কোভিড-১৯ এবং হাসপাতালের দিনগুলো

ফারহানা আহমেদ লিসা।
ফারহানা আহমেদ লিসা।

সান দিয়াগো শহরের একটি হাসপাতালে কাজ করি আমি। ভয়াবহ ছোঁয়াচে এবং প্রাণসংহারী এই নভেল করোনাভাইরাস বহু মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছে পৃথিবীতে। প্রতিনিয়ত গাইডলাইন বদলে যাচ্ছে, কীভাবে এই মহামারি থেকে মানুষকে বাঁচিয়ে রাখা যায়।

কমান্ড সেন্টার (ইনফেকশাস ডিজিজের ডাক্তার, ডিপার্টমেন্ট অব পাবলিক হেলথ) কাজ করে চলেছে ২৪ ঘণ্টা। কিন্তু বাস্তবতা খুব কঠিন। পৃথিবীর অনেক দেশে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে এ রোগ। বহু মানুষ মারা গেছে এবং আরও যাবে, যদি সতর্ক না হন।

এই ভাইরাস বেঁচে থাকতে পারে কোনো সারফেসে ৯ দিন পর্যন্ত, আক্রান্ত রোগী নিজের অজান্তে ছড়াতে পারেন এ ভাইরাস দুই সপ্তাহ পর্যন্ত। অনেকেরই এ রোগের কোনো লক্ষণ থাকে না। সান দিয়াগো এখন স্কুল–কলেজ বন্ধ, ১০ জনের বেশি লোকসমাগম নিষেধ করা হয়েছে। নিতান্ত প্রয়োজন ব্যতিরেকে কেউ বাইরে যাচ্ছে না।

আমাদের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশে এ সতর্কতা অনেক বেশি জরুরি। ষাটোর্ধ মানুষ বা যাঁদের ফুসফুসের রোগ, হার্টের রোগ, ডায়াবেটিস, ক্যানসার রোগী যাঁরা কেমোথেরাপি পাচ্ছেন, তাঁরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছেন। আমরা কক্সবাজার, রাঙামাটি ঘোরাঘুরি না করে বরং বাসায় থাকি। আমাদের দেশ তো দূরে থাক, এসব দেশে ভয়াবহ শ্বাসকষ্ট হলে যে ব্রিদিং মেশিন সাপোর্ট দেবে, সে মেশিনের অপ্রতুলটা দেখা দিচ্ছে। মহামারির জন্য কেউ তৈরি নয়। তাই রোগ ছড়ানোর আগে সচেতন হয়ে যাই যেন আমরা।

আমাদের হাসপাতাল কোনো রোগীর জন্য ভিজিটর অ্যালাউড নয়। কাজেই বলা হচ্ছে, স্ক্রাব পরে কাজ করে পরে কাপড় বদলে বাসায় আসতে। সন্দেহজনক রোগী যারা শুকনা কাশি, জ্বর আর অল্প শ্বাসকষ্ট নিয়ে আসছেন, তাঁদের কোভিড–১৯ টেস্ট ছাড়াই দুই সপ্তাহর জন্য বাসায় বন্দী থাকতে বলা হচ্ছে। এ ভাইরাসের কোনো প্রতিষেধক এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। সাধারণত ২ থেকে ১৪ দিনের মধ্যে এর লক্ষণ দেখা দিতে পারে। ভয়াবহ শ্বাসকষ্ট নিয়ে আর জ্বর নিয়ে রোগী এলে ইনটিউবেট করে মেশিনের সাহায্যে শ্বাস চালু রাখতে বলা হচ্ছে।

নেবুলাইজার না দিয়ে ইনহেলারের ব্যবহার, নন ইনভেসিভ মেশিন পারত পক্ষে না ইউজ করতে বলা হচ্ছে, যাতে হেলথকেয়ারের কর্মীরা আক্রান্ত না হন। ছয় ফিটের মধ্যে থেকে অতিরিক্ত ভাইরাসে এক্সপোজড হলে যেকোনো বয়সী মানুষ মারা যেতে পারে। আমরা মাথায় হ্যাট, চোখে ডিসপোসেবল প্লাস্টিক গগলস, প্লাস্টিক মাস্ক যেটাতে ভাইরাস ঢুকতে না পারে নিশ্বাসের সঙ্গে, প্লাস্টিক গাউন আর গ্লাভস পরে সন্দেহ ভাজন রোগী দেখি। এরপর প্রতিটা জিনিস খুলে সাবান দিয়ে ২০ সেকেন্ড হাত ধুয়ে পরের ডিসপোসেবল জিনিস খুলি। সময়সাপেক্ষ ব্যাপার কিন্তু জীবন বাঁচাতে উপায় নেই। আমার বাচ্চাদের হাসপাতালে ভলান্টারি কাজ আমি বন্ধ করে দিয়েছি। তাদের স্কুল বন্ধ। রোগ ছড়ানো বন্ধ না করা গেলে অনেক নিরীহ প্রাণ অকালে ঝরে যাবে।

স্বভাবতই প্রতি ঘণ্টায় ই–মেইল, লাইভ লেকচার, আপডেট জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। কিন্তু সবচেয়ে ভয়াবহ লেকচার শুনেছি সেদিন। আইসিইউ বেড খুব সীমিত। যদি অনেক বেশি রোগীদের ইনটিউবেট আর ভেনটিলেট করতে হয় (লাংস বা শ্বাসযন্ত্র শ্বাস না নিতে পারলে গলায় টিউব দিয়ে মেশিনের সঙ্গে সংযোগ দিয়ে বাঁচানো), তাহলে যে রোগীর বাঁচার সম্ভাবনা বেশি, তাদের রেখে বাকিদের শ্বাসযন্ত্র খুলে ফেলতে হবে। মেডিসিনের ডাক্তার আমি, ৮০–৯০ শতাংশ রোগী ভালো হয়ে বাসায় চলে যান আমার। কাজটা এ জন্য এত আনন্দজনক। চোখের সামনে মহামারির জন্য মানুষ অকালে চলে যাবেন, এ দুঃস্বপ্নের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর কোনো মানুষকে যেন না যেতে হয়।

আসুন, সতর্ক হই। জনসমাবেশ এড়িয়ে চলি, যা আছে সবার সঙ্গে ভাগ করে নিই। এ রোগ ছড়ানো বন্ধ হোক। জুলাই পর্যন্ত জরুরি অবস্থা চলতে পারে। আমরা পারব। একটু চেষ্টা করি সবাই।