্লয়েড?
-ইয়েস।
-হ্যাপিলি এমপ্লয়েড?
-আ আ আ, ওয়েল…

কিংবা,
-দারুণ হলিডে করে ফিরলেন!
-হ্যাঁ, দারুণ! খুব সুন্দর সময় কেটেছে।
-হুমম, মাঝে একটা ক্লাস টেস্ট হয়ে গেছে, আপনার মেয়ে তো মিস করল। ফাইনালে কিন্তু মার্কস যোগ হবে।
-কীহ! ওহ নো, কেন যে গেলাম!

আমরা একই সঙ্গে সবকিছু অর্জনের জন্য দৌড়ে যাচ্ছি এবং আশা করে যাচ্ছি প্রতিটা ক্ষেত্রে আমাদের থাকবে গালভরা হাসি আর বুকভরা আনন্দ। কারণ, সমাজ বলছে সেটিই স্বাভাবিক, অন্য সবাই কি এই করেই আনন্দে নেই?

সময় ও স্রোতের বিপরীতে দাঁড়ানো ভয়ংকর কঠিন কাজ। কারণ, আমরা নিজস্ব গণ্ডির বাইরের কার্যকলাপকে সন্দেহের চোখে দেখি এবং নতুন যেকোনো কিছুকে বিচার-বিবেচনা ছাড়াই ‘না’ বলতে পছন্দ করি। তারপরও মনে হয় একটু নিজস্ব স্বাচ্ছন্দ্য বলয়ের বাইরে গিয়ে অন্যের নেওয়া সিদ্ধান্তের পেছনের যুক্তিগুলো শোনা দরকার। যতক্ষণ পর্যন্ত সেটা নৈতিকতা অথবা ন্যায়ের পরিপন্থী না হচ্ছে এবং কারও ক্ষতির কারণ না হচ্ছে, ততক্ষণ পছন্দ না হলেও ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে তার সিদ্ধান্তকে স্বীকৃতি দেওয়ার চেষ্টা করা উচিত। তাহলে একজনের ‘সুখ’ কখনো আরেকজনের অসুখের কারণ হয়ে দাঁড়াবে না। সফলতা আর সন্তোষ এই দুইয়ের মাঝে যোগসাজশ ঘটিয়ে একটা শান্তিপূর্ণ জীবন প্রাপ্তির সম্ভাবনা তখনই বাড়বে, যখন একজন ব্যক্তি নিজে তার সুখের সংজ্ঞা রচনা করবে।

এমন একটা সমাজ হলে কী দারুণই না হবে, যেখানে কারণ ছাড়া কেউ অযাচিত সমালোচনা কিংবা কটাক্ষের শিকার হবে না! যেখানে তুলনা নয়, ব্যক্তির ইচ্ছাতেই নির্ধারিত হবে তার সুখের চিত্র। যেখানে প্রত্যেকে নিজস্ব সীমাবদ্ধতাকে তাদের অসুখের কারণ নয়, বরং জীবনের স্বাভাবিক অংশ বলে জ্ঞাপন করবে। আমার মনে হয় এটাকেই বলে সত্যিকারের সুখ-কল্পনা।