মাদ্দাহ, স্ত্রী-সন্তান হারিয়েও করোনা রোগীদের সেবা দিচ্ছেন

শিল্পীর তুলিতে মুহাম্মদ মাদ্দাহ: স্ত্রী-সন্তান হারিয়েও যিনি করোনায় আক্রান্ত রোগীদের সেবা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেননি। ছবি: সংগৃহীত
শিল্পীর তুলিতে মুহাম্মদ মাদ্দাহ: স্ত্রী-সন্তান হারিয়েও যিনি করোনায় আক্রান্ত রোগীদের সেবা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেননি। ছবি: সংগৃহীত

আকস্মিক করোনাভাইরাসের হামলায় ইরান বিভিন্ন সমস্যায় জড়িয়ে পড়েছে। গত দেড় মাসে ইরানের জনগণ একে একে বিভিন্ন পরিবর্তন দেখেছে। প্রথমে অল্প কয়েকজন ব্যক্তি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ায় সমস্যাটিকে বড় করে দেখা হয়নি, কিন্তু এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে ইরানের মানুষ। করোনা মোকাবিলায় ফ্রন্ট লাইনে থাকা চিকিৎসদের সঙ্গে দেশের সাধারণ জনগণসহ বিভিন্ন আর্থসামাজিক সংগঠন এগিয়ে এসেছে।

দেশের চিকিৎসাকেন্দ্রগুলোতে বিভিন্ন মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের কর্মতৎপরতা লক্ষণীয়। এরই মধ্যে ইরানের কোম শহরের ফোরকানি হাসপাতালে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের সেবায় নিয়োজিত একই শহরের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী হুজ্জাতুল ইসলাম মুহাম্মদ মাদ্দাহ, যিনি ইরানে করোনা মোকাবিলায় তৎপর স্বেচ্ছাসেকদের মডেলে পরিণত হয়েছেন।

মুহাম্মদ মাদ্দাহ যে হাসপাতালে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে নিয়োজিত, ঠিক একই হাসপাতালে তাঁর অসুস্থ গর্ভবতী স্ত্রী রোগশয্যায় ছিলেন। কয়েক দিন আগে হৃদরোগ ও শ্বাসপ্রশ্বাসের সমস্যার কারণে তিনি গর্ভে থাকা দুই সন্তানসহ মারা যান। তিনি যখন স্ত্রী-সন্তানের মৃত্যুর খবর জানতে পারলেন, তখন কোনো চিৎকার বা কান্নাকাটি না করে নীরবে হাসপাতাল থেকে বের হয়ে এসে মাটিতে বসে বসে কাঁদলেন। ইরানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁর মাটিতে বসে কাঁদার ছবিটি ছড়িয়ে পড়েছে। ছবিটি তাঁর অসহায়ত্ব ও ধৈর্যকে তুলে ধরেছে এবং অন্য স্বেচ্ছাসেবকদের প্রেরণাও জোগাচ্ছে।

স্ত্রীর সঙ্গে মুহাম্মদ মাদ্দাহ। ছবি: সংগৃহীত
স্ত্রীর সঙ্গে মুহাম্মদ মাদ্দাহ। ছবি: সংগৃহীত

ইরানের এক সাংবাদিককে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মুহাম্মদ মাদ্দাহ জানান, ‘এশার নামাজের পরে দেখলাম মোবাইলে হাসপাতাল থেকে কয়েকটি ফোন এসেছে। ফোন ব্যাক করলে তারা আমাকে হাসপাতালে যাওয়ার জন্য বললেন। হাসপাতালের আইসিইউতে গিয়ে জানতে পারলাম আমার স্ত্রী সন্তানসহ পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন। অনেক দুঃখ পেলাম। কয়েক দিন থেকে সে রোগশয্যায় ছিল। তাকে নিয়ে অনেক চিন্তিত ছিলাম এবং তার চলে যাওয়ায় বড় ধরনের ধাক্কা পেলাম কিন্তু চেষ্টা করলাম শান্ত থাকার। আমার প্রিয় শিক্ষক আয়াতুল্লাহ বাহজাতের কথা মনে পড়ে গেল, কোনো প্রিয়জন চলে গেলে “ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন” তিনি বলেছিলেন, আমিও সঙ্গে সঙ্গে তা পড়লাম।’

স্ত্রী–সন্তান হারিয়ে কাঁদছেন মাদ্দাহ। ছবি: সংগৃহীত
স্ত্রী–সন্তান হারিয়ে কাঁদছেন মাদ্দাহ। ছবি: সংগৃহীত

হাসপাতালের অবস্থা তো জানেনই, করোনায় আক্রান্ত রোগীরা সেখানে রয়েছে। আর শুধু রোগীরা নয়, বরং চিকিৎসক, নার্সসহ আমার সহকর্মী অনেক স্বেচ্ছাসেবকেরাও সেখানে রয়েছেন। আমি বড় বিপদ অনুভব করলাম, যদি কান্নাকাটি করি, তাহলে করোনায় আক্রান্ত রোগীদের অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যাবে। কারণ, তাঁদের কেউ কেউ জানতেন যে আমার স্ত্রী আইসিইউতে রয়েছে। আমি যদি এখানে কান্নাকাটি করি, তাহলে সবাই মানসিকভাবে দুর্বল হবেন। তাই আল্লাহর ওপর ভরসা করে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করলাম। না কেঁদে স্বাভাবিকভাবে স্বেচ্ছাসেবক বন্ধুদের কাছে গেলাম এবং তাঁদের জানালাম যে আমার অবস্থা ভালো নেই, সে জন্য রাতের ডিউটিতে আসতে পারব না। আমার জায়গায় যেন অন্য কাউকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। কান্না করিনি, কারণ আমার চোখের পানি দেখলে তারা বুঝতে পারবে কিন্তু তাদের কেউ কেউ ইতিমধ্যে সংবাদটি যে পেয়েছে, সেটা বুঝতে পারলাম। আবার দেখা হবে বলে সবার কাছ থেকে বিদায় নিলাম। মূল ভবন থেকে বের হয়ে হাসপাতাল চত্বরের একপাশে, যেখানে কেউ নেই এমন জায়গায় বসে স্ত্রী-সন্তানদের কথা চিন্তা করলাম এবং কাঁদলাম। এমতাবস্থায় কেউ আমার ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছেড়ে দিয়েছেন। তাদের মৃত্যু আমার জন্য একটা বড় ধরনের পরীক্ষা ছিল।’

অন্য স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে মুহাম্মদ মাদ্দাহ। ছবি: সংগৃহীত
অন্য স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে মুহাম্মদ মাদ্দাহ। ছবি: সংগৃহীত

ফোরকানি হাসপাতালের প্রধান ড. হামিদ শাফিয়ি হাসপাতালে স্বেচ্ছাসেবকদের কর্মতৎপরতা সম্পর্কে বলেন, ‘স্বেচ্ছাসেবকেরা তিন শিফটে ভাগ হয়ে ২৪ ঘণ্টা করোনায় আক্রান্ত রোগীদের সেবায় নিয়োজিত। তাঁরা রোগীদের খাবার তৈরিতেও সহযোগিতা করছেন। আগে আমার হাসপাতালে স্বেচ্ছাসেবকদের উপস্থিতির অভিজ্ঞতা ছিল না। তাদের উপস্থিতির কারণে প্রথম দিকে আমিও চাপের মধ্যে ছিলাম। কিছু আস্তে আস্তে বুঝতে পারলাম, স্বেচ্ছাসেবকদের কর্মতৎপরতা ফলপ্রসূ। তাদের করোনা রোগীদের চিকিৎসা ও নিজ নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে আরও বেশি অবগত করার জন্য আমাদের পক্ষ থেকে সংক্ষিপ্ত কর্মশালার আয়োজন করেছিলাম। রোগীদের একটা সমস্যা হলো মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে যাওয়া। স্বেচ্ছাসেবকদের সহযোগিতা তাদের মানসিক অবস্থার পরিবর্তন করতে সহযোগিতা করছে। তারা আশাবাদী হচ্ছে এবং শক্তি ফিরে পাচ্ছে এবং ওষুধও তাদের ক্ষেত্রে ভালো কাজ করছে।’

কোম ইরানের রাজধানী তেহরান থেকে ১২০ কিলোমিটার দূরের এই শহর। বিভিন্ন শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানসহ ধর্মীয় কারণে শহরটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি ইরানে প্রথম এই শহরেই দুজনের শরীরে করোনাভাইরাসের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। এ পর্যন্ত ইরানের বিভিন্ন শহরে ৩৫ হাজারের বেশি মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন আর চিকিৎসক ও স্বেচ্ছাসেবকদের প্রচেষ্টায় সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ১১ হাজারের করোনা রোগী।

*লেখক: শিক্ষার্থী, আল-মোস্তফা আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়, মাশহাদ, ইরান। [email protected]