ইরানে অঘোষিত বন্দিজীবন

ইরানের মেট্রো স্টেশন বন্ধ। ছবি: সংগৃহীত
ইরানের মেট্রো স্টেশন বন্ধ। ছবি: সংগৃহীত

ইরানে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি ধর্মীয় নগরী কোমে প্রথম করোনা–আক্রান্ত এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়। এরপর ইরানের অন্যান্য শহরেও এ ভাইরাস দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এখানকার শিক্ষা মন্ত্রণালয় মুহূর্তের মধ্যে কিন্ডারগার্টেন থেকে বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে দেয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ডরমেটরিগুলোতে অবস্থানরত ইরানী শিক্ষার্থীদের হল ত্যাগ করতে বলা হয়। সবাই চলে যান নিজ নিজ শহরে, শুধু বাকি থাকি আমরা বিদেশি শিক্ষার্থীরা। আমাদের মধ্য থেকেও বেশির ভাগ শিক্ষার্থীরা নিজ দেশে চলে গেছেন। বিশেষ করে ভারত ও লেবাননের শিক্ষার্থীদের বিশেষ ফ্লাইটে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

আমি ইরানে থাকায় আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধব উদ্বেগে রয়েছেন। অনেকেই ফোনে, মেসেঞ্জারে কিংবা অন্য কোনোভাবে নিয়মিত খোঁজখবর নিচ্ছেন। প্রথম দিকে সবাই বলতেন দেশে চলে যেতে। আমারও ব্যক্তিগতভাবে ইচ্ছা ছিল দেশে ফিরে যেতে, এর জন্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জনের সঙ্গে যোগাযোগও করি । সে সময় থেকেই ইরান ও বাংলাদেশের মধ্যে সব ফ্লাইট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দেশে আসা হয়ে ওঠেনি।

এই পরিস্থিতিতে হঠাৎ করে খবর পাই আমাদের খাজা নাসিরউদ্দিন তুসি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যায়, পরের দিন হাসপাতাল থেকে জানানো হয় তাঁর শরীরে করোনাভাইরাস পজিটিভ। সবাই আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। খবরটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ায় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বন্ধুবান্ধব খোঁজখবর নিতে থাকেন।

আমরা যাঁরা ডরমেটরিতে আছি আমাদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। জরুরি কোনো প্রয়োজন ছাড়া বাইরে যেতে নিষেধ করেছে। প্রতি সপ্তাহে একজন চিকিৎসক এসে আমাদের বিভিন্ন ধরনের চেকআপ করে যান এবং রুমগুলোতে প্রতিনিয়ত ভাইরাস প্রতিরোধক স্প্রে করা হচ্ছে।

এই দিনগুলোতে খুব বেশি প্রয়োজন না হলে বাইরে যাই না। বাধ্য হয়ে শুধু খাবার কিনতে বাইরে যেতে হচ্ছে, বাইরে গেলে মাক্স ও গ্লাভস ব্যবহার করছি। বাইরে থেকে ফেরার পর ভালোভাবে হাতে ধুয়ে ডরমেটরিতে প্রবেশ করি। এ ছাড়া কিছুক্ষণ পরপর অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল স্প্রে বা জেল দিয়ে হাত পরিষ্কার করি। এ যেন এক অঘোষিত বন্দিজীবন।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার এক সপ্তাহ পর থেকে অনলাইন এবং টেলিভিশনের মাধ্যমে পাঠ্য কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। এ ক্ষেত্রে স্কুল ও কলেজপড়ুয়া ছাত্রছাত্রীদের জন্য টেলিভিশন এবং বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের জন্য অনলাইন ব্যবহার করা হচ্ছে।

ইরানের শহরে স্প্রে করা হচ্ছে। ছবি: সংগৃহীত
ইরানের শহরে স্প্রে করা হচ্ছে। ছবি: সংগৃহীত

দিন দিন ইরানে করোনাভাইরাস–আক্রান্ত এবং মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েই চলছে। ইরানের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী প্রতি ঘণ্টায় ৫০ জন মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে এবং ৬ জন মানুষ মারা যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসে মৃত্যুর সংখ্যা হিসাবে চীন ও ইতালির পরেই ইরানের অবস্থান।

ইরানে বাংলাদেশি যাঁরা আছেন এখন পর্যন্ত কারও করোনাভাইরাস–আক্রান্তের খবর পাওয়া যায়নি। ইরানের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ১০০ জনের বেশি বাংলাদেশি শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত। সবাই আতঙ্কের মধ্য দিয়ে দিন কাটাচ্ছেন এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দিকনির্দেশনা অনুযায়ী জীবন যাপন করছেন।

পুরো ইরানের জনসংখ্যা আট–নয় কোটির বেশি হবে না, এদের স্বাস্থ্যসেবার মানও যথেষ্ট ভালো, তারপরও পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। ভাবতে গা শিউরে ওঠে, যখন চিন্তা করি আমাদের দেশের কী বিভীষিকাময় পরিস্থিতি হতে পারে। দেশকে ভালোবেসে দেশের মানুষ এবং নিজের পরিবারের কথা চিন্তা করে আমরা যাঁরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছি, আপনাদের সবার কাছে আমার বিনীত অনুরোধ, দেশে আসার জন্য হুড়োহুড়ি না করে, যে দেশে আছেন, সেই দেশের সরকার এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরামর্শ মেনে চলুন।

লেখক: শিক্ষার্থী, কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং, খাজা নাসিরউদ্দিন তুসি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।