কিছু করোনা-কথা

ছবি: রয়টার্স
ছবি: রয়টার্স

১. 

দাবা খেলা শেষ করে এক বন্ধু আরেক বন্ধু কে বলল: আচ্ছা, তোকে আমি দাবার বোর্ডের প্রতিটা ছকের জন্য এক কোটি টাকা করে দেব। শুধু একটাই শর্ত।
অন্য বন্ধু: কী শর্ত?
প্রথম বন্ধু: তুই আমাকে প্রথম ছকের জন্য দিবি এক পয়সা। তারপর দ্বিতীয় ছকের জন্য দুই পয়সা, তৃতীয়র জন্য চার পয়সা, চতুর্থর জন্য আট পয়সা, এমন করে ৬৪টা ছক পর্যন্ত চলতে থাকবে।
দ্বিতীয় বন্ধু: বলিস কী? অবশ্যই!
প্রথম বন্ধু: সত্যি তো? ভেবেচিন্তে বল।
দ্বিতীয় বন্ধু: আরে কী আর ভাবব? দে আমাকে ৬৪ কোটি টাকা। আমি ভাঙিয়ে তোর পয়সা দিয়ে দেব।
প্রথম বন্ধু: আরে বন্ধু, অত সহজ না। তোর কাছে আমার পাওনা ১ হাজার ৮০০ কোটি কোটি টাকা, যা দেশের জিডিপির প্রায় নয় হাজার গুণ।

২.
আমাদের মস্তিষ্ক এক্সপোনেনশিয়াল গ্রোথ বুঝতে চায় না। এক, তারপর দুই, তারপর চার দেখে মনে হয়, ও এ তো এক হাতে গোনা যায়। তারপর ধাই করে যখন ৫০০ হয়ে যায় ১০০০ তারপর ২০০০ আর ৪০০০, তখন চমক লাগে।

কোভিড-১৯ বা করোনাভাইরাস হলো এক্সপোনেনশিয়াল গ্রোথের খেলা। এক ছক থেকে অন্য ছক, মানে দ্বিগুণ হতে সময় লাগে কয়েক দিন, এই যা। প্রথম প্রথম যখন চীনের উহানে এই ভাইরাস ধরা পড়ে, তখন সে দেশের হর্তাকর্তারা ডাক্তারদের বেয়াদবি লাইনে আনা নিয়েই বেশি ব্যস্ত ছিলেন। কিন্তু জিন প্রদীপের থেকে একবার বেরিয়ে যাওয়ার পর এখন চীন থেকে ইতালি, ইরান থেকে স্পেন, এসব দেশ সবকিছু বাদ দিয়ে ‘করোনাময়ের’ কৃপা চাইছে।

বিভিন্ন দেশের কেস সংখ্যার দিকে তাকালে বোঝা যায়, যে প্রতিটি দেশেই এই মহামারি প্রথমে প্রথমে একই ভাবে এগিয়েছে। যেমন বলা হয়, স্পেন হয়তো ইতালির থেকে কয়েক দিন পিছিয়ে আছে, যুক্তরাজ্য স্পেনের থেকে কিছুদিন পিছিয়ে ইত্যাদি। কিন্তু একবার ধরা পড়ার পর ভূত আর বোতলে ঢোকানো খুবই মুশকিল। কাজেই আমরাও একি দিকে এগোচ্ছি।

বুদ্ধিমানে দেখে শেখে, আর বলদে ঠেকেও শেখে না। আমরা দ্বিতীয় বন্ধুর মতো অন্ধ হয়ে থাকব, নাকি প্রথম বন্ধুর মতো বিবেচনাবোধ চর্চা করতে পারব, সেই প্রশ্নই এখন আমাদের সামনে। সমাজের সব কাতারে আমাদের প্রস্তুতি জোরেশোরে এগিয়ে নিতে হবে—এর কোনো বিকল্প নেই।

৩.
তা কেন সেটা আরেকটু ভেঙে দেখা যাক:
–যতগুলো কেস এখন পর্যন্ত ধরা পড়েছে, সেগুলোই যে আসল কেসের মোট সংখ্যা, সেটা মনে করাটা ভুল হবে। শনাক্তকরণ পরীক্ষা খুবই সীমিত, তাই আসল কেস তারও অনেক বেশি হওয়াটাই স্বাভাবিক।
-তার মানে করোনাভাইরাস এই মুহূর্তে বাংলাদেশে ছড়াচ্ছে।
-অনেকেই হয়তো বাইরে বেরোনো কমানো শুরু করেছেন, কিন্তু তারপরও আমাদের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশে ভিড়ভাট্টার মধ্যে, বাসে বা দোকানে বা জনসমাগমস্থল থেকে এই ভাইরাস অনেক মানুষের মাঝে ছড়াতে পারে। দক্ষিণ কোরিয়ায় মাত্র একটি চার্চ থেকে প্রায় দুই হাজার লোকের মধ্যে ছড়ায় করোনাভাইরাস!
-গুরুতর অসুস্থতা দেখা দিতে সংক্রমণের পরে এক-দুই সপ্তাহ পর্যন্তও লাগতে পারে, তার মানে সঙ্গে সঙ্গে এর পুরো বিস্তার বোঝা কঠিন। এবং যেহেতু কারও কারও শুধু মৃদু লক্ষণ দেখা দিতে পারে, তারা না বুঝেই এটা আরও বেশি মানুষের মাঝে ছড়াতে পারে।
-যখন এটা আরও বেশি মানুষের মাঝে ছড়িয়ে যাবে এবং সেটা যখন আমরা সবাই বুঝে উঠব, ততক্ষণে খেলা শেষ। তখন সেটাকে সামলানো অসম্ভব কঠিন। যখন অনেক মানুষ একসঙ্গে অসুস্থ হয়, তখন হাসপাতাল ব্যবস্থা বা স্বাস্থ্য খাতের জন্য কুলিয়ে ওঠা সম্ভব না, তাই মানুষ চিকিৎসা না পেয়ে তখন মারা পড়তে পারে। এটাই উহান ও ইতালির সবচেয়ে ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। তাই আমরা করোনাভাইরাসের সংক্রমণের হার যতটাই কমিয়ে আনতে পারি, তত বেশি জীবন রক্ষা করা যাবে।
-এখনই সবচেয়ে ভালো সময় জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণ করার। সরকারের পক্ষ থেকে এবং আমাদের সবার পক্ষেই সম্ভব আমাদের নিজেদের পরিবারে, কাজে, পাড়ায়, সকলকে সচেতন করা, বিচক্ষণ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

৪.
-নিয়মিত হাত ধোয়া শুনলে মনে হয় খুবই সাধারণ ব্যাপার, কিন্তু এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসি অনুযায়ী ২০ সেকেন্ড ভালো করে সাবান দিয়ে হাতের এপিঠ–ওপিঠ ধোয়া উচিত।
-কেউ অসুস্থ হলে, এমনকি মৃদু লক্ষণ দেখা দিলে, অবশ্যই ঘরে থাকার যথাসাধ্য চেষ্টা করা উচিত।
-বয়স্ক বা অন্য কারও যদি ভালো স্বাস্থ্য না থাকে, তাঁরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে, কাজেই তাঁদের জন্য কিছুদিন সামাজিক সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকাটাই মঙ্গল।
-ভিড়ভাট্টাতে অনেক মানুষের সংস্পর্শে আসাটা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ, তাই তা যথাসম্ভব এড়িয়ে চলা উচিত।
-অহেতুক সংস্পর্শ যেমন হাত মেলানো বা জড়িয়ে ধরা ইত্যাদি এড়িয়ে চলা এবং একে ওপরের মধ্যে কিছু দূরত্ব বজায় রাখা ভালো।
-অনেক জায়গায় অনেক ভুল তথ্য ছড়ানো হচ্ছে, তাই যেকোনো তথ্য শেয়ার করার আগে তা যাচিয়ে নেওয়া টা অবশ্যই প্রয়োজন। স্বাস্থ্যগত ভুল তথ্য অন্যের ক্ষতি বয়ে আনতে পারে—আমাদের সবারই সতর্ক হওয়া উচিত।
-সংস্পর্শ থেকে সংক্রমণ হতে পারে, তার মানে এই না যে সামাজিক যোগাযোগ বন্ধ করে দিতে হবে। প্রযুক্তির কল্যাণে আমাদের সবার পক্ষেই সম্ভব একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা, বিশেষ করে আমাদের পরিবারের বয়স্কদের সঙ্গে, যাঁরা হয়তো নিঃসঙ্গ বোধ করতে পারেন। নিঃসঙ্গতা থেকেই বিষণ্নতা তৈরি হয় এবং গবেষণায় দেখা গেছে তার ফলে স্বাস্থ্যেরও ক্ষতি হয়।
-যখন ঘরবন্দী হয়ে থাকতে হয় বা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়, তখন সহজেই আমরা একে অপরের প্রতি খারাপ ব্যবহারের মাধ্যমে তা ‘ঝেড়ে নিতে’ পারি। কিন্তু সেটা না করে যদি আমরা কঠিন সময়ে একে অপরের পাশে দাঁড়াই এবং একসঙ্গে এর মোকাবিলা করি, তাহলে কেমন হয়?

৫.
সারা বিশ্ব এখন করোনাভীতির থাবায়। প্রিয়জনের মৃত্যু, জীবিকা হারানো, বছরের পরিকল্পনা মাঠে মারা। থমথমে ভাব চারদিকে। এমন বৈশ্বিক মহামারি অত্যন্ত বিরল ঘটনা। কিন্তু সবকিছুর মতো এও স্বল্পকালীন। এ পর্ব থেকে মানবজাতি কি শিক্ষা নেবে? করোনাভাইরাস ধর্ম, জাতি, গোত্র বোঝে না। প্রকৃতি কি লালন রূপে আমাদেরকে কিছু বলতে চাইছে? হানাহানি কাটাকাটি করে এই ছোট্ট পৃথিবীতে ৮০০ কোটি মানুষ একসঙ্গে বাঁচতে পারবে না। একবিংশ শতাব্দীতে একসঙ্গে বাঁচার একটাই পথ—একে অপরের খেয়াল রাখা, পরিবেশের যত্ন নেওয়া, যুদ্ধবিগ্রহ ভুলে গিয়ে শান্তির কঠিন কাজে একসঙ্গে হাত দেওয়া, পাড়ার বা দেশের বা বিশ্বের যৌথ চ্যালেঞ্জগুলো মিলেমিশে মোকাবিলা করা। এমন সমাজ কবে গো সৃজন হবে?

*লেখক: তরুণ সমাজকর্মী, উদ্যোক্তা ও লেখক