করোনা-আতঙ্কে বিজ্ঞান

১.

বিশ্বজুড়ে এখন প্রধান আলোচনার বিষয় হলো করোনা। বিজ্ঞানীদের কাছে এই ভাইরাসের অনেক কিছুই অজানা। চীনের হুবেই প্রদেশের উহানে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে মানবদেহে এই জীবাণু প্রথম প্রকাশ পায়। সেখানে দ্রুতই ছড়িয়েছে এই জীবাণু। আক্রান্ত একজন মানুষের শরীর থেকে অন্যদের শরীরে। নার্স, চিকিৎসক কেউই বাদ যাননি। করোনায় আক্রান্তের হার বেড়েছে গাণিতিক হারে। কাশি, জ্বর, আর প্রচণ্ড শ্বাসকষ্টের উপসর্গ দিয়ে এর বহিঃপ্রকাশ পেয়েছে মানবদেহে।

রোগের এসব উপসর্গকে আমলে নিয়ে বিভিন্ন উপায়ে চিকিৎসার বিরামহীন চেষ্টায় তখন চীনের স্বাস্থ্যকর্মীরা। বড় বড় চিকিৎসক। চীন উন্নত দেশ। সারা বিশ্বে কাঁচামাল আর পণ্যদ্রব্যের বাজারকে নিজেদের আয়ত্তে নিয়ে বর্তমান সময়ে তারা এক অর্থনৈতিক পরাশক্তি। বিশ্ববাজারে এই আধিপত্যের ধারাকে অব্যাহত রাখতে দ্রুত সময়ে নাজুক এই পরিস্থিতিকে মোকাবিলা করতে চীন সরকার সব রকমের কঠোর কৌশলই নিয়েছে। চেষ্টা আর কৌশল সবই প্রায় ব্যর্থ। দীর্ঘ হয়েছে মৃত্যুর সারি। পৃথিবীর সব জায়গায় মানুষের মধ্যে এখন করোনাভাইরাসের আতঙ্ক। করোনা–আতঙ্ক।

২.
আধুনিক যুগের উন্নত যোগাযোগব্যবস্থা দুনিয়ার যেকোনো জায়গাকে করেছে বৈশ্বিক। সবার। এই যুগে মানুষ সকালে নাশতা করে এক দেশে, দুপুরের লাঞ্চ আর ব্যবসায়িক মিটিংটা অন্য দেশে সেরে রাতের ডিনার করে পৃথিবীর আরেক প্রান্তে। ব্যবসায়িক চাহিদা আর মনের খোরাক মেটাতে নিজ দেশের সীমানা অতিক্রম করে মানুষের বিশ্বময় ভ্রমণই করোনাকে করেছে বৈশ্বিক। বর্তমানে এটা মহামারি। চীনের হুবেই থেকে ছড়িয়েছে সেখানকার অন্য প্রদেশগুলোতে। চীন দেশের সীমানা পার হয়ে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে গেছে কোরিয়া, জাপান, ইতালি, ইরান, জার্মানি, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ পৃথিবীর সব প্রান্তে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভাষায়, এটা চায়নিজ ভাইরাস!

বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়া ভাইরাসের আতঙ্কে জাত–ধর্ম–বর্ণনির্বিশেষে সবাই। সাধারণ কিংবা ভিআইপি। এই তো গত বুধবার জার্মানির চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল দুই সপ্তাহের জন্য স্বেচ্ছা কোয়ারেন্টিনে গেছেন। তাঁর চিকিৎসক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন, হয়তো তিনিও করোনা বহন করছেন—এই শঙ্কায়। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর দেহে করোনার উপস্থিতি পাওয়া যায়নি, তবু স্বাস্থ্যবিধি মেনে তিনি দুই সপ্তাহের কটেজ কোয়ারেন্টিনে। ট্রুডোর স্ত্রী সোফি ট্রুডো করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। প্রিন্স চার্লস আর অস্ট্রেলিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও এই দলে। বিখ্যাত হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট ড. ব্যাকো নিজেও কোভিড-১৯–এ আক্রান্ত। এই মহামারিতে ইতিমধ্যেই পাঁচ লাখ মানুষ আক্রান্ত। এ লেখা যখন লিখছি, মৃতের সংখ্যা তখন ২১ হাজার ছাড়িয়েছে। এ সংখ্যা দ্রুতই বেড়ে চলেছে। দেশে দেশে জরুরি অবস্থা অথবা লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। আশার কথা, চীন, কোরিয়া, সিঙ্গাপুরে পরিস্থিতি এখন উন্নতির পথে।

৩.
কোভিড-১৯-এর কোনো প্রতিষেধক নেই। সুনির্দিষ্ট কোনো ওষুধও নেই। যুগে যুগে মানব–ইতিহাসে এমন অনেক মহামারি এসেছে। প্লেগ, গুটিবসন্ত,¯স্প্যানিশ ফ্লু, এশিয়ান ফ্লু, সোয়াইন ফ্লু, ম্যালেরিয়া, কুষ্ঠরোগ কত কী। বিজ্ঞানে আবিষ্কারের নেশায় আর মানবকল্যাণে কাজ করতে গবেষকেরা দিন–রাত পরিশ্রম করে অতীতের সব ভয়ানক মহামারিকে জয় করেছেন। জটিল সব রোগের চিকিৎসায় এসেছে থেরাপি, ড্রাগ, ভ্যাকসিন।

চিকিৎসাবিজ্ঞানে বর্তমান সময়ের আতঙ্ক কোভিড-১৯ রোগের ভাইরাস করোনা ছিল অজানা। কিন্তু বিজ্ঞানীরা আজও বসে নেই। জাপান, জার্মানি, আমেরিকা, চীন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, কোরিয়াসহ অনেক দেশের তুখোড় মেধাবীরা এগিয়ে এসেছেন। গবেষণাগারে তাঁরা দিন–রাত কাজ করছেন। আবিষ্কারের নেশায়। মানবসভ্যতাকে বাঁচাতে। গবেষণায় ভালো কিছু ফল আসছে। ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল হচ্ছে কোথাও। জীবনকে বাঁচাতে ভ্যাকসিন অথবা ড্রাগ তৈরি হবেই।

জাপানের মাইনিচি সংবাদপত্রের (মার্চ ১৭) তথ্যানুযায়ী অ্যাজমা নিয়ন্ত্রণের ড্রাগ অ্যালভেসকো সেখানকার কানাগাওয়া প্রিফেকচারে কোভিড-১৯ রোগীদের প্রয়োগ করে ফল পাওয়া গেছে। করোনায় প্রদাহ নিয়ন্ত্রণ আর ভাইরাসের বংশ বৃদ্ধি রোধে এই ড্রাগ কাজ করেছে বলে দাবি তাদের। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের জন্য কয়েকটি দেশের যৌথ প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে ইবোলা ভাইরাসের চিকিৎসায় ব্যবহৃত রেমডেসিভিরও প্রয়োগ করা হয়েছে। এটি মূলত মুমূর্ষু রোগীদের ক্ষেত্রে দেওয়া হয়েছে এবং এর ফলে তাঁরা মরে যাননি।

চীনের উহানে কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত কিছু রোগীকে ম্যালারিয়ার ওষুধ ক্লোরোকুইন দিয়ে একদল চায়নিজ গবেষকের পাওয়া ফলাফল কিছুটা আশাব্যঞ্জক। সিএনএনের (মার্চ ১৯, ২০২০) তথ্যমতে, সেই একই উদ্দেশ্যে আমেরিকাসহ অন্যান্য দেশেও ক্লোরোকুইন আর হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন ড্রাগের পরীক্ষামূলক ব্যবহার হয়েছে। কিন্তু এসব পরীক্ষায় মানবদেহে সন্তোষজনক সুফলের প্রমাণ এখনো মেলেনি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রেস ব্রিফিংয়ে ক্লোরোকুইনকে নতুন করোনাভাইরাসের চিকিৎসায় ব্যবহারের জন্য এফডিএ ছাড়পত্র দিয়েছে বলে বেফাঁস মন্তব্য করেছিলেন। তবে সারা দুনিয়ায় গবেষকেরা ভালো ফলের আশায় বিশদ গবেষণায় বুঁদ হয়ে আছেন। প্রতিষেধক তৈরিতে বিজ্ঞান সফল হবেই।

৪.
বৈশ্বিক এই মহামারি করোনার ফাঁদে এখন বাংলাদেশও। ভাইরাসের আগ্রাসী তাণ্ডব থেকে প্রতিরোধের জন্য জনসচেতনতা তৈরি করতে গিয়ে হোমরাচোমরা দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা একে অপরকে মাস্ক পরালে আর দলবল নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করলে তা সাধারণ মানুষের চোখে সামাজিক দূরত্বের আবশ্যিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। শুধু মাস্ক করোনাভাইরাস থেকে মানুষকে বাঁচাতে পারবে না। ভাইরাসের আকার এতই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র যে সাধারণ মাস্কের ভেতর দিয়ে এটা সহজেই চলাচল করে শ্বাসনালি ও মুখের ভেতর যাবে। হাঁচি-কাশির তরল কণার সঙ্গে মিশে এই জীবাণু একজন থেকে অন্যজনে ছড়াবে। তাই সুস্থ মানুষের মধ্যে যাতে জীবাণু না ছড়ায়, এ ক্ষেত্রে রোগীর জন্যই মাস্কের বেশি প্রয়োজন। উপরন্তু একই মাস্ক অনেক সময়ব্যাপী ব্যবহার করলে নিজেই জীবাণুতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বাড়ে।

এই দুঃসময়ে সংবাদ সম্মেলনে, অফিসে, হাটবাজারে, স্টেশনে, যানবাহনে মানুষের জটলা থাকা মোটেই ঠিক নয়। হ্যান্ডশেক, কোলাকুলি এড়িয়ে তিন ফুট দূরত্ব রেখে যত দূর সম্ভব মানুষের ভিড় এড়িয়ে চলা খুবই দরকার। সাবান দিয়ে ভালোভাবে ঘন ঘন হাত পরিষ্কার করা অত্যন্ত জরুরি। হ্যান্ড স্যানিটাইজারের চেয়ে সহজলভ্য সাবান বেশি কার্যকর হবে। ঘরের বাইরে পরিধেয় কাপড়চোপড় যথাসম্ভব পরিষ্কার করা উচিত। মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ ও কি–বোর্ড জীবাণুমুক্ত রাখতে হবে। কর্মক্ষেত্র থেকে ফিরে সবকিছুর আগে ভালোভাবে হাত ধুয়ে সুন্দর একটা গোসল অতি প্রয়োজন।

চাহিদা অনুযায়ী বাজারে মাস্ক ও হ্যান্ড স্যানিটাইজারের অপ্রতুলতায় আতঙ্কিত হওয়া ঠিক নয়। হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরিতে বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এগিয়ে এসেছে। প্রশংসনীয় উদ্যোগ। তবে এটি তৈরি করা খুবই সহজ—অ্যালকোহল, হাইড্রোজেন পার–অক্সাইড আর গ্লিসারিন মেশানো। বিশাল জনসংখ্যার এই দেশে ল্যাবরেটরিতে এটা বানিয়ে মানুষের চাহিদা মেটানো অসম্ভব। ইথাইল অ্যালকোহল, আইসো প্রোপাইল অ্যালকোহল অত্যন্ত দাহ্য পদার্থ হওয়ায় ভুলেও বাসায় তৈরির চেষ্টা করা উচিত নয়।

৫.
কোভিড-১৯ মোকাবিলায় যথেষ্ট প্রস্তুতি আছে জেনে দেশের মানুষ কিছুটা আশ্বস্ত হয়েছিল। সংবাদে আজ ভেসে আসে অপর্যাপ্ত টেস্ট কিট, পিপিই, কোয়ারেন্টিনের কথা। নবাবজাদা হয়ে যাওয়ার কথা। তবে সাহস হারানো ঠিক নয়। এই মহামারিতে বড় বড় উন্নত দেশও খুবই হিমশিম খাচ্ছে। এই মহাবিপদে আতঙ্কিত না হয়ে, কোনো রকম গুজব না ছড়িয়ে দেশের সব মানুষকে তাদের নিজ নিজ জায়গায় নিজের দায়িত্বটুকু সঠিকভাবে পালন করা উচিত। আইন মানা। ঘরে থাকা। রোগ না ছড়ানো। শুভ কামনা তোমায়—বাংলাদেশ আর প্রিয় মানুষেরা।

*লেখক: পিএইচডি: রিসার্চ সায়েন্টিস্ট, জৈব রসায়ন। [email protected]