একটি ল্যাপটপের কাহিনি

লেখকের সঙ্গে বদল হওয়া অন্যর ল্যাপটপ। ছবি: লেখক
লেখকের সঙ্গে বদল হওয়া অন্যর ল্যাপটপ। ছবি: লেখক

গত বড়দিনের সময় গিয়েছিলাম গ্রান ক্যানারিয়াতে। জাহাজে। বিরাট বড় ১২ তলা জাহাজ। জাহাজে সবই আছে, রেস্টুরেন্ট থেকে শুরু করে থিয়েটার, সিনেমা হল, সুইমিং পুল, এমনকি বার পর্যন্ত—সবকিছু। দুই বছর আগেও একবার গিয়েছিলাম। এত ভালো লেগেছিল যে আবারও টিকিট কাটলাম। জাহাজ যাবে ক্যানারি আইল্যান্ডের ১০টি দেশে। বিশাল জাহাজে সমুদ্রভ্রমণের পাশাপাশি অনেক দেশও ঘুরে দেখা যাবে, এ যেন রথও দেখা হলো আবার কলা বেচাও হলো আরকি।

আমি যখনই বিদেশভ্রমণে যাই, সঙ্গে সব সময় ল্যাপটপ নিয়ে যাই। শরৎচন্দ্র লিখেছিলেন, ‘গঙ্গার রুচিকর হাওয়ায় বাবুর ক্ষুধার উদ্রেক হইলো’, আমারও একই অবস্থা। আটলান্টিকের বাতাসে আমার লিখতে ইচ্ছে করে। যাহোক জার্মানি থেকে উড়োজাহাজে করে জাহাজের দিকে রওনা হলাম।

সঙ্গে ল্যাপটপ দেখে আমার ছেলে বলল, ‘বেড়াতে গিয়ে কেউ কি ল্যাপটপ সঙ্গে নিয়ে যায়, ভ্রমণ এনজয় করতে হয়। তুমি তোমার ল্যাপটপ আমাকে দাও।’

যাহোক, ছেলে বুড়ো বাপকে সাহায্য করতে চাইছে দেখে আমিও আর দ্বিমত করলাম না। এবার এয়ারপোর্টের লৌকিকতা পালা। বেল্ট, জুতো, ঘড়ি, মানিব্যাগ, স্মার্টফোন—সবকিছু খুলে রাখতে হলো। ল্যাপটপও।

যাহোক, সহিসালামতে আমি সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বের হয়ে এলাম। আমার কাছে কোনো অস্ত্র পাওয়া গেল না (হা হা)। জার্মান পুলিশ এসে বলল ‘Gute Reise’ মানে যাত্রা শুভ হোক। প্লেনে আর ল্যাপটপ বের করিনি। গ্রান ক্যানারিয়া এয়ারপোর্ট থেকে বাসে করে চলে এলাম জাহাজে।

এবারের জাহাজটি দেখে মনে হলো এটা কি জাহাজ না টাইটানিক!

খুব খিদে লেগেছিল । গেলাম রেস্তোরাঁতে। মুরগির মাংস, নিষিদ্ধ মাংস থেকে শুরু করে থাইল্যান্ডের পেঁপে পর্যন্ত সব আছে। উদরপূর্তি করে খেয়ে নিলাম।

বাঙালির পেট ঠান্ডা তো সব ঠান্ডা। তো এরপর কেবিনের বারান্দায় গেলাম, দেখলাম আটলান্টিক নিচে নাচছে। চারদিকে অন্তহীন জলরাশি, সেই জলরাশি স্রোত জাহাজের গায়ে আছড়ে পড়ছে বারবার। নির্মল বাতাস আর সফেদ পাখিদের দেখে জীবনানন্দের সেই সাদা গাঙচিলের কথা মনে পড়ে গেল। আর বিন্দু মাত্র দেরি না করে আমি ল্যাপটপ বের করলাম এই অপার্থিব সৌন্দর্যের বর্ণনা লেখার জন্য। কিন্তু একি? একই কোম্পানি, একই মডেল, কালার হলেও এটা তো আমার ল্যাপটপ নয়।

পাশের রুমে আমার ছেলেকে গিয়ে বললাম, তুমি কি খেয়াল করোনি এটা আমার ল্যাপটপ নয়?

ছেলে বলল: আমি কীভাবে জানব? ল্যাপটপের মডেলটি তো হুবহু তোমারটির মতো।

জাহাজের পাশে লেখক। ছবি: সংগৃহীত
জাহাজের পাশে লেখক। ছবি: সংগৃহীত

মনের দুঃখে কি আর বলব, এই যে একটা সাহিত্য প্রতিভা আমার ছেলের গাফিলতিতে আটলান্টিকের হাওয়ায় মিলিয়ে গেল, সে কথা কাকে বলি বলুন?

ছেলে বলল, চলো এক কাজ করি।

ল্যাপটপে যদি কোনো পাসওয়ার্ড না থাকে, তো খুঁজে বের করতে পারি ল্যাপটপের মালিককে? হয়তো সে ফেসবুকে থাকতে পারে। অথবা তার কোনো ই–মেইল বা ফোন নম্বর যদি পাওয়া যায়।

ভাগ্যদেবী হয়তো ওই সময়ে আটলান্টিকের পাড়ে বেড়াতে এসেছিলেন। আমাদের সাহায্য করলেন। ল্যাপটপে কোনো পাসওয়ার্ড ছিল না।

যাহোক, দেখলাম একজন ভদ্রলোক, জার্মানিতে থাকেন। ইতালিয়ান। নাম অ্যান্টোনিও। আমার ছেলে বলল, তুমি তোমার স্মার্টফোনে ফেসবুকে খোঁজা শুরু করো। আমি আমার ফোনে। অ্যান্টোনিও নামটা ইতালিতে এত বেশি যেমনটি বাংলাদেশে আবদুল। লাখো লাখো। খোঁজা শুরু করে দিলাম অ্যান্টোনিও নাম দিয়ে আর ছবি মিলিয়ে। আপনারা বিশ্বাস করুন আমরা সত্যিই পেয়ে গেলাম।

আমি উনাকে ম্যাসেজ লিখলাম জার্মান ভাষায়। কোনো উত্তর নেই। ম্যাসেঞ্জারে ফোন করলাম। রিসিভ হলো না। ডুসেলডর্ফ এয়ারপোর্টে ‘লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড ডিপার্টমেন্টে’ ফোন করলাম। কোনো ভদ্রলোক আমার ল্যাপটপটি পেয়ে জমা দিয়ে গিয়েছেন কি না কিন্তু উত্তর এল—‘না, কোনো ল্যাপটপ পাওয়া যায়নি’ ।

এখন কি আর করা যাবে? অপেক্ষায় রইলাম। প্রতিদিন নতুন দেশে যাই, নতুন জিনিস দেখি। মরক্কোর রাজ প্রাসাদ দেখলাম, দেখলাম আরো কত কি, কিন্তু মনের গহীন কেন যেন সেই অভিজ্ঞতার কথা না লিখতে পারার বেদনা একটু পরপর উঁকি দিচ্ছে ।

যাহোক ফিরে এলাম জার্মানিতে। হঠাৎ একদিন দেখি উত্তর এসেছে তাও আবার ইতালিয়ান ভাষায়। আমি আর কি করব? গুগলের সাহায্যে তো সর্ববিদ্যায় বিশারদ হওয়া যায়। আমিও তাই ট্রান্সলেট করে উত্তর দিলাম। এই বয়সে ইতালিয়ান ভাষা শিখতে হবে ভাবিনি কোনো দিন।

এবার ভদ্রলোক আমাকে ফোন করলেন। আমি একটি শব্দও বুঝতে পারলাম না। ইতালিয়ানরা যে এত খারাপ জার্মান বলে আমি জানতাম না। আমি তাকে লিখলাম আপনি একজন দোভাষী নিয়ে আসেন, কেমন। পরের দিন ভদ্রলোক আবার আমাকে ফোন করলেন। একজন দোভাষী কথা বললেন, ঠিক করলাম, পরদিন কোনো একটা শহরে সকাল ১১ টার সময় আমরা দেখা করব। আপনারা নিশ্চয়ই সিনেমাতে দেখেছেন স্পাইরা যখন ধরা পড়ে তখন দু'দলের মধ্যে একটা চুক্তি হয়। আমরা তোমাদের স্পাইকে ফেরত দেব তোমরা আমাদের স্পাইকে। একটা ব্রিজের দু’দিকে থাকে দু’দল। তেমনি আমি তার ল্যাপটপ নিয়ে গেলাম, ভদ্রলোকও আমার ল্যাপটপ নিয়ে এসে আমার হাতে দিলেন। কোনো কথা না বলে ফিরে আসলাম।

মনটা একটু শান্ত হলো। আমার ল্যাপটপে পাসওয়ার্ড ছিল তার মানে উনি নিশ্চয়ই ঢুকতে পারেননি। বাসায় এসে ল্যাপটপ চালু করলাম, আমার চোখকে বিশ্বাস করতে পারলাম না উনি পুরো ল্যাপটপে ফরম্যাট করে ফেলেছেন যেখানে আমার নতুন বইয়ের পাণ্ডুলিপিগুলো রাখা ছিল। মনে মনে ভাবলাম বাঙালি সমাজ কতবড় একটি সাহিত্যিককে এভাবে হারালো।

যাহোক আমার সিনেমা সংগ্রহশালায় হাত দিলাম মন যেন খারাপ না হয় সে জন্য। আর দেখতে থাকলাম “Fall of the Roman Empire”।