করোনা-আতঙ্ক ও আমাদের শ্বাপদসংকুল জীবন

পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতার কাজ চলছে। ছবি: লেখক
পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতার কাজ চলছে। ছবি: লেখক

দোকানে গিয়েছি টিস্যু কিনতে। স্টোর করার উদ্দেশ্য ছিল না। আসলেই টিস্যু দরকার ছিল। এক প্যাকেট টিস্যু তুলেছি। এর মধ্যে সামনে তাকিয়ে দেখি, এক ভদ্রলোক চোখেমুখে রাজ্যের আতঙ্ক নিয়ে শপিং ট্রলি ভরে ময়দা লোড করছেন। এমন একটা ভাব যে পো....পো... করে ভেঁপুর বিকট শব্দে করোনার সাইরেন বেজে গিয়েছে। এই বুঝি খাওয়ার যুদ্ধ শুরু।

শহরজুড়ে চরম দুর্ভিক্ষ নেমে এসেছে আর কেউ তাঁর খাদ্য ছিনিয়ে নিয়ে যেতে চাইছেন। পুরো ট্রলি ভর্তি ময়দার প্যাকেট। ট্রলির সঙ্গে ভুঁড়ি ঠেকিয়ে ময়দা এক পাশে সরিয়ে আরেক পাশে হালকা জায়গা বানিয়ে আমি নেওয়ার পরে পড়ে থাকা পুরো টিস্যু সবটুকুই ট্রলিতে তুলে ফেললেন। আমার দিকেও চোখ ঘুরিয়ে তাকালেন। আমার হাতে টিস্যুর প্যাকেটটা তাঁর ট্রলিতে তুলে দেওয়ার জন্য একটা আবেদনময়ী চাহনি। আমি আবেদনে সাড়া না দিয়ে টিস্যুর প্যাকেট আঁকড়ে ধরে পাশের সারিতে সরে পড়লাম। মুহূর্তের মধ্যেই শোরগোলের শব্দে সেইখানে পুনরায় উঁকিঝুঁকি মারা শুরু করলাম। দোকানের দুজন কর্মচারী ওই লোককে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলছে! ‘ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট’ টাইপের ঘিরে ফেলা৷

-তুমি এত ময়দা ট্রলিতে কেন তুলেছ?

- কিনব। তাই! ইটস সো সিম্পল৷

- তুমি এক সাথে এত কিছু কিনতে পারবা না!!

এই দুঃসময়ে খাবার ছিনিয়ে নিতে আসলে উত্তেজিত হবারই কথা৷ লোকটির ক্ষেত্রেও তাই হলো৷ এমন অযাচিত প্রশ্ন তাঁকে চরম উত্তেজিত করে ফেলল৷

- আমার টাকা দিয়ে আমি কিনতেছি৷ তোমার কোনো প্রবলেম?

- তোমার টাকা থাকলেই হবে না৷ এখানে আরও কাস্টমার আছে, তারাও কিনবে৷ তাদের সুযোগ দিতে হবে৷

উত্তেজিত লোকটি একটু নরম হচ্ছে মনে হলো৷

-আরে! ময়দা কি আমি একা খাব? দেখো না আমরা তিনজন আসছি৷ তিনজন মিলে খাবে৷

শুকনা দুইটা আড়াই ফুট সাইজের বাচ্চা দেখিয়ে দিল। এতক্ষণে এরা ওই লোকের ভুঁড়িতে আড়াল হয়ে ছিল। ভুঁড়ি নড়াচড়াতেই তাদের অস্তিত্বের দেখা মিলল৷

এদিকে আমিও এক প্যাকেট ময়দা কিনতে চেয়েছিলাম৷ এবার আমিও আবেদনময়ী চোখে ময়দার ট্রলির দিকে তাকিয়ে রইলাম। কখন ঝামেলা মেটে, লোকটি হার মানে আর আমি এক প্যাকেট ময়দা পাই। ময়দার স্তূপের সঙ্গে বাচ্চা দুটি বেমানান হলেও ওই লোকটির ভুঁড়ির দৈর্ঘ্য-প্রস্থের সঙ্গে বড্ড মানানসই ছিল। এত চাপাচাপির পরেও সে আবার এদিক–সেদিক চেয়ে রয়েছে। আমার টিস্যুর প্যাকেটের দিকেও কয়েকবার নজর দিল৷ আলতো করে ধরে থাকা প্যাকেটটা আবারও আঁকড়ে ধরলাম৷ আশপাশে আরও কিছু দর্শক জুটে গেছে৷ তারাও আমার মতো নিজেদের জিনিসপত্র আঁকড়ে মজা দেখছে৷ আমরা মজা পেলেও দোকানের কর্মচারী দুজনকে মজা দেওয়া যায়নি৷ তারা নাছোড়বান্দা!

শহর পুরো ফাঁকা। ছবি: লেখক
শহর পুরো ফাঁকা। ছবি: লেখক

ওই লোককে ছাড়বেই না। তার উত্তেজনা এবার চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেল। জার্মানে যা বলল, তা আমরা বাংলায় বলে থাকি যে ‘তোদের দোকানের গুষ্টি কিলাই৷’ বলতে বলতেই খিস্তি দিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে গেল। কর্মচারীদের এত নজরদারির পরেও মার্কেটে নির্দিষ্ট কিছু জিনিস গায়েব হয়ে গেছে এবং প্রতিনিয়ত যাচ্ছে। চাল, ময়দা, দুধ, তেল, ডিম ও টিস্যু। জার্মানদেরকে ভাতে আসক্ত হতে কখনোই দেখিনি। এরা নানা পদের রুটিনির্ভর জাতি। অথচ এই বিপদে তারা চাল জমিয়ে রাখছে বিপদের কথা ভেবে! জার্মানদের চাল মজুতের বিষয়টি অবিশ্বাস্যই মনে হয়েছে! এ দোকান, সে দোকান ঘুরে চাল–ডাল কিনতে হচ্ছে৷ টয়লেটের পর জার্মানদের পানি ব্যবহার পানি অপচয়ের শামিল৷ তাই জার্মানদের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের তালিকায় টিস্যু পেপার খুবই গুরুত্বপূর্ণ৷ সেই টিস্যু পেপারও আজ অধরা৷ যেখানে জার্মানরা একসঙ্গে টিস্যু কিনত দশ রোল, বিশ রোল করে সেখানে তারা এক রোল টিস্যু পেলেই বিশ্বজয়ের হাসি দিয়ে দোকান ত্যাগ করছে৷ এই ক্রাইসিসের সময় রসিকতা করে জার্মানরা টিস্যু পেপারের নাম দিয়েছে ‘হোয়াইট গোল্ড’৷

একটা মানুষ শরীরের বলয়ের দুই ইঞ্চির ভেতরে ঢুকে পড়লেই আগে কপালে হাত দিই৷ শরীর গরম-গরম লাগছে না তো! হাঁচি হয় কি না অপেক্ষা করি! আশপাশে কেউ খক করে কাশি দিলেই দৌড়ে পালানোর মতো অবস্থা৷ শরীরের ভেতরটা এমন-তেমন করছে না তো! আজ থেকে শহরে বার, রেস্টুরেন্টও বন্ধ হয়ে গেল৷ মসজিদ, গির্জা, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেছে গত সপ্তাহেই৷ অদ্ভুত এক সময়ের মধ্য দিয়ে জীবন পার করছি৷ ভয়ংকর ব্যাপার হচ্ছে, রোগী আমাদের চারপাশেই রয়েছে! কেমন একটা ভীতিকর অবস্থা! শ্বাপদসংকুল জঙ্গলে নিরস্ত্র ঘুরে বেড়াবার মতো অভিজ্ঞতা বয়ে চলেছি৷ ঘরের বাইরে পা ফেলতে ভয় করছে৷ অজানা এক আতঙ্ক৷ একে বলা যায় গায়েবি আতঙ্ক৷ শত্রু আমাদের অজানা না হলেও অদেখা বটে৷ আমরা নিরস্ত্র সহায়–সম্বলহীন অবলা মানুষ আর করোনাভাইরাস হচ্ছে নিষ্ঠুর শাসক, যে লাশের পর লাশ ফেলে দিয়ে পৃথিবীর এপ্রান্ত থেকে সেপ্রান্ত জয় করে চলেছে৷

সরকারি হিসাবে ছোট্ট এই শহরজুড়ে এখন রোগীর সংখ্যা ৩৮৷ গতকালও ছিল ২৩ জনের মতো৷ বোঝাই যাচ্ছে, জ্যামিতিক হারে রোগীর সংখ্যা বাড়ছে৷

লেখক। ছবি: সংগৃহীত
লেখক। ছবি: সংগৃহীত

কিন্ডারগার্টেন, স্কুল, ফায়ার সার্ভিস অফিস, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল প্রস্তুত করা হচ্ছে কোয়ারেন্টিন সেন্টারের জন্য৷ শহরের মেয়র প্রতিদিন সংবাদ সম্মেলন করে দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন৷ রোগীর আপডেট দিচ্ছেন৷ শহরজুড়ে নানা রকম বিধিনিষেধ জারি করা হয়েছে এবং নতুন নতুন আইন চালু হচ্ছে৷ কোনো প্রয়োজনীয় দরকার ছাড়া শহরে ঘুরে বেড়াতে নাগরিকদের নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে৷ সিটি মেয়রের পক্ষ থেকে সতর্কতা হিসেবে চিকিৎসায় সহযোগিতা করার জন্য সেনাবাহিনী মোতায়েনের অনুরোধ জানানো হয়েছে৷ কোনো কিছু স্পর্শ করা থেকে নাগরিকদের বিরত করা হচ্ছে৷ ট্রেন, ট্রাম, বাসের টাচস্ক্রিন সেন্সর, ডোর সুইচ অটোমেটিক করে দেওয়া হয়েছে। ফলে যাত্রীদের আর স্পর্শ করতে হচ্ছে না৷ সব দরজা স্বয়ংক্রিয়ভাবে খুলে যাচ্ছে৷ শহরজুড়ে ট্রান্সপোর্ট টিকিট চেক সাময়িক বন্ধ রয়েছে। পথচারী ও দোকানের কাস্টমারদের পরস্পর থেকে তিন ফুট দূরত্ব রেখে চলার আহ্বান জানানো হয়েছে৷ আমাদের এ শহরে যাদের সুযোগ আছে, তারা ‘হোম অফিস’ করছে৷ অর্থাৎ অফিসের যাবতীয় কাজ বাসায় শুয়ে বসে করছে৷ সৃষ্টিকর্তার কাছে শুকরিয়া, এ সুযোগটা আমারও হয়েছে৷ বিশ্ববিদ্যালয় চ্যান্সেলরের সুপারিশে হোম অফিস নিয়েছি৷ এই সপ্তাহ থেকেই শুয়ে, বসে নোটবুকে হোম অফিস করছি৷


নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছু কিনতে মার্কেটে যাব, সেখানেও ভয় লাগছে৷ এমন আতঙ্কের মধ্যে দিনাতিপাত করার অভিজ্ঞতা আমাদের মতো সাধারণ মানুষের জীবনে কখনোই আসেনি৷ বিশেষ করে আমরা যারা উন্নত দেশগুলোতে বাস করছি৷ পরপর কয়েকটা দোকানে ঘুরেফিরে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে হচ্ছে৷ এক বোতল স্যানিটাইজার কিনতে গিয়ে সবচেয়ে হয়রান হতে হয়েছে৷ দোকানের কর্মচারীদের পরামর্শ অনুযায়ী দোকান খোলার আগেই লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে৷ এদিকে বরাবরই লাইনে দাঁড়ানোতে আমার অ্যালার্জি রয়েছে৷ যার জন্য অনলাইনে অর্ডার করতে হয়েছে৷ তা–ও সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদ যে প্রয়োজনীয় দ্রব্য না পাওয়ার আশঙ্কা থাকলেও মূল্যবৃদ্ধিজনিত কোনো দুশ্চিন্তা নেই৷

সব থেকে বড় বিপদ সামনের দিনগুলোতে আসছে বলে ধারণা করা হচ্ছে৷ যা কিনা জীবন-মরণ টাইপের বিপদ৷ এমন চলতে থাকলে হয়তো জার্মানিও ইতালির মতো ভাগ্য বরণ করতে যাচ্ছে৷ তারপরেও আমরা একটু ক্ষীণ আলোর অপেক্ষায় গৃহবন্দী জীবন যাপন করছি৷ আশা করছি আলো আসবেই৷ গবেষকগণ আমাদের জন্য শিগগিরই সুসংবাদ নিয়ে আসবেন৷ আমরা অপেক্ষায় আছি!

*লেখক: গবেষক, পলিমার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, মার্সেবুর্গ ইউনিভার্সিটি অব অ্যাপ্লাইড সায়েন্স, হালে, জার্মানি