করোনায় অন্তরালের মহানায়কেরা

দক্ষিণ কোরিয়া ক্রিকেট খেলে না। ফুটবলে তাদের বিশ্ব তাক করা দল নেই। কিন্তু এই দেশ গবেষণায় সারা দুনিয়াকে তাক লাগানোর ক্ষমতা রাখে। দুনিয়াতে যে দুটি দেশ তাদের জিডিপির সবচেয়ে বেশি অংশ গবেষণায় খরচ করে, কোরিয়া তার একটি। দ্বিতীয় দেশটি হলো ইসরায়েল। এই দুই দেশ যেন টেক্কা দিয়ে গবেষণায় টাকা ঢালছে।বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালে কোরিয়া তার জিডিপির ৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ অর্থ ব্যয় করেছে গবেষণায়। আর ইসরায়েল করেছে ৪ দশমিক ৫৮ শতাংশ। আমেরিকা ব্যয় করেছে তাদের জিডিপির ২ দশমিক ৮ শতাংশ। দক্ষিণ কোরিয়া, এ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি মানুষদের করোনা টেস্ট করতে সক্ষম হয়েছে। করোনার বিরুদ্ধে কোরিয়ার ‘প্রতিরোধ শক্তি’ বহু দেশের জন্য মডেল হয়ে দাঁড়িয়েছে।

করোনাভাইরাস যখন সারা দুনিয়াকে কাঁপিয়ে দিয়েছে, তখন সবাই আশায় আছে, কখন বিজ্ঞানীরা একটা ভ্যাকসিন তৈরি করে ফেলবেন। কখন একটা এন্টিভাইরাল ড্রাগ নিয়ে উদ্ধারকর্তার মতো দাঁড়িয়ে থাকবেন গবেষকেরা। বিজ্ঞানীদের কাজের দিকে এমন নিদারুণ করুণভাবে পৃথিবীর মানুষ সম্ভবত বহুদিন তাকিয়ে থাকেনি। আমরা ভুলে যাই, বিজ্ঞান গবেষণা কোনো তাড়াহুড়োর বিষয় না। গবেষণার জন্য সময় প্রয়োজন হয়। প্রয়োজন হয় অনেক অর্থ আর মেধার। একজন গবেষক তৈরি করতে, সমাজকে অনেক টাকা খরচ করতে হয়। সমগ্র দুনিয়ায় আমরা মিলিটারির জন্য যত টাকা খরচ করি, খেলাধুলার জন্য যত অর্থ ব্যয় করি, গবেষণার জন্য তার অর্ধেকের অর্ধেক টাকাও খরচ করি না।

আমার দেশটাতে গবেষণার জন্য সরকার বলতে গেলে কোনো টাকাই দেয় না। তার ওপর, গবেষণার যে সংস্কৃতি ও ব্যবস্থাপনা, সেটা একটা হযবরল দশা হয়ে আছে। কিছুদিন আগে একেকজন ক্যাসিনো সম্রাটদের কাছ থেকে যে পরিমাণ অর্থ জব্ধ করা হয়েছে, সে পরিমাণ অর্থও দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার জন্য দেওয়া হয় না। সুতরাং এই রকম বৈশ্বিক মহামারির সময়, আমাদের দেশের মানুষ স্বপ্নে পাওয়া ওষুধ, কবিরাজি ওষুধ কিংবা থানকুনি পাতা খেয়ে রোগ সেরে যাওয়ার গুজবে বিশ্বাস করবে—এটাই স্বাভাবিক!

করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন আবিষ্কার হবে। নয়তো অ্যান্টিভাইরাল ড্রাগ আবিষ্কার হবে। হয়তো তিন মাস, নয়তো ছয় মাস কিংবা বছর। কিন্তু হবেই। মানুষের প্রচেষ্টাতেই পৃথিবী থেকে বহু মহামারি দূর হয়েছে। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যত মানুষ মরেনি, তার চেয়ে বেশি মানুষ মারা গিয়েছে গুটিবসন্তে (Small pox)। অথচ, স্মল পক্স এখন কোনো রোগ না। স্প্যানিশ ফ্লু, এশিয়ান ফ্লু, সার্স ভাইরাস, ইবোলা, মার্স, ম্যালেরিয়া, এইডস, ডায়াবেটিস, যক্ষ্মা, চিকেন পক্স—এমন সব রোগের ওষুধ বিজ্ঞানীদের প্রচেষ্টাতেই আবিষ্কৃত হয়েছে। বিজ্ঞান মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে সমাধান নিয়ে। দুনিয়ার একদল মেধাবী সব সময় সমাধানের নেশায় দিনরাত যাপন করছেন।

আগামী বছর হয়তো দেখা যাবে করোনা–ভীতি মানুষের মধ্যে আর নেই। হুম, এটা সত্য যে নতুন নতুন রোগ আসবে। নতুন নতুন ভাইরাস সম্পর্কে আমরা জানব। লড়াই করবে। এই লড়াইটা নতুন নয়। মানুষের সবচেয়ে বড় শক্তি এটাই! মানুষ থেমে থাকে না! আমেরিকার কোনো বিজ্ঞানী দল, নয়তো ইউরোপের কোনো টিম অথবা চীনের কোনো প্রতিষ্ঠান করোনার ভ্যাকসিন নিয়ে আসবে। ড্রাগ নিয়ে আসবে। স্বপ্নে পাওয়া ওষুধ দিয়ে, একজন মানুষকেও সেরে তোলা যাবে না। একজনও না! আজ থেকে প্রায় আড়াই শ বছর আগে, বিজ্ঞান যখন অনেক অনগ্রসর ছিল, তখনো স্বপ্নে পাওয়া ওষুধ দিয়ে মহামারি রোধ করা যায়নি।

লেখক
লেখক

এডওয়ার্ড জেনার নামের একজন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী তখন স্মল পক্সের জন্য ভ্যাকসিন আবিষ্কার করেছিলেন। সেটাই ছিল মানবেতিহাসের প্রথম ভ্যাকসিন। জেনার মানবেতিহাসের এমন বিজ্ঞানী, যাঁর উদ্ভাবন দিয়ে সবচেয়ে বেশি মানুষের জীবনকে রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে।

করোনাভাইরাসের গ্রাস থেকে মানবসভ্যতাকে বাঁচাতে দুনিয়ার বহু বিজ্ঞানীই কাজ করে যাচ্ছেন। তাঁদের সবাইকে আমরা চিনি না। জানি না। তাঁদের কথা হয়তো আমাদের মনেও থাকবে না। তাঁরা হলেন অন্তরালের যোদ্ধা। অন্তরালের মহানায়ক। এমন নায়কদের তৈরি করতে হয়। মানুষের অদৃশ্যমান শত্রু আছে এবং সেসব শত্রুর কাছ থেকে বাঁচতে হলে এমন যোদ্ধা তৈরিতে সমাজকে কাজ করতে হয়। দুনিয়ার সব দেশ তেমন যোদ্ধা তৈরিতে সজাগ নয়। দুনিয়ার কিছু দেশ এখনো তেমন যোদ্ধা তৈরি করে বলেই, মানবসভ্যতা আশার আলো দেখে। করোনাভাইরাস, একুশ শতকের দুনিয়াকে তেমন যোদ্ধা তৈরির গুরুত্বটা আরও প্রকটভাবে বুঝিয়ে দিয়ে যাবে।

লেখক: গবেষক। [email protected]