করোনায় ইস্তাম্বুলের দিনলিপি

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

কী ভয়ংকর! মেট্রোরেল, বাস, ট্রাম হঠাৎ করেই ফাঁকা। মানুষের প্রচণ্ড গিজগিজে ব্যস্ত ইস্তাম্বুল শহরটা খাঁ খাঁ করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টেশনে নেমে সোজা ক্যাফে গোত্তায় হাঁটা দিলাম, দরজায় তালা। ক্যাম্পাসের ওই ক্যাফেতেই আমার সময় কাটে। আড্ডায়, চায়ে, বইয়ে, ল্যাপটপের কি–বোর্ডে; আবার কখনো চুপচাপ বসে থেকে ক্যাফের প্লে–লিস্টে কান পেতে রেখে সময় বয়ে যায়।

বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ। তারপরেও আমার ক্যাফেতে যাওয়া বন্ধ হয়নি। কিন্তু তুরস্কে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে যাওয়ায় ক্যাফেও বন্ধ হয়ে গেছে। স্বাভাবিক একটা পৃথিবীতে হুট করে বিরতি। ডরমিটরিতে ফিরলাম। আমার তুর্কি বন্ধুরা সবাই গোছগাছ করছে নিজ নিজ শহরে যাবে বলে। স্কুল-কলেজ আগেই বন্ধ হয়েছে। মসজিদ, ক্যাফে, রেস্তোরাঁ, বারসহ জনসমাবেশ হয় এমন সবকিছু এবার বন্ধ।

ডরমিটরির ম্যানেজার অনুরোধ করলেন খুব প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে বের না হতে। অসহায় লাগছিল খুব। স্বাভাবিক জীবনযাপনে হঠাৎ করে এই বিশাল পরিবর্তন। মানতে কষ্ট হচ্ছিল। প্রথম দিন সকাল থেকে কিছুই খেতে ইচ্ছে করছিল না।

নেটফ্লিক্স সিরিজের একটার পর একটা এপিসোড দেখছি, বইয়ের পাতার পর পাতা উল্টোচ্ছি—কীভাবে যেন রাত চলে এল, গভীর রাত। ঘুম আসছে না। বাংলাদেশের কথা মনে পড়ছে। খবর দেখাটা ঠিক হয়নি। ইতালিতে কফিনের পর কফিন। জীবদ্দশায় এত মানুষের একের পর এক মৃত্যুর খবর শুনতে হবে, ভাবতেও পারিনি। কত্ত ক্ষুদ্র এক ভাইরাসের কাছে আমরা পুরো মানবসমাজ অসহায়। কত্ত ক্ষণজন্মা আমরা! এই ছোট্ট জীবনেও আমাদের কতই না অনিরাপত্তা, দুর্যোগের সঙ্গে লড়াই করতে হয়। তারপরেও বাঁচতে হয়। এই ঘুম, এই জেগে থাকার মধ্যে হারাতে হয় খানিকটা অবচেতনতায়। ভাবতে হয় তোমাকে। লিখতে হয় তোমাকে নিয়ে। জীবনের এই রাত এই সকালের মধ্যে যে স্নিগ্ধ সুন্দর রহস্য, তাতেই তোমাকে পেতে হয় গভীর আলিঙ্গনে। ভোরের তানপুরায় বাঁধতে হয় তোমার সুর। রেওয়াজে রেওয়াজে আঁকতে হয় তোমার ছবি।

ঘুম থেকে এই মাত্র উঠেছ। আমাকে চেনো না তুমি। তোমার চোখের তারায় জমে ওঠা ওই স্বপ্নের অবশিষ্টগুলোও আমার জন্য কতগুলো কাব্য-প্রেরণার সঞ্চার, জানো না তুমি। জলের কয়েক ঝাপটায় মুছে ফেলো সেগুলো, তারপর এক নতুন তুমি—ঠোঁটে হালকা চালের হাসি, চোখে জানালার ওপারের মেঘলা আকাশের অস্পষ্ট প্রতিচ্ছবি, তারপর একটা লম্বা দিনের প্রস্তুতি—আমি সবটা দেখি। আমার চিন্তা, কল্পনা, আবেগ, কান্না, হাসি, অপেক্ষা আর ভালোবাসা—এর সবটাই তোমার অতিকায় অসীম বলয়ে ঘুরপাক খাচ্ছে দিনান্তের ঘূর্ণিপাকে।

স্রষ্টা খুব অবচেতনেই সৃষ্টি করেছেন কল্পনা। এই কল্পনাতে ভর করেই তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে সৃষ্টি। এই যেমন আমি, কল্পনার খড়কুটো হাতে অনন্ত মাদকতার জলে ভাসতে থাকি, আধোঘুম চাহনিতে বুঁদ হয়ে থাকি। চলে যাওয়া, ফিরে আসা, হারানো, আবার নতুন করে পাওয়া, এসবের জালে স্বেচ্ছায় বাঁধি মস্তিষ্ককে। তোমার সঙ্গে গল্প করি, তারা গুনি, ছন্দ-কাব্যের খেলা খেলি, অন্ধকারের খুব গভীরে আশার বাণী আর আলো খুঁজি, জাপটে ধরি স্বপ্নকে—ওর থেকে ধার করি ডানা, উড়ি দিগন্তের খোঁজে। খোঁজ মেলে না ঠিকই, কিন্তু এই যাত্রাপথজুড়ে সুর আর শব্দের মিশেল ফুটিয়ে তুলি আমাদের চারটা পাঁচটা অর্কিড। ওরা মরে যায়। আবার বেঁচে ওঠে—নতুন শাখায়, পাতায়, কুঁড়িতে অপেক্ষার প্রহরে বাঁচতে থাকে, ওদের প্রার্থনাজুড়ে এক নাছোড়বান্দা চাওয়া—তোমার আর আমার স্পর্শ।

এমনই সব জটিল, কুটিল, অর্থহীন চিন্তা-বাক্যে আমার অবসর কাটে। পুরো একটা দিন এক সেকেন্ডের ভেতরেই উধাও! আমার খুব গভীরে বাস করা আমিটা তো আজীবনই ঘরে বন্দী থাকে। ওকে আমি ওর মতো করে থাকতে দিই। কথা বলি মাঝেমধ্যে—ওই হাই হ্যালো কেমন আছ পর্যন্ত। আমার বেশির ভাগ সময় যাপন বাইরের আমির সঙ্গে। ছোট্ট একটা জীবনে অসীমের স্বাদ পাওয়াটা কি কম সৌভাগ্যের? আমার ভেতরের আমি সেটা পায়। ওই যে অপেক্ষা! তোমার জন্য অপেক্ষা। প্রতিটা মুহূর্তই অসীমের সমান। রবিঠাকুর এই অনুভূতি ধারণ করতে পেরেছিলেন, ‘তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে, যত দূরে আমি ধাই’। অথবা ‘অসীম আকাশ নীল শতদল, তোমার কিরণে সদা ঢল ঢল’। অসীম শব্দটা আমার কাছে পৃথিবীর সমান অর্থ বহন করে। ওহ না, পৃথিবীর থেকেও অনেক বেশি, এই ধরো কয়েক লাখ গুণ বড় অর্থ, হতে পারে কয়েক কোটি গুণ বড়। তোমাকে হয়তো পাব না কোনো দিন, তারপরেও তোমার জন্য অপেক্ষা। এই অপেক্ষাটাও খুব সুখের, হোক সেটা অসীমে বিস্তৃত। সীমিত জীবনে অসীম সুখ। মন্দ নয়। নজরুলের সৃষ্টির আশ্রয়ে, ‘জানে সূর্যেরে পাবে না তবু অবুঝ সূর্যমুখী, চেয়ে চেয়ে দেখে তার দেবতারে দেখিয়াই সে যে সুখী...’।

লেখক
লেখক

খুব গভীর সংকটে পৃথিবী। ঘর থেকে বের হওয়া বারণ। এত ব্যস্ত-বিশাল সড়কগুলো আজ থমথম স্থবির। এত দম বন্ধ করা চার দেয়ালে বন্দী হতে হবে, ভাবতেও পারেনি মানুষগুলো। অবশ্য শব্দ, সাহিত্য, সুর—এদের খুব ক্ষমতা থাকে, সেই কবে হেমন্ত গেয়ে গেছেন, ‘নীড় ছোট ক্ষতি নেই, আকাশ তো বড়’। যাদের ঘরে জানালা আছে, বাসায় আকাশমুখী ছাদ আছে, অথবা অন্তত চিন্তার ছোট-বড় পরিধি আছে, সময়টা খুব আয়েশের অবসর তাদের জন্য।

ইউরোপ মহাদেশটা খুব অদ্ভুত। ওখানে কিছু কিছু মানুষ দেখছি ঘরের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে পিয়ানো, বাঁশি, ভায়োলিন বাজাচ্ছে। এলাকার সবাই নিজ নিজ বাসার ছাদ, ব্যালকনি, জানালায় এসে উপভোগ করছে। একসঙ্গে গাইছে, আনন্দ করছে। এশিয়া মহাদেশেও কিছু কিছু জায়গায় এমন অদ্ভুত উদাহরণ দেখা গেছে। লেবাবননের এক পাড়ায় মুখোমুখি ভবনগুলোর সবাই ব্যালকনিতে একত্র হলো, আর ওদের প্রিয় প্রতিবেশীর জন্মদিনে সমস্বরে শুভজন্মদিন গেয়ে শুভেচ্ছা জানাল। মানুষ পারেও! খুব দুর্যোগেও আনন্দ খুঁজে নেওয়া কেবল মানুষের পক্ষেই সম্ভব। তোমাকে না পেয়েও এত কাছে পাওয়া, মানুষ বলেই সম্ভব হয়েছে আমার পক্ষে। রাস্তার কোণে খাবারের অপেক্ষায় মিউমিউ করতে থাকা বিড়ালটার নিশ্চয়ই কল্পনা করার শক্তি নেই। কেবল মানুষের আছে এই আভিজাত্য, তাই মানুষই পারে।

আমার জন্ম, বেঁচে থাকা/ মৃত্যুর পথে যাত্রা—এসবটাই তো খুব নগণ্য ঘটনা। মহাবিশ্বের বিশালতার কাছে কত্ত ক্ষুদ্র এক প্রাণ আমি পেয়েছি। আমি তারপরেও খুব খুশি। তোমার অসীমে নিমগ্ন আমার সমস্ত আবদার, অশ্রু না হওয়া কান্না, ফুল হয়ে না ফোটা হাসি, পাখির ডানায় না ওড়া স্বাধীনতা।

*লেখক: শিক্ষার্থী, ইস্তাম্বুল বিশ্ববিদ্যালয়, ইস্তাম্বুল, তুরস্ক