প্যানডেমিকের দিনগুলোতে জার্মানিতে

সুপারস্টোরগুলো ফাঁকা। ছবি: লেখক
সুপারস্টোরগুলো ফাঁকা। ছবি: লেখক

করোনার সংক্রমণ তখনো মহামারি ঘোষণা করেনি ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন। তিন বছর পর দেশে বেড়াতে যাওয়ার উত্তেজনা আমাদের। দেশে পৌঁছেও তেমন উৎকণ্ঠা চোখে পড়েনি। হঠাৎ করেই যেন একের পর এক বার্তা আসতে লাগল আমাদের ইনবক্সে। সব দোকানের জিনিসপত্র নাকি স্টকআউট হয়ে যাচ্ছে। যে যা পারছে কিনে রাখছে! তখনো আমরা এটাকে হুজুগে মানুষের প্যানিক বলেই তেমন গুরুত্ব দিইনি। তবে ফিরে আসার আগের সপ্তাহে যখন ঠান্ডাজ্বরে আক্রান্ত হলাম, তখন কিন্তু বাসার সবাই বেশ উৎকণ্ঠিত হয়ে গেল আমার অবস্থা নিয়ে। এয়ারপোর্টে নেমে কোয়ারেন্টিন করে রেখে দিলে তো ছেলে নিয়ে মহাবিপদ। আসল বিপদ টের পেলাম প্লেনে ওঠার পর থেকে। কাশি দিলেই মানুষ এমন করে তাকাচ্ছে যেন আমি নিজেই একটি জীবন্ত ভাইরাস!

বাসায় পৌঁছে বুঝলাম অবস্থা আসলে কতটা খারাপ! কোন রকমে লাগেজ রেখেই খাবারের সন্ধানে বের হয়ে গেল বাবাই। আমাকে জিজ্ঞেস করলো, এক সপ্তাহের জন্য কী কী আনব বলো? আমি মোটামুটি একটি লিস্ট দিলাম। কিছুক্ষণ বাদে ফিরল, তবে বেশির ভাগ জিনিসই না নিয়ে! যা পেল, তাতে এক দিন চলবে আমাদের। হঠাৎই একটা ভয় যেন আমাকে গ্রাস করে ফেলল! মহামারির সামাজিক-সাংস্কৃতিক নানা অভিজ্ঞতা বইয়ের পাতায় হাজারোবার পড়া বাক্যগুলো যেন একনিমেষেই জীবন্ত হয়ে উঠেছে!

প্রতিটি বাসার দরজা–জানালা বন্ধ। ছবি: লেখক
প্রতিটি বাসার দরজা–জানালা বন্ধ। ছবি: লেখক

পরের দিনই ঠিক করলাম যে এক সপ্তাহের মতো বাজার করে রাখা দরকার। বিকেলেই খবর দেখে বুঝলাম, আসলে এক সপ্তাহের না এক মাসের বাজার করে রাখা প্রয়োজন। বাবাই জানতে চাইল, বলো তো এক মাসে আমাদের সবচেয়ে দরকার কী কী হতে পারে? সত্যি বলতে কী, কেমন যেন একটা ভীতি! আমি কোনোভাবেই সবচেয়ে দরকারি জিনিস বের করতে পারলাম না! আমার কাছে মনে হচ্ছে, সবই দরকারি, কোনটাকে বাদ দেব? ভাবতে গিয়ে দেখলাম, আমার শুধু মনে হচ্ছে, এক মাসের করলেও এরপর কী হবে? যদি সব খাবারের স্টক ফুরিয়ে যায়? জার্মানি তো বর্ডারও বন্ধ করে দিয়েছে; একে একে সব কিছু বন্ধ করে দিচ্ছে, উৎপাদন, আমদানি বন্ধ হলে এক মাস পর কী হবে? নিয়মিত জীবনের জন্য এক মাসের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের বাজার লিস্ট করা আর এক মাস পর ডিমান্ড অনুযায়ী সাপ্লাই না–ও থাকতে পারে মনে রেখে মাসের বাজার লিস্ট করা কিন্তু একেবারে আলাদা। তারপর মনে এল, আরও ভয়াবহ চিন্তা যে এই মহামারির যে আর্থ-সামাজিক প্রভাব পড়বে, সেটা ছেলে নিয়ে কীভাবে সামাল দেব! মোটামুটি কিংকর্তব্যবিমূঢ় আমি কোনো লিস্টই করতে পারি না! জার্মানির মতো সমৃদ্ধ একটি দেশে বসে আমি যে ভয় পাচ্ছি, আমার নিজের দেশের মানুষেরা কেন সেই ভয় পাচ্ছে না?

মানুষ সোশ্যাল মিডিয়ায় নানা ব্যঙ্গাত্মক পোস্ট করছে যে চাল-ডাল, এমনকি টয়লেট টিস্যুও নাকি শেষ হয়ে যাচ্ছে এটা নিয়ে! আমি দেখছি, একজন মানুষের অনিশ্চয়তার আতঙ্কিত মনস্তত্ত্ব! নিজেকে দিয়েই বুঝতে পারছি, এই ভীতি আসলে একজন মানুষকে কীভাবে মানসিক দিক দিয়ে দুর্বল করে ফেলতে সক্ষম! আমরা বুঝতে পারিনি যে ইতালিতে এতসংখ্যক মানুষের মৃত্যু হবে, তেমনি আগামীকালও কী হবে আমরা জানি না। কে আক্রান্ত হবে জানি না! জার্মানি সবচেয়ে শেষে বর্ডার বন্ধ করেছে, চ্যান্সেলর বলেছেন, বর্ডার বন্ধ করে এর সংক্রমণ বন্ধ করা সম্ভব নয়; ৭০ শতাংশ মানুষ আক্রান্ত হবেই; বরং অর্থনীতির চাকা বন্ধ হয়ে যাবে, পরিস্থিতিকে আরও সংকটময় করে তুলবে। কিন্তু কোনো দিকে না তাকিয়ে সেই জার্মান বর্ডারও কিন্তু বন্ধ করা হয়েছে।

সড়ক ফাঁকা। ছবি: লেখক
সড়ক ফাঁকা। ছবি: লেখক

জার্মানি তাহলে কীভাবে ভাবছে? জার্মানি আসলে ৭০ শতাংশ মানুষের সংক্রমণের জন্য মানসিক ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রস্তুত; তবে সেটা যেন এক দিনেই ইতালির মতো ১০০ থেকে ১ হাজারে বেড়ে না যায়, সেই চেষ্টাই তাদের মোটো আপাতত। চিকিৎসাসেবা তখনই দেওয়া সম্ভব, যখন সেটা একটি নির্দিষ্ট গতিতে বাড়তে থাকে। কোভিড-১৯–এর ক্ষেত্রে যেটা একেবারেই দেখা যায়নি; বরং গুণিতক হারে বেড়েছে এর প্রভাব। করোনাভাইরাস মহামারি মোকাবিলা করতে গিয়ে জার্মানি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে বলে মন্তব্য করেছেন চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল। জার্মানিতে এখন পর্যন্ত এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে ১৫ হাজারের মতো মানুষ। জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল বলেন, ‘পরিস্থিতি মারাত্মক। একে মারাত্মকভাবেই নিন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে আমাদের দেশের সমন্বিত সংহতির প্রতি আর কোনো কিছুই এমন মারাত্মক চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারেনি।’ বাভারিয়াতে লকডাউন করা হয়েছে। ধারণা করা যায় সহজেই যে শিগগিরই পুরো জার্মানিতেই লকডাউন করে দেওয়া হবে। এমনিতেও সবাই চেষ্টা করছে বাসায় থাকতে। যাঁদের বাসা থেকে অফিস করা সম্ভব, তাঁদের হোম অফিস করতে দেওয়া হয়েছে। অন্যরা যাঁদের যেতেই হবে, তাদের জন্য বলা হয়েছে সে ছাড়া বাসার অন্য সদস্যরা যেন বাইরে না যায়। প্রতি পরিবারের একজন সদস্য বাসা থেকে প্রয়োজনীয় কাজ সারতে বের হবে। রেস্তোরাঁ, বার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান—সবকিছুই এখন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

স্টক করা জিনিসের একাংশ। ছবি: লেখক
স্টক করা জিনিসের একাংশ। ছবি: লেখক

সবাই আসলে নিজেদের কথাই চিন্তা করছে, নিজেদের জন্য ভয় পাচ্ছে। ছোট্ট একটি ফুলকপি রান্না করতে গিয়ে কাল (১৭ মার্চ) মনে হচ্ছিল যে আহা পুরোটা রান্না না করে অর্ধেকটা রেখে দিই, পরে যদি না পাওয়া যায়! এটা আসলেই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, শীতপ্রধান জার্মানিতে সবজি প্রায় চাষই হয় না, এমনকি ধানও না। এদিকে এই চার দিনে মাত্র ছয় কেজি চাল আমরা সংরক্ষণ করতে পেরেছি। কারণ, বাজারে চাল পাওয়াই যাচ্ছে না। জার্মানরা কি ভাত খুব পছন্দ করে? না, তা নয়। চাল এখন পড়িমরি করে সবাই কিনছে, কারণ, এটি দীর্ঘ সময় টিকে থাকার মতো শুকনো খাবার। খাবার সংরক্ষণের বিষয়টিও বাংলাদেশের মতো একই রকম হবে কি না, সেটাও চিন্তার বিষয়। কারণ, দুটি দেশের জলবায়ু ভিন্ন। মানে বাংলাদেশে পেঁয়াজ আর আলু খোসা ছড়িয়ে রাখলে এক বছর পর্যন্ত সংরক্ষণ করা সম্ভব। কিন্তু শীতপ্রধান দেশের ক্ষেত্রে এ রকম বিষয়গুলো কতটা কার্যকর বা কত সময় পর্যন্ত কার্যকর! সংস্পর্শ বাঁচিয়ে চলার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে; কিন্তু সুপারশপের বিভিন্ন খাবারের প্যাকেটগুলোও একাধিক মানুষের সংস্পর্শে আসছে স্বাভাবিকভাবেই। তাই আমরা নিজেরাই যখন খাবার স্টক করার জন্য এগুলো নিয়ে আসছি বাসায়, সেটাও কিন্তু কম ঝুঁকিপূর্ণ নয়! আপনি নিজে বাইরে থেকে এসে হাত ধুলেন, গোসল করলেন; কিন্তু যে জিনিসগুলো বাজার থেকে নিয়ে এলেন, সেগুলোকে কীভাবে জীবাণুমুক্ত করবেন আপনি?

সবাই চরম ঝুঁকির মধ্যে দিন পার করছি
সংস্পর্শ মানে শুধু মানুষেরই নয়, সবকিছুর সংষ্পর্শ। সেটা আদৌ সম্ভব হবে কি না, সেটাও আমাদের ভাবতে হবে। সন্তানকে কিছুক্ষণ পরপর হাত ধোয়া শেখালেন, আবার অপর দিকে বাইরে থেকে নিয়ে আসা খাবারের প্যাকেট বা চালের প্যাকেট বাসার রান্নাঘরে রেখে দিলেন। ধরে নিই, সেই চালের প্যাকেটই কোনো ভাইরাসে আক্রান্ত মানুষ ধরেছেন সুপারশপে এবং ভাইরাসটি তিন ঘণ্টা পর্যন্ত বাতাসে বেঁচে থাকে। তাহলে সুরক্ষা হবে কি? তার মানে আমরা সবাই কি চরম ঝুঁকির মধ্যে প্রতিদিন বাস করছি। ঘরে বা বাইরে কোথাও নিরাপদ নই। এই একটি চিন্তাই আপনাকে অসুস্থ হওয়ার আগেই অসুস্থ করে দেবে। প্যানিক হওয়া সমাধান নয়, আবার ঘরবন্দী দশায় এ রকম পরিস্থিতিতে আমরা সবাই প্যানিক হয়েই আছি। জীবন-মৃত্যুর মাঝখানের অনিশ্চয়তাময় সময় যেটা মানুষ বরাবরই ভুলে থাকতে চায়, সেটা যেন বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সবাইকে বলছে, ‘পারলে এখন ভোলো তো দেখি!’

ঘরবন্দী অবস্থায় ব্যালকনিতে সন্তানের সঙ্গে লেখক। ছবি: সংগৃহীত
ঘরবন্দী অবস্থায় ব্যালকনিতে সন্তানের সঙ্গে লেখক। ছবি: সংগৃহীত

এ রকম চলতে থাকলে সামনের সময়টা সবার জন্যই খুব কঠিন। আমেরিকা বা জার্মানির মতো দেশ থেমে থাকা মানে পৃথিবীর অর্থনীতির চাকা থেমে যাওয়া। বিশ্বযুদ্ধের ধাক্কা কাটাতেই কত বছর পিছিয়ে পড়তে হয়েছিল পৃথিবীকে! সেখানে এই ধাক্কা কীভাবে গোটা পৃথিবী সামলাবে সেটাই চরম হতাশার। এই চরম অনিশ্চয়তা আমাকে একটা বড় শিক্ষা দিয়েছে, ‘প্রয়োজন/নিড’কে ফোকাস করতে শেখা। এক চামচ তেল দিয়েও রান্না করা যায়, আবার এই একই রান্না ইচ্ছামতো পরিমাণে তেল দিয়ে করতে পারবেন। এক চামচ তেল হলো প্রয়োজন, যে এর কম দিলে রান্না ঠিকমতো হবে না; আর বাকিটা সাধ্য-রুচির বিলাস। এখন সময়টাই এমন যে সেই এক চামচ তেল খরচ করতেও আমাদের ভয় লাগে বেশি খরচ হয়ে গেলে পাব কি না ভেবে।

শুধু জার্মানি নয়, ইউরোপজুড়েই একই অবস্থা। প্যানডেমিকের আগামী দিনগুলো কীভাবে কাটবে আমরা কেউই জানি না; শুধু সুসময়ের জন্য অপেক্ষা, একটু বেঁচে থাকার অকুতি সবার।

*লেখক: নৃবিজ্ঞানী, পিএইচডি গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব বন, জার্মানি