করোনা নিয়ন্ত্রণে সচেতনতার বিকল্প নেই, অভিজ্ঞতা দক্ষিণ কোরিয়া

চীনে কোভিড-১৯ ভাইরাস আক্রান্তের সঙ্গে সঙ্গে জনসাধারণকে সচেতন করতে প্রচারের কোনো কমতি রাখেনি দক্ষিণ কোরিয়া। রাস্তাঘাটে বড় বড় বিলবোর্ড কিংবা প্ল্যাকার্ডে প্রচারের কমতি নেই দেশটিতে। ছবি: লেখক
চীনে কোভিড-১৯ ভাইরাস আক্রান্তের সঙ্গে সঙ্গে জনসাধারণকে সচেতন করতে প্রচারের কোনো কমতি রাখেনি দক্ষিণ কোরিয়া। রাস্তাঘাটে বড় বড় বিলবোর্ড কিংবা প্ল্যাকার্ডে প্রচারের কমতি নেই দেশটিতে। ছবি: লেখক

কোভিড-১৯ নিয়ে প্যানিক নয়, চাই সচেতনতা। কয়েক দিন আগে IEDCR কনফার্ম করেছে যে বাংলাদেশে করোনা আক্রান্ত ৩ জন রোগী পাওয়া গেছে। পরে তারা জানিয়েছে, বাংলাদেশে করোনা আক্রান্ত আর কেউ নেই। বিষয়টি চিন্তার বটে কিন্তু তার সঙ্গে জনসাধারণের মাঝে বাড়ছে ভয় আর আতঙ্ক। কিন্তু সবার আগে যে জিনিসটি প্রয়োজন, জনসাধারণের মাঝে সচেতনতা তৈরি, সেটাতেই মনে হয় অনেক পিছিয়ে আছি আমরা।

করোনা প্রতিরোধে দেশে দেশে সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন প্রয়োজন। সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরের সবার প্রস্তুতি। প্রাথমিক পর্যায়ে প্রয়োজন জনসচেতনতা তৈরি করা। সঙ্গে সরকারি পর্যায়ে স্থল, নৌ ও বিমানবন্দরে কঠোর তদারকি দরকার।

বিশ্বে সফলতার সঙ্গে করোনাভাইরাস মোকাবিলায় দক্ষিণ কোরিয়া অন্যতম উদাহরণ। চায়নায় কোভিড-১৯ ভাইরাস আক্রান্তের সঙ্গে সঙ্গে এখানে ভাইরাস প্রতিরোধে জনসাধারণকে সচেতন করতে প্রচারের কোনো কমতি ছিল না। বাস কিংবা মেট্রো সব যানবাহনে কিছুক্ষণ পরপর কোরিয়ান ও ইংরেজিতে বেজে উঠত করোনা প্রতিরোধে সাবধানতা। এমনকি রাস্তাঘাটে বড় বড় বিলবোর্ড কিংবা প্ল্যাকার্ডে প্রচারের কমতি ছিল না। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি দেগু সিটির শিনশিওঞ্জি চার্চের হাজারো মানুষের জনসমাগমে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ার প্রমাণ পাওয়া গেল, মানুষ তখন অক্ষরে অক্ষরে সরকারের নির্দেশনা ফলো করতে লাগল। যেকোনো জনসমাবেশ নিষিদ্ধ করা হলো। ধর্মালয়গুলো বন্ধ রাখার অনুরোধ করা হলো। খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া মানুষকে বাড়ির বাইরে আসতে নিরুৎসাহিত করা হলো। সর্বাধুনিক টেলিপ্রযুক্তির সাহায্যে সম্ভাব্য রোগীদের ট্রেকিং করে ভাইরাস টেস্টের আওতায় নিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে, যারা ভাইরাসে পজিটিভ হয়েছেন, তাঁদের মুভমেন্ট জনসাধারণকে জানিয়ে দেওয়া হচ্ছিল কোরিয়া সরকারের পক্ষ থেকে, যেন মানুষ সচেতন হতে পারে। প্রেসিডেন্ট মুন ঘোষণা দিলেন জনসাধারণকে সঙ্গে নিয়ে ভাইরাস নিয়ন্ত্রণের!

কোভিড-১৯–এর যেহেতু এখন পর্যন্ত কোনো প্রতিরোধক কিংবা প্রতিষেধক নেই, তাই নিজেকে নিরাপদ রাখতে সচেতনতার বিকল্প নেই। ভাইরাস নিয়ে চায়না এখন সফল, সংক্রমণের সংখ্যা তারা সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে এনেছে। কোরিয়াতেও তর তর করে নামছে আক্রান্তের সংখ্যা। হয়তো কয়েক দিনের মধ্যেই পুরো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। তাই নিশ্চিত করেই বলা যায়, পৃথিবী থেকে এই অমানিশা কেটে যাবে। প্রয়োজন শুধু সচেতনতার। শিশু ও তরুণদের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই ভাইরাসটি মাইল্ড সিম্পটম দেখায়। ঝুঁকিতে আছেন বৃদ্ধ ও অসুস্থ মানুষেরা। দক্ষিণ কোরিয়াতে ৩০ বছরের নিচে এখন পর্যন্ত কেউ মারা যাননি। ৩৪ বছর বয়স্ক লিভার ট্রান্সপ্লান্টের একজন রোগী শুধু মারা গেছেন। আর যাঁরা মারা গেছেন সবার বয়সই ষাটের কাছাকাছি কিংবা ষাটোর্ধ্ব।

পরিবারের সঙ্গে লেখক। ছবি: সংগৃহীত
পরিবারের সঙ্গে লেখক। ছবি: সংগৃহীত

কীভাবে চলছি কোরিয়ায়
করোনা আক্রান্ত দক্ষিণ কোরিয়ায় আমাদের ল্যাব ঠিক আগের মতোই চলছে তবে মানতে হচ্ছে বাড়তি কিছু সতর্কতা। প্রায় ৯৯ শতাংশ মানুষ বাড়ির বাইরে মাস্ক ব্যবহার করছে, এমনকি মাস্ক ব্যবহার না করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়িতে ওঠার কোনো অনুমতি নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিল্ডিংগুলোতে সাইড দরজা বন্ধ রেখে শুধু মেইন দরজা খোলা রাখা হয়েছে। দরজার সামনেই হ্যান্ড স্যানিটাইজারের বোতল রাখা আছে আর নোটিশে অনুরোধ করা হয়েছে, স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ভালোভাবে পরিষ্কার করে বিল্ডিংয়ে প্রবেশের। প্রতিদিন অন্তত একবার পুরো বিল্ডিংকে ফোগার মেশিনে স্যানিটাইজ করা হচ্ছে। অন্যের সঙ্গে কথা বলতে গেলে অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার করতে হবে, কারণ ভাইরাসটি বায়ুবাহিত না হলেও মুখের ড্রপলেটের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, তাই মাস্ক ব্যবহারে এই ড্রপলেট ছড়িয়ে পড়াকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, সঙ্গে রোগের ট্রান্সমিশনও! ল্যাবে ৭০ শতাংশ ইথানল ব্যবহার করছি সর্বদা নিজেকে স্যানিটাইজ রাখার জন্য। বাসায় কমার্শিয়াল হ্যান্ড স্যানিটাইজার।

আমাদের দেশে যা প্রয়োজন
বাড়ির বাইরে সর্বদা মাস্কের ব্যবহার, পারসোনাল হাইজিন মেইনটেইন করাটা খুবই জরুরি। হাচি-কাশিতে সর্বদা টিস্যু ব্যবহার, ভালোভাবে হাত না ধুয়ে নাক, মুখ কিংবা চোখের স্পর্শ থেকে বিরত থাকুন। যেখানে-সেখানে থুতু ফেলা থেকে বিরত থাকার পাশাপাশি সর্বদা হালকা উষ্ণ পানি পান করুন। নিয়মিত ভিটামিন সি ও সবুজ শাকসবজি খাওয়া জরুরি। এগুলো ইমিউনিটি বাড়াতে সাহায্য করবে। সোশ্যাল ডিস্টেন্সিং ও স্যানিটাইজেশন এই রোগের প্রতিরোধের অন্যতম উপায়। তাই প্যানিক না ছড়িয়ে সচেতন হওয়াটা জরুরি। মনে রাখবেন প্যানিক হলেই মানুষের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাও কমে যায়!