আমাদের সেলফ কোয়ারেন্টিনের দিনগুলো

করোনাভাইরাস
করোনাভাইরাস

জার্মানিতে করোনা আক্রান্তদের সংখ্যা ১১ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। ইতালির নিউজগুলো আর পড়া যাচ্ছে না। ইতালির মানুষগুলো অসাধারণ হাসিখুশি। ইউরোপের সবচেয়ে মিশুক, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আর হাসিখুশি একটা জাতি। এদের দেশ যেমন সুন্দর মানুষগুলোও খুব প্রাণবন্ত! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানির অনেক প্রদেশ খুব বিধ্বস্ত হয়েছিল। ইটালির স্থাপনাগুলো সুন্দর টিকে আছে। ইটালির করোনা ভাইরাসের খবরগুলো আর পুরোটা পড়ার মতো মানসিক অবস্থা আমার নেই।

মা বলল ঘরে কিছু চালডাল কিনে রাখা উচিৎ। আমি চাল ডাল কিনব ভাবছি। এরমধ্যে তখনি একজন ফোন দিয়ে বললও মোট আটটা দোকানে গিয়েছি (আলদি, লিডেল, নেটো, রেভে ও এরাবিকের ৮ দোকান) কোথাও চাল ডাল তেল নেই। কাউফল্যান্ডে একটা বেশি দামের গমের তেল আর অলিভ অয়েল আছে, আমি বললাম তাই নিয়ে আসো আর কি করা!

এর ভেতর ফেসবুকে ঢুকলে দেখি মানুষের ঝগড়া দেখা যাচ্ছে সারাক্ষণ। একদল আরেক দলের উপর লেগে যাচ্ছে। একজন বললেন, স্কুল কলেজ সব বন্ধ করা উচিত। আর একজন যেই বললেন, ‘তুমি সব বেশি জানো!’ সঙ্গে সঙ্গে আমজনতার গালি।

একদল বলছে ইতালি থেকে কেন এদের এনেছে? ইতালি থেকে এসে কেন এরা হাজি ক্যাম্পে গেল না এরা খারাপ! অন্য দল বলছে হাজি-ক্যাম্পের যে অবস্থা মানুষগুলো ১৮-১৯ ঘণ্টা জার্নি করে কিভাবে থাকবে!

একে তো পুরোপুরি গৃহবন্দী আর যা পড়ি তাই রাতে স্বপ্ন দেখি। 
সারা রাত স্বপ্ন দেখি এগুলো, রাতে ঘুম ভেঙে যায়। 
এরপর দুদিন ফেসবুক বন্ধ করে দিলাম।

তাও ভালো যে আমাদের এখানে এখন প্রচুর ছেলেমেয়ে আছে। দুপুরে খাবার সময় ডাইনিং টেবিলে একজন জানতে চাইল করল, তোমার রক্তের গ্রুপ কি? 
‘এ পজেটিভ!’ 
‘আমার ও পজেটিভ!’ 
‘জানো এ পজেটিভ করোনাতে সব চেয়ে বেশী বাজে ভাবে ভুগছে!’

শোনার সঙ্গে সঙ্গে একটা শীতল রক্তের ঢেউ মেরুদণ্ড দিয়ে বয়ে গেল। এমনিতেই আমার ইমুউনিটি নিয়ে আমি খুব উচ্চ ধারণা পোষণ করি না। ইমুউন সিস্টেম দুর্বল হয়ে গত বছর হাসপাতালের সেই ভয়াবহ ১০ দিনের কথা মনে পড়ে গেল। 

এরপর দেশে কল দিলাম, এদিকে আব্বু করোনা এর মৃত্যু কেমন কঠিন সেই নিয়ে বিস্তারিত বললেন, শ্বাসকষ্টে দমবন্ধ হয়ে কিভাবে পানির নিচে আটকে পড়া মানুষগুলো মারা যায় তার সঙ্গে তুলনা করে।

এরপর থেকে দেখি নিজেরও মাথা ব্যথা, ঝিমঝিম করছে, আর ফেসবুকে ঢুকলে সে রাতে আর ঘুম আসে না। বাংলাদেশের মানুষের করোনা নিয়ে লেখা, একদল আরেকদল কে আক্রমণ ঝগড়া দেখলে নার্ভ এমনিতেই বিদ্রোহ করে।

দুইদিন ফেসবুক বন্ধ করে রেখেছিলাম। আর মোবাইল থেকে দূরে বসে বসে জার্মান শিখছিলাম। একজন পাকিস্তানি এসে বলল, ‘পৃথিবীর এই অবস্থা আর তুমি জার্মান শিখছো?’

যাই হোক, ভারতীয়গুলোর স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট পলিসিটা সব থেকে ভালো দেখছি! অন্যদেরটা জানি না তবে, আমাদের ফ্ল্যাটের ভারতীয় দুজন এখন সবচেয়ে সুখী জীবন যাপন করছে। আমাদের ফ্লাটের দুইটার সঙ্গে পাশের ফ্ল্যাট থেকে এসে জুড়েছে আরও দুটো, একজন ভারতীয় আর একজন গ্রীক। এই চারজনকে দেখে মনে হচ্ছে এরা জীবনের শ্রেষ্ঠ সুখী সময় পার করছে। সকালে ঘুম থেকে উঠে শোনা যায় এদের হাসির শব্দ, সারাদিন খিলখিল খিলখিল। গ্রিক ছেলেটাও সারাদিন এদের সাথে ন্যাওটার মতো লেগে থাকে, ঝাল মসলা সব খাওয়া শিখে গেছে। এই চারজন সারাদিন এক সাথে রান্না আর খাওয়া দাওয়া করছে। গতকাল রাতে দেখলাম বিরাট আয়োজন, ঘি দিয়ে পরোটা ভাজছে কুড়ি পঁচিশটা পরোটা তো হবেই। ঘি এর গন্ধ চারদিকে মৌ মৌ করছে, রাতের খাবার পরোটা মাংস।

আর আজকে দুপুরবেলা রান্নার সময় দেখলাম এরা প্লান করছে, ‘এখন মুভি দেখবো এরপর পোকার খেলবো, তারপর...... তারপর তারপর....। মানে এক মুহূর্ত বিনোদন বন্ধ নেই!

আমি জিগ্যেস করলাম ভারতে কত জন আক্রান্ত? একজন হিহি করে হাসি দিয়ে বলল ‘আমরা খবর পড়ি না।’

এই পলিসিটা কিন্তু একদিক থেকে ভালো আমার পছন্দ হয়েছে, শুধু শুধু প্যানিক হয়ে বা কি লাভ? তাতে বরং নিজের ইমুউন সিস্টেম খুব দুর্বল হয়ে যায়। যাইহোক এদেরকে দেখে নিজের ভেতরের গুমোট ভাবটা কিছু হলেও কাটছে।

রাতে রান্নার সময় গ্রিক ছেলেটা দেখি ময়লার ডাস্টবিন থেকে তিনটা লাঠি খুলে হাতে নিয়ে একটার সঙ্গে আরেকটা জুড়ে দিয়ে লম্বা করে তার মাথায় এক কাগজের লাঠি জুড়ে দিয়ে আগুন দিয়েছে। লম্বা বারান্দায় এই আগুন হাতে ধরে হাঁটছে আর বাংলা হরতাল হরতাল টাইপ কিছু একটা বলছে, আসলে কি বলছে জানি না। পিছে পিছে ভারতীয়টা তার মিছিলে সায় দিয়ে গলা মেলাচ্ছে।

এই দৃশ্য দেখে আমি নিজেও আর হাসি আটকাতে পারলাম না।

পাকিস্তানি একজন হাসির শব্দে বেরিয়ে এসে কঠিন গলায় বলল,
‘এতো হাসাহাসি কেন এরকম দুর্যোগের ভেতর!’

সাথে সাথে পাকিস্তানি একটা মেয়ে এসে চোখ বড়বড় করে জিগ্যেস করলো, ‘আমাদের আরও দুইমাস কোয়ারেন্টিনে থাকলে কি জার্মান নাগরিকত্ব দিয়ে দিবে?’

এ প্রশ্ন শুনে দেখি প্রচণ্ড গম্ভীর চিন্তাগ্রস্ত ছেলেটাও আর হাসি আটকাতে পারলো না, সব দাঁত বের করে হাসছে !

কিন্তু আমি কিছুতেই ভেবে পাচ্ছি না কোয়ারেন্টিনের সাথে জার্মান নাগরিক হওয়ার সম্পর্কটা কিভাবে তার মাথায় আসলো!

ওর কি হ্যালুসিনেশন হচ্ছে কি না কে জানে!