করোনাভাইরাস মোকাবিলায় যা করছে সিঙ্গাপুর

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

সারা বিশ্ব করোনাভাইরাস মোকাবিলার রীতিমতো যুদ্ধ করছে। অনেকগুলো দেশ লকডাউন করে পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছে। সিঙ্গাপুর এখনো লকডাউন করা হয়নি অথচ শুরুর দিকে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যার দিক দিয়ে চীনের পর সিঙ্গাপুরের অবস্থান ছিল।

সিঙ্গাপুর সরকার সফলভাবে মোকাবিলা করছে করোনাভাইরাস। আসুন জেনে নিই কীভাবে করোনাভাইরাস মোকাবিলা করছে সিঙ্গাপুর।

প্রথম যেদিন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়, সেদিনই সিঙ্গাপুর সরকার নড়েচড়ে বসে। তারা করোনাভাইরাস মোকাবিলায় জাতীয় কমিটি গঠন করে। করোনাভাইরাস মোকাবিলা কী করণীয় তার সমস্ত প্রতিষ্ঠানে প্রেরণ করে। এমনকি প্রতিটি কোম্পানি নিজস্ব কমিটি গঠন করে। তারা সরকারি নির্দেশনা মাঠপর্যায়ে পৌঁছানোর জন্য কাজ শুরু করে। সরকারি নির্দেশনা প্রতিটি নাগরিকের কাছে পৌঁছায়।

করোনাভাইরাস মোকাবিলায় তিনটি রিস্ক লেভেল ঘোষণা করেন। রিস্ক লেভেলগুলো হলো ইয়েলা, অরেঞ্জ ও রেড।

* ইয়েলো মানে আক্রান্ত ব্যক্তিরা সবাই সর্বশেষ চীন ভ্রমণ করেছেন। অল্পসংখ্যক লোক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত।

* দ্বিতীয় রিস্ক লেভেল অরেঞ্জ মানে কিছু কিছু স্থানীয় লোক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত, যাদের কেউ চীন ভ্রমণ করেনি কিংবা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কোনো রোগীর সঙ্গে তাদের সংশ্লিষ্টতা নেই।

* সর্বশেষ রিস্ক লেভেল রেড (লাল) অর্থাৎ সারা দেশে বিভিন্ন স্থান থেকে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হলে এবং প্রতিদিন মৃত্যুর সংখ্যা বাড়লেই রিস্ক লেভেল রেড (লাল) ঘোষণা করা হবে। এখন চলছে রিস্ক লেভেল অরেঞ্জ।

লেখক।
লেখক।

এরপর ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন নির্দেশনা জারি করা হয়। আসুন জেনে নিই কী সেই নির্দেশনা।

১.
সদ্য চীন থেকে ফেরত ব্যক্তিদের ১৪ দিনের লিভ অব অ্যাবসেন্সে পাঠানো হয়। এই ১৪ দিন তারা বাসায় থাকবে। তাদের পর্যবেক্ষণ করা হবে। যদি ১৪ দিনের মধ্যে শরীরে করোনাভাইরাসের লক্ষণ দেখা না যায়, তবেই কাজে যেতে পারবে।

২.
প্রতিটি বাস, ট্রেন, ট্যাক্সি এমনকি শপিং মলের সিঁড়ি, লিফট কেমিক্যাল স্প্রে করে ভাইরাসমুক্ত করা হয়।

৩.
স্থানীয় ও অভিবাসী প্রত্যেকের দৈনিক দুবার শরীরের তাপমাত্রা চেক করা হয়।

৪.
কোনো এক গ্রুপের একজন বা কোনো বাসার একজনে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে সে পরিবার বা গ্রুপের সবাইকে আলাদাভাবে ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়। যাতে করোনাভাইরাস ছড়াতে না পারে।

৫.
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের সরকারি খরচে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

৬.
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি সর্বশেষ গির্জায় যাওয়ার কারণে তিনটি গির্জা বন্ধ করে দেওয়া হয়।

৭.
সরকার করোনাভাইরাস মোকাবিলায় বাজেট ঘোষণা করে এবং এমপি, মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতি এক মাসের বেতন করোনা মোকাবিলার জন্য সরকারি তহবিলে অনুদান দেয়।

৮.
সিঙ্গাপুর জনশক্তি মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বিভিন্ন ভাষায় (বাংলা, তামিল, ইংরেজি ও অন্যান্য) সচেতনতামূলক বিভিন্ন লিফলেট বিতরণ করা শুরু করে।

৯.
গৃহকর্মীদের সিঙ্গাপুরে ফিরলে ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিনে থাকা বাধ্যতামূলক করে।

১০.
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে কয়েকজন কয়েকটি মসজিদে নামাজ আদায় করতে যাওয়ার কারণে সিঙ্গাপুরের সমস্ত মসজিদ বন্ধ ঘোষণা করা হয়।

১১.
যেকোনো দেশ থেকে সিঙ্গাপুরে এলে তাকে বাধ্যতামূলক ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে। এই নিয়ম সিঙ্গাপুরে বসবাসকারী স্থানীয় ও অভিবাসী সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য করা হয়।

১২.
গৃহকর্মী যারা ছুটিতে আসে, তাদের সিঙ্গাপুরে ফিরতে হলে জনশক্তি মন্ত্রণালয় থেকে অনুমতি নিতে হবে। এবং বর্তমান অবস্থার উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত তাদের ছুটিতে দেশে যাওয়া নিষেধ করা হয়।

১৩.
সমস্ত ওয়ার্ক পাস হোল্ডার, এমনকি ডিপেনডেন্ট পাস হোল্ডারদের সিঙ্গাপুরে ঢুকতে হলে সিঙ্গাপুরের জনশক্তি মন্ত্রণালয়ের অনুমতি লাগবে। সিঙ্গাপুরে প্রবেশের পর বাধ্যতামূলক ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে।

১৪.
ভ্রমণের ক্ষেত্রে কয়েকটি দেশে কড়াকড়ি নির্দেশনা জারি করে। চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, ইরান, ইতালি, ফ্রান্স, জার্মানি, স্পেন, জাপান, সুইজারল্যান্ড, ইংল্যান্ড এবং আসিয়ান দেশসমূহ থেকে সিঙ্গাপুরে ফিরলে বাধ্যতামূলক ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিনে থাকা বাধ্যতামূলক করে।

তা ছাড়া চীন, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, ইরান, দক্ষিণ কোরিয়া ও স্পেন এই ৭টি দেশ থেকে সিঙ্গাপুরে ভ্রমণ কিংবা ট্রানজিট করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়।

১৫.
সিঙ্গাপুরে ফিরলে যেকোনো দেশের নাগরিককে ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিনে থাকা বাধ্যতামূলক করা হয়।

১৬.
সিঙ্গাপুরে প্রবেশ করতে হলে সমস্ত ওয়ার্ক পাস হোল্ডার, এমনকি ডিপেনডেন্ট পাস হোল্ডারদের সিঙ্গাপুরের জনশক্তি মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিতে হবে এবং সিঙ্গাপুরে প্রবেশের পর বাধ্যতামূলক ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে।

১৭.
TraceTogether নামে মোবাইল অ্যাপ চালু করা হয়। এর মাধ্যমে খুব সহজেই কনন্ট্রাক ট্রাক করা যাবে। অর্থাৎ ব্যবহারকারী কোন করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে গেলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে তার সঙ্গে যোগাযোগ করে পরিবর্তী করণীয় জানানো হবে।

১৮.
কোন ওয়ার্ক পাস হোল্ডার যদি দেশে যায়, তবে তার নিজ দায়িত্বে যেতে হবে। এই পরিস্থিতিতে কোন ওয়ার্ক পাস হোল্ডার দেশে গেলে পরিবর্তীতে তারা আর সিঙ্গাপুরে ফিরতে পারবে না।

১৯.
সিঙ্গাপুরে যেকোনো দেশের ভিজিটর প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।

২০.
সিঙ্গাপুরের সমস্ত বিনোদন কেন্দ্র, বার, অডিটোরিয়াম বন্ধ ঘোষণা করা হয়।

২১.
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস, এমনকি খাবার টেবিলে একসঙ্গে ১০ জনের বেশি বসা যাবে না।

২২.
অফিস, রাস্তাঘাট, শপিং মল, সব জায়গায় একজন থেকে আরেকজন এক মিটার দূরত্বে থাকতে হবে। এই সামাজিক দূরত্ব (Social distance) বজায় রাখতে ব্যর্থ হলে ১০ হাজার ডলার বা ৬ মাসের জেল অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে হবে।

সর্বশেষ করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সিঙ্গাপুর সরকার ৪৮ বিলিয়ন ডলার সহায়তা তহবিল ঘোষণা করেছে।