লকডাউন শহর থেকে বলছি

ফ্রান্স পশ্চিম ইউরোপের একটি দেশ। তবে এখানকার অধিবাসীদের কাছে সমগ্র ইউরোপটাই একটা দেশের মতো। কারণ, এখানকার সেনজেনভুক্ত দেশে অবাধ যোগাযোগব্যবস্থা দেখে আপনার মনেই হবে না যে কেউ এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাচ্ছেন! মনে হবে এক শহর থেকে অন্য শহরে কেউ যাচ্ছেন।

ফ্রান্সের প্রাকৃতিক দৃশ্য ও ফরাসি নিদর্শনগুলো মানুষকে দারুণভাবে আকৃষ্ট করে এবং এই আকর্ষণের জন্য সারা পৃথিবী থেকে বহু পর্যটক এই দেশে বেড়াতে আসেন। ফ্রান্সের রান্না পৃথিবীবিখ্যাত। এখানে প্রায় চার শ রকমের বিভিন্ন খাবার দেখা যায় এবং ফ্রান্সের মানুষকে পৃথিবীর সবচেয়ে আধুনিক ফ্যাশনের বলা হয়।

ফ্রান্সের রাজধানী তথা বৃহত্তম শহর প্যারিস। এ শহরে আমার বসবাস। অনেকে প্যারিসকে স্বপ্নের শহর মনে করে আর মনে করাটাই স্বাভাবিক। কারণ, এ শহরের নিজস্ব সক্রিয় বৈশিষ্ট্য আজও বিশ্ব দরবারে মাধা উঁচু করে আছে, যার প্রতিটি রাস্তা কোনো একটা ইতিহাসের কথা বলে, প্রতিটা অলিগলিতে রয়েছে শিল্প আর সংস্কৃতির ছোঁয়া। যাকে রূপে–গুণে অনন্য বলা যায়। আইফেল টাওয়ারের উচ্চতা, মোনালিসার হাতছানি, ভেনাস দ্য মিলো, ডিজনি ল্যান্ড পার্ক ও ওর্য়াল্ড ডিজনি ল্যান্ড স্টুডিও পার্ক, নিউ ব্রিজ, চার্লস ডে গোলে এয়ারপোর্ট ইত্যাদি প্যারিসকে করেছে আরও বেশি মনোমুগ্ধকর।

আমার প্রবাসজীবনের বয়স মাত্র তিন বছর। মন চাইলে ছুটে চলে গেছি পাশের দেশে বেড়াতে কিংবা কোনো কাজে। ইউরোপে বসবাস করার এটাই বেশি আনন্দের—সকালে পরিকল্পনা করে ঘুরে আসা যায় পাশের দেশ থেকে। যত কাছাকাছি এক–একটা দেশ, ততটাই ভিন্ন তাদের ভাষা, সংস্কৃতি, মানুষ ও বৈশিষ্ট্য, যা সত্যি শিক্ষণীয় ও উপভোগ্য।

মাত্র ১৫ দিন আগেও কেউ স্বপ্নে ভাবেনি এই দেশের সঙ্গে আশপাশের সব দেশ তাদের সীমান্ত বন্ধ করে দেবে। শুধুই কি প্রতিবেশী দেশ, পুরো পৃথিবী থেকে ফ্রান্স এখন বিচ্ছিন্ন। এ এক ভয়ানক আতঙ্ক। ফ্রান্সসহ ইউরোপজুড়ে এ আতঙ্কের নাম কোভিড-১৯ বা করোনাভাইরাস। অদৃশ্য ভাইরাসের কাছে অসহায় পুরো দেশ। দেশটি বাধ্য হয়েছে লকডাউন করতে। সারা দেশ ও দেশের মানুষ আজ বন্দী। অজানা ভয়–আতঙ্ক তাদের কুরে কুরে খাচ্ছে। একান্ত জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউ ঘর থেকে বের হতে পারবে না। নিয়ম অনুযায়ী একা বাইরে যাওয়া যাবে ওষুধ কিংবা খাবার কিনতে, বিনা কারণে বাইরে গেলে গুনতে হবে ১৩৫ ইউরো অর্থদণ্ড।

লেখক
লেখক

মাত্র তিন সপ্তাহ আগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল শতকের কোঠায়। আজ তা হয়েছে প্রায় ১৬ হাজার ৪৫৯ জন। এখন পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ৫১২ জনের। বিপদ মোকাবিলায় দেশের স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি, মিউজিয়াম, বার, রেস্তোরাঁ, কফিশপ, ডিসকো বার, সিনেমা হল, শপিং সেন্টার, পর্যটন এলাকা, পার্ক, জিম ইত্যাদি একে একে সব বন্ধ হলো। পুরো শহর ভুতুড়ে পরিণত হয়েছে। এ রকম পরিস্থিতে প্রত্যেক মানুষ ভীষণ আতঙ্কিত ও বিব্রত। স্বাভাবিকভাবে স্কুল বন্ধ হওয়ায় বাচ্চাদের সময় কাটছে না। ছোটখাটো দোকান–রেস্তোরাঁ বন্ধ হওয়ার কারণে কর্মহীন হয়েছে প্রচুর মানুষ। ইউরোপে অবস্থান করে যাঁরা কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে এক দেশ থেকে অন্য দেশে গিয়ে ব্যবসা করেন, কাজ করেন, ভ্রমণ করেন, এমন বন্দী অবস্থা সত্যিই দুঃখজনক তাঁদের জন্য। এর সঙ্গে বিশাল এক অধীরতা ও উদ্বেগ—কবে মিলবে মুক্তি? আদৌ কি মিলবে? কবে অবসান ঘটবে বন্দী জীবনের? অবরুদ্ধ–বন্দী থাকাটা যে কত কষ্টের, তা আমি আপনাদের বলে বোঝাতে পারব না। হয়তো আরও এক মাস, দুই মাস কিংবা এক বছর বন্দী থাকতে রাজি। তারপরও বিপদমুক্ত হতে চাই। প্রত্যাশা করি, করোনাভাইরাস থেকে মুক্ত থাকুক অন্য দেশের মানুষগুলোও। সুস্থ হয়ে উঠুক আক্রান্ত সব রোগী। নতুন করে আক্রান্ত না হোক একটি মানুষও।

আসুন, সবাই সবার জন্য প্রার্থনা করি। লকডাউন দেশের প্রত্যেক মানুষের পক্ষ থেকে এটাই চাওয়া।