তিনটি শব্দের এত নির্মমতা

করোনাভাইরাস সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ার পর লকডাউন, সেলফ আইসোলেশন এবং হোম কোয়ারেন্টিন শব্দ তিনটি আগে তেমন শুনেছি বলে মনে করতে পারছি না। সরল ইংরেজি শব্দগুলোর তেমন কোনো ব্যবহার আগে আমার নজরে আসেনি। হয়তো ইংরেজির দুর্বলতাই এর কারণ হতে পারে। তবে এখন আমি বুঝতে শুরু করেছি, শব্দ তিনটির নিষ্ঠুর ব্যবহার।

দুই সপ্তাহ ধরে ঘর থেকে বের হতে পারছি না। কারণ লন্ডন তথা গোটা ব্রিটেন এখন লকডাউন। আমরা নিজ ঘরে সেলফ আইসোলেশনে আছি। এখানে বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া বাসস্থান থেকে বের হওয়া নিষেধ। দুজন লোক একসঙ্গে হতে পারবে না। আদেশ অমান্য করলে জরিমানা করা হবে। এখানে বলে রাখা ভালো যে সরকারের আদেশের আগ থেকে মানুষ বাইরে বের হওয়া কমিয়ে দিয়েছিল।

২৭ মার্চ পর্যন্ত ব্রিটেনে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ১০ হাজারের ওপরে এবং ১ হাজার ১৯ জন মানুষ মারা গেছেন। গত শুক্রবার এক দিনে মারা গেছেন ২৬০ জন, যা এখানকার মানুষকে ভাবিয়ে তুলেছে। সামনের দিনগুলোর অবস্থা কারোরই জানা নেই। এমতাবস্থায় প্রতিদিন দেশের কর্ণধারেরা গণমাধ্যমে লাইভ দিকনির্দেশনা এবং সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের করোনাভাইরাস পজিটিভ হওয়ার কারণে তিনি দুই দিন থেকে লাইভ ব্রিফিং থেকে বিরত আছেন। তবে ব্যক্তিগতভাবে ভিডিও ধারণ করে জনগণের উদ্দেশে কথা বলেছেন।

লকডাউন ও সেলফ আইসোলেশন থাকার কারণে কাজ করতে না পারা মানুষদের জন্য বেতনের ৮০ ভাগ ঘরে বসে পাওয়ার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে এবং সেলফ এম্পলয়েডদেরও ভাতা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। বিভিন্ন দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীরা ও এক্সপার্টরা করোনাভাইরাস নিয়ে বিভিন্ন তথ্যগুলো জনগণকে জানানোর জন্য প্রতিদিন লাইভ প্রেস ব্রিফিং ও সাংবাদিকদের প্রশ্নোত্তর দিয়ে যাচ্ছেন।

ছবি: রয়টার্স
ছবি: রয়টার্স

লকডাউন, সেলফ আইসোলেশন ও হোম কোয়ারেন্টিন শব্দ তিনটির যথাযথ অর্থ এখানকার মানুষ বোঝেন ও তা মেনে চলছেন। এর কারণ হলো তাঁরা সবাই শিক্ষিত এবং অভাব নামের যন্ত্রণা তাঁরা বোঝেন না। সরকার তাঁদের দায়িত্ব নিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশের মানুষগুলো কীভাবে শব্দগুলোর অর্থ বুঝবে! তা আমার মাথায় আসে না। এ শব্দ তিনটির বাস্তব ব্যবহার কত কষ্টের, যে রিকশা চালিয়ে ৫–৬ জনের সংসারের ঘানি টানেন বা যে দিনমজুর এক দিন কাজ না করলে পরিবার–পরিজন নিয়ে উপবাসে কাটাতে হয়, তাঁরা ছাড়া আর কেউ বুঝবেন বলে মনে হয় না। হোম কোয়ারেন্টিন শব্দটি বাংলাদেশের গ্রাম্য মানুষেরা কীভাবে পালন করবেন! তাঁরা পুকুরে গোসল করেন, সম্মিলিত টয়লেট ব্যবহার করেন। যে হারে কাজের অভাবে মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামে চলে যাচ্ছেন, তাতে শহর থেকে গ্রামে বেশি করোনা আঘাত হানবে নিশ্চিত।

লকডাউন, সেলফ আইসোলেশন ও হোম কোয়ারেন্টিন শব্দগুলো যখন আমি মাস দুয়েক আগে শুনি, তখন ভাবিনি এগুলোর কবলে পড়ব। লন্ডনে এই শব্দগুলোর নির্মম বাস্তব প্রয়োগের কবলে পড়ে প্রাণ আমার ওষ্টাগত প্রায়। শব্দগুলোর কঠিন প্রয়োগে আমাদের দেশের মানুষগুলোর কী হাল হবে, তা দেশের কর্ণধারদের ওয়াকিবহাল হওয়া জরুরি নয় কি?