করোনায় নতুন দৃষ্টিভঙ্গি

সুপার মার্কেটে সবজি ও ফলের শূন্য র‌্যাক। ছবি: লেখক
সুপার মার্কেটে সবজি ও ফলের শূন্য র‌্যাক। ছবি: লেখক

সারা বিশ্ব আজ করোনাভাইরাস নিয়ে দিশাহারা। কী হবে, কীভাবে এর প্রতিকার হবে, কত দিনে এর শেষ, তা কেউ জানে না। চারদিকে শুধু একটা অনিশ্চয়তা, ভয় ও আতঙ্ক। স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ, ইভেন্টগুলো বাতিল, দেশে দেশে সীমান্ত বন্ধ! যেন বিশ্বজুড়ে করোনাকে নিয়ে চলছে নতুন এক মহাযুদ্ধ!

আমরা একটি জরুরি অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। এই ভাইরাস অনেকের জীবন কেড়ে নিয়েছে। সবার প্রতি সহানুভূতি ও সম্মান দিয়ে আজ করোনাকে নিয়ে একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি আনতে চাই। পরিস্থিতির গুরুত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য নয়, সংকটকে মোকাবিলায় ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করাই এর উদ্দেশ্য। যে বিষয়গুলো আমরা ইতিবাচকভাবে দেখতে পারি—

১. নিজের যত্ন নেওয়া ও পরের প্রতি খেয়াল রাখা শিক্ষা
আমরা এখন প্রতিদিন বারবার হাত ধুচ্ছি, নিজের স্বাস্থ্য রক্ষা করার কথা ভাবছি, কিন্তু এই বিষয়গুলো আমরা এখনকার মতো করে আগে ভাবিনি। করোনা সংকটে অনেক কিছুই আমাদের নতুন করে ভাবাচ্ছে। যাতে করে আমরা আগের চেয়ে অনেক বেশি সাবধান হচ্ছি আর আসতে আসতে এটা আমাদের দৈনন্দিন অভ্যাসে পরিণত হচ্ছে।

যা করছি তা শুধু আমাদের নিজেদের জন্যই করছি না, তা অন্যদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য সহায়ক হচ্ছে। এই বিষয়টি এই মুহূর্তে যেমন প্রয়োজনীয়, আগামীর জন্যও অতি জরুরি।

২. আমরা ভয়কে জয় করার শিক্ষা নিচ্ছি
করোনার ভয় থেকে অভিজ্ঞতা নেওয়ার একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছে। আমাদের অনাহারের ভয় আছে, আছে মৃত্যুর ভয়, পরাধীনতার ভয়, নিয়ন্ত্রণ হারানোর ভয়। এই ভয়গুলো আমাদের মধ্যে বিদ্যমান এবং চিরসত্য, কিন্তু যতক্ষণ না কোনো কিছু আমাদের হুমকির মুখে ফেলে, ততক্ষণ এইগুলো আমরা লক্ষ্য করি না। করোনা আমাদের মৃত্যুভয় দেখিয়েছে। এর কোনো প্রতিষেধক নেই, আমরা জানি না কীভাবে এর থেকে রক্ষা পাব। কিন্তু আমরা শিখেছি ভয় না করে এগিয়ে যেতে। করোনা আমাদের প্রকৃতির সঙ্গে, বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ককে নতুন করে কীভাবে আঁকা যায় তা শিক্ষা দিচ্ছে। সবকিছু আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই, কখনো ছিল না, কিন্তু নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে আমরা করছি নিজেকে রক্ষা। শিক্ষা নিচ্ছি অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা অর্জন করা। আমরা আমাদের আশঙ্কা ছাড়িয়ে নিজেদের শক্তিতে ফিরে যেতে পারছি। আতঙ্কে নিজেকে হারিয়ে না ফেলে নিজেই নিজেকে সুরক্ষা শিখছি?

৩. আমরা প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোয় ফোকাস করা শিখছি
হঠাৎ করেই আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা থমকে গেছে। আমরা আমাদের স্বাস্থ্যকে রক্ষা ও আমাদের জীবন নিয়ে খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছি। সবাই যেন একটা হতাশায় ভুগতে শুরু করেছে, কারণ এ ধরনের অভিজ্ঞতা এর আগে আমাদের ছিল না। হঠাৎ একটি নতুন পরিস্থিতি আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে এবং এই পরিস্থিতিতে আমাদের কী করতে হবে, সেটা আমরা এখন ভাবছি আর জীবনে কোনো জিনিসটা বেশি মূল্যবান, সেটা অনুধাবন করতে পারছি। এই সংকট আমাদের শিক্ষা দিচ্ছে জীবন ধরনের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসের বাইরে অন্য জিনিসগুলো অনেক আপেক্ষিক।

৪. বসুন্ধরা এখন নিশ্বাস নিতে পারছে
আমাদের পৃথিবী বা মা বসুন্ধরাকে বাঁচাতে জলবায়ু সুরক্ষা আন্দোলন চলছে কয়েক দশক ধরে। তারপরও জলবায়ু রক্ষার জন্য সব নিয়ম পালনে আমরা একমত হতে পারিনি। অথচ করোনা সংকটের কারণে এই কয়েক সপ্তাহের মধ্যে চীন থেকে শুরু করে ইউরোপ–আমেরিকা সর্বত্র দ্রুত আইন ও নতুন নতুন নিয়ম চালু করা হচ্ছে। বিমান চলা স্থবির হয়েছে। মানুষ বাস–ট্রামে না চড়ে, হাঁটাপথ নিচ্ছে বা সাইকেল চালাচ্ছে। পৃথিবী যেন সত্যি সত্যি নিশ্বাস নিতে পারছে।

৫. বিশ্বায়ন ও পারস্পরিক অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা
সারা বিশ্ব এখন সামাজিক ও অর্থনৈতিক সব বিষয় নিয়ে কমবেশি পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত। চীনে ঘটে যাওয়া ঘটনা এখন অন্যত্র প্রভাবিত হচ্ছে এবং ব্যাপক আকার ধারণ করছে। করোনার মতো একটি ধাক্কা বিশ্ব অর্থনীতিকে ছোবল মারছে। এখন বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে আমাদের সবার সমঝোতা দরকার।

৬. প্রবল ইচ্ছাশক্তি আমাদের লক্ষ্য অর্জনের পথ দেখায়
করোনা বিরাজ আমাদের বিশ্বে প্রমাণ করল, আমাদের প্রবল ইচ্ছাশক্তি থাকলে আমরা অনেক কিছুই জয় করতে পারি। যদিও আমরা এখনো করোনাভাইরাসকে জয় করতে পারিনি, তবু সম্ভাব্য বিপদগুলো থেকে রক্ষার জন্য বিশ্বজুড়ে মানুষ অনেক কিছুই মেনে চলছে। তার অর্থ হলো আমরা চাইলেই এই বিশ্বের সমাজব্যবস্থার অনেক কিছু পরিবর্তন ঘটাতে পারি এবং আমরা একই লক্ষ্যে একসঙ্গে কাজ করতে পারি।

ব্যক্তিগতভাবে আমার জন্য করোনা হলো জীবনকে নতুন করে ভাবার একটি সুযোগ। এই সংকটের মুখে আমরা যে পরিবর্তনগুলো আমাদের জীবনে আনছি, সেগুলো সামাজিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রেও ব্যবহার করতে পারি।

আমরা এখন এমন একপর্যায়ে পৌঁছেছি, যেখানে আমাদের নিজেকেই জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো বেছে নিতে হবে।