করোনা মোকাবিলায় চীনের অভিজ্ঞতা নিয়ে দুটি কথা

২৬ জানুয়ারির এক সকাল। ছবি: লেখক
২৬ জানুয়ারির এক সকাল। ছবি: লেখক

আজ দুই মাস হতে চলল আমাদের কোয়ারেন্টিন বসবাসের। জানুয়ারির ২৩ তারিখে স্ত্রী-সন্তানসহ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে শেষবার বের হয়েছিলাম দৈনন্দিন বাজার করার জন্য। তখন থেকেই কিছুটা জানি যে উহানে একটি ভাইরাসের কারণে অনেকে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে। যদিও আমি যে শহরটায় থাকি, তা উহান থেকে প্রায় ৮০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এখানেও সবাইকে মাস্ক পরে বের হতে বলা হচ্ছে। চায়নিজ কিছু ইংরেজি পত্রিকার অনলাইন সংস্করণ পড়ে যেটুকু বুঝেছিলাম, তাতে আমি তেমন গুরুত্ব দিইনি। তবে সেদিন রাতে যখন দেখলাম, ২৪ তারিখের আমাদের শহরের মসজিদের জুমার নামাজ বন্ধ ঘোষণা করেছে, তখন কিছুটা হলেও বিচলিত না হয়ে পারলাম না। আর পরদিন উৎকণ্ঠা আরও বেড়ে গেল যখন জানতে পারলাম, আজ থেকে উহান লকডাউন করা হয়েছে। লোকমুখে কানে এল, আমাদের শহরও লকডাউন হতে পারে। পত্রিকা ঘেঁটে যা বুঝলাম, তা সত্যিই ভয়ের, বিশেষ করে আপনি যখন দেশ থেকে দূরে, একজন প্রবাসী। তখন উহানে আক্রান্তের সংখ্যা মাত্র ৪৪৪ জন। এরপরে কী হারে যে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ল, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না, সবারই জানা। আজ তিন দিন ধরে উহানে নতুন কোনো আক্রান্ত রোগী নেই।

আমি যে শহরে থাকি, তার নাম হ্যাংজো। আমাদের এই শহরেও প্রায় এক মাস ধরেই অভ্যন্তরীণ কেউ আক্রান্ত হয়নি। তবে এর মধ্যে রোগীর সংখ্যা যা বেড়েছে, তা বিদেশ ফেরত চায়নিজ নাগরিক। অদ্যাবধি আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১৮৩, যাদের মধ্যে ১৮১ জন সুস্থ। এটি অবশ্য কখনোই সেই অর্থে লকডাউন হয়নি, তবে অন্য শহরের সঙ্গে সড়কপথে যোগাযোগ কিছু সময়ের জন্য বন্ধ ছিল। আকাশপথ সব সময় খোলাই ছিল।

সব সময়ই অভ্যন্তরীণ পাবলিক ট্রান্সপোর্ট চলেছে, সংখ্যায় কম। তবে সব ধরনের লোকসমাগমের স্থান যেমন সিনেমা হল, দর্শনীয় স্থান, শপিং মল, দোকানপাট ইত্যাদি বন্ধ ছিল অনেক দিন। কিছু কিছু নিত্যপণ্যের দোকান খোলা ছিল। শুধু জনসেবা প্রতিষ্ঠান ছাড়া সব সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চায়নিজ নববর্ষের ছুটি বিভিন্ন ধাপে বর্ধিত করে ১৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বর্ধিত করেছিল আঞ্চলিক সরকার। শুধু তা-ই নয়, সে সময় তারা সাধারণ জনগণকে বাধ্য করেছিল হোম কোয়ারেন্টিনে থাকতে। প্রতিটি আবাসিক কমিউনিটিতে স্বেচ্ছাসেবক দল ও পুলিশ প্রশাসন দিয়ে ঘর থেকে বের হওয়ার ওপর নিয়মিত নজর রাখত। ঘরে ঘরে একটি করে সরকার অনুমোদিত কার্ড দেওয়া হয়েছিল, যে কার্ড ব্যবহার করে এক পরিবারের যেকোনো একজন সপ্তাহে সর্বোচ্চ দুবার বাইরে যেতে পারবেন। তা-ও শুধু খাদ্যসামগ্রী কেনা বা জরুরি প্রয়োজনে। যদিও বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে থাকার কারণে আমার সেটা লাগেনি, তার পরও আমি সপ্তাহে একবার বের হতাম খাবার কিনতে। সে সময়ের রাস্তাঘাট দেখলে মনে হতো, আমি বুঝি কোনো এক জনশূন্য পরিত্যক্ত নগরীতে এসে পড়েছি। হঠাৎ কখনো একজনের দেখা পাওয়া যায়।

করোনা মোকাবিলায় চায়নিজ সরকারের সবচেয়ে বড় পদক্ষেপ ছিল সবার করোনা চিকিৎসার ব্যয় বহন করা, এমনকি বিদেশিদেরও। এ ছাড়া প্রতিটি মানুষকে পর্যবেক্ষণে রাখা। আমাকে প্রায় দুই মাস ধরে প্রতিদিন দুপুর ১২টার মধ্যে অনলাইনে আমার আজকের অবস্থান, জ্বর বা কাশি আছে কি না, গত ১৫ দিনে উহানে গিয়েছি কি না—এসবসহ বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়।

এমনই সবুজ রঙের Health code ছাড়া এখানে চলা দুষ্কর। ছবি: লেখক
এমনই সবুজ রঙের Health code ছাড়া এখানে চলা দুষ্কর। ছবি: লেখক

এক দিন ভুলে গিয়েছিলাম, ১২টার পর আমার মোবাইলে এসএমএস পাই আমার রিপোর্ট দেওয়ার জন্য। এ কাজ শুধু আমি প্রবাসী বলে করছি তা নয়, আমার জানামতে, সবাইকে করতে হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আমার বিভাগ আমারটাসহ বিভাগের সব স্টাফকে যেমন পর্যবেক্ষণ করছে, তেমনি অন্যদেরটা পর্যবেক্ষণ করছে তার কর্মস্থলের কিংবা তার আবাসিকস্থলের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেউ। কারও কোনা ধরনের সন্দেহজনক কিছু পেলেই তাকে হোম কোয়ারেন্টিনে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হচ্ছে। সাবধানতার জন্য সরকার সব ধরনের জ্বর, কাশি কিংবা ঠান্ডার ওষুধ সাধারণ ফার্মাসিতে বিক্রি নিষিদ্ধ করেছে, যাতে এমন কোনো লক্ষণ থাকলেই মানুষ চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করে। একবার এক পত্রিকায় দেখেছিলাম, কোনো এক এলাকায় সরকার ঘোষণা করেছিল, যে ব্যক্তি জ্বর বা ঠান্ডা-কাশি থাকা সত্ত্বেও চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ না করা বা লুকিয়ে রাখা ব্যক্তির সন্ধান দেবেন, তাঁকে এক হাজার ইউয়ান (চায়নিজ মুদ্রা) পুরস্কার দেওয়া হবে। এত কিছু কেন? শুধু নিশ্চিত হওয়ার জন্য যাতে কোনো সন্দেহভাজন ব্যক্তি অবাধে ঘুরে বেড়িয়ে রোগটি ছড়াতে না পারে। প্রতিদিন চায়নিজ মিডিয়াতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে সাসপেকটেডের (সন্দেহভাজন) সংখ্যাটাও প্রকাশ করত এবং এখনো করছে। এটি লেখা পর্যন্ত চায়নাতে করোনা সন্দেহভাজনের সংখ্যা ১১৮ জন আর আক্রান্ত ৫ হাজার ৮৪৯ জন।

ফেব্রুয়ারির ১০ তারিখ থেকে হ্যাংজো প্রশাসন তাদের আসার অনুমতি দিল যাঁরা এ শহরে বসবাস করেন কিন্তু বন্ধে শহরের বাইরে ছিলেন। তাও আবার আগে তাঁকে অনলাইনে নির্দিষ্ট একটি ফরম পূরণ করে আবেদন করতে হবে। তাঁর আবাসিক কমিউনিটিকে অবহিত করতে হবে। তাঁর অবস্থান, শারীরিক অবস্থার ওপর তাঁকে আসার অনুমতি দিলেও তাঁর ৭ থেকে ১৪ দিন পর্যন্ত হোম কোয়ারেন্টিনে থাকা বাধ্যতামূলক। এ সময় ঘর থেকেও বের হতে পারবেন না। আইন না মানলে বড় ধরনের জেল-জরিমানা। এটি নিশ্চিত করতে আঞ্চলিক প্রশাসন Alipay প্ল্যাটফর্মে সব নাগরিকের জন্য (শিশু ছাড়া) Health code চালু করে। Health code ‘সবুজ’ মানে তিনি বাইরে বের হতে পারবেন, ‘হলুদ’ ও ‘লাল’ মানে তাঁকে যথাক্রমে ৭ ও ১৪ দিন হোমকোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে। নির্দিষ্ট সময় পর তাঁর সবকিছু ঠিক থাকলে তাঁর Health code টি সবুজ দেখাবে। এ নিয়ম এখনো আছে। এখন পরিস্থিতি অনেক স্বাভাবিক। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া সবই খুলে গেছে। কিন্তু এখনো অফিস, ব্যাংক, বাজার, শপিং মল, আবাসিক স্থান কিংবা বাস-ট্যাক্সিতে উঠতে হলেও সবুজ Health code লাগবে। সঙ্গে আপনার শরীরের তাপমাত্রা মাপা হবে। অন্যথায় আপনি ঢুকতে পারবেন না। যেসব স্থানে একাধিক প্রবেশদ্বার ছিল, সেখানে সব বন্ধ করে শুধু একটি মাত্র খোলা। 


আমিতো শুধু উহান থেকে প্রায় ৮০০ কিলোমিটার দূরের এক শহরের কথা বললাম। তাহলে উহানে কী ধরনের সাবধানতা অবলম্বন করেছে, আশা করি কিছুটা হলেও আঁচ করতে পারছেন। সে তুলনায় আমার দেশের প্রশাসন কী করেছে, সে কথায় না গিয়ে সামনের দিকে তাকাই। আশার কথা হচ্ছে, দেরিতে হলেও তাদের কিছুটা বোধোদয় হয়েছে। সরকারের কাছে আমার একান্ত আবেদন শক্ত হাতে করোনা মোকাবিলা করার জন্য প্রয়োজন হলে কঠোর হোন। সেদিন শুনলাম কেউ একজন বলছে, প্রবাসীদের ঠিকানায় গিয়ে তাঁদের পাওয়া যাচ্ছে না, তারা এক ঠিকানা দিয়ে অন্য জায়গায় বসে আছে। আমি বলি সরকারকে কেন খুঁজতে হবে তাদের? তাঁরাই বরং সরকারকে খুঁজবে। গত দুই মাসে যাঁরা দেশে এসেছেন তাঁদের নিশ্চয় তালিকা আছে সরকারের কাছে। ২০টা হটলাইন নম্বর দিয়ে বলে দিন গত দুই মাসে যাঁরা বিদেশ থেকে দেশে এসেছেন তাঁদের ওই নম্বরে আগামী দুই দিনের মধ্যে যোগাযোগ করতে। অন্যথায় তাঁদের পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত কিংবা তেমনই কিছু একটা করা হবে, যাতে তাঁরা আর কখনোই এই পাসপোর্ট ব্যবহার করে দেশের বাইরে যেতে পারবেন না।

আশা করি সবাই নিজ উদ্যোগে একবারে না পেলে ১০ বার চেষ্টা করে হলেও ফোন করে তাঁর অবস্থান জানাবেন। তাঁদের থেকে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে এবং বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করে প্রয়োজনে কিছু কিছু এলাকায় কারফিউ বা জরুরি অবস্থা জারি করে হলেও ওই এলাকার মানুষদের পর্যবেক্ষণে রাখুন। এ ব্যাপারে আঞ্চলিক প্রশাসনের পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবক টিম গঠন করা যেতে পারে। অত্র এলাকার হাসপাতালগুলোকে প্রস্তুত রাখুন, যাতে খুব জরুরি না হলে রোগী পরিবহন করতে না হয়। সারা দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য ছাড়া অন্য সব দোকান, শপিং মল কিংবা জনসমাগম হওয়ার জায়গা ১৫ দিনের জন্য বন্ধ ঘোষণা করুন। প্রতিটি অফিসকে তাদের কর্মীদের ও তার পরিবারের তথ্য হালনাগাদ ও পর্যবেক্ষণে রাখার নির্দেশ দিন। এমনিভাবে বাজার কমিটি, পরিবহনসহ অন্যান্য কমিটিকেও একই নির্দেশনা মেনে চলতে বাধ্য করুন। সন্দেহভাজন কেউ থাকলে তাঁকে হোম কোয়ারেন্টিনে পাঠান।

সবাই সচেতন হয় না, হবেও না। প্রবাসীরা যদি বুঝতেন তবে তাঁর পরিবারকে কখনোই সবচেয়ে ঝুঁকির মুখে ফেলতেন না, দেশকেও না। তাই সরকারকে সচেতন হতে হবে সবার আগে। জনগণকে বাধ্য করতে হবে মানতে। আমাদের সাধারণ জনগণকেও আরও সচেতন হতে হবে। অযথা আতঙ্কিত না হয়ে সরকার প্রদর্শিত নিয়ম নিজের যেমন মেনে চলতে হবে। আপনার পাশের জনকেও বোঝাতে হবে। আর সবচেয়ে বড় বিষয়, অযথা বিভিন্ন বাহানায় ঘর থেকে বের না হয়ে নিজের ও পরিবারের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। তবেই হয়তো পারব আমরা দেশকে সুরক্ষিত করতে।

*লেখক: পোস্ট-ডক্টরাল ফেলো, চ্যেচিয়াং বিশ্ববিদ্যালয়, হ্যাংজো, চীন