হোম কোয়ারেন্টিনে গুজব

বেলা সাড়ে ছয়, সাত, আট। বারবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ছটফট করি। ছেলেমেয়েদের কোনো সাড়াশব্দ নেই। স্কুল যাওয়ার কোনো তাড়া নেই। ১২টা মনে করার চেষ্টা করি।

সহধর্মিণী বলল, তোমার জব নেই আজ। মনে ছিলই না ইউকে প্রাইম মিনিস্টার বরিস জনসন ঘোষণা করেছেন দেশে জরুরি অবস্থা। ভয়ংকর পরিস্থিতি। স্টে হোম সেভ লাইফ। পরিবার–পরিজন নিয়ে ঘরে থাকার আদেশ। মানবেতিহাসে এ এক কঠিন সময়। করোনার প্রভাবে টালমাটাল বিশ্ব পরিমণ্ডল। বিপর্যস্ত জনপদ। মৃত্যুর মিছিলে প্রতিনিয়ত গাণিতিক হারে নতুন সংযোজন।

বাইরে তাকিয়ে দেখি, উজ্জ্বল আকাশে রোধের খেলা। মেঘের কোনো আনাগোনা নেই। গাছে গাছে নতুন কুঁড়ি, সাদা নীল লাল। মানুষের ছোটাছুটি, স্কুলগামী ছাত্রছাত্রীদের বাসের অপেক্ষা, রাশ আওয়ারের গাড়ির ভিড়—কোনো কিছুই চোখে পড়েনি। অপ্রত্যাশিত নীরবতা, মনে হয় সুনামিবিধুত কোনো নগরীতে আমাদের বাস।

জরুরি অবস্থার কারণে শুধু ফার্মেসি এবং সুপার মার্কেট খোলা আছে। গৃহকর্ত্রীর পরামর্শে তড়িঘড়ি করে সুপার মার্কেটে গিয়ে দেখি মানুষের ভিড়। প্যারাসিটামল থেকে চাল, ডাল, তেল নিত্যপ্রয়োগজনীয় কিছুই নেই। টয়লেট রোলের আকাল। বেহাল পরিস্থিতি। কিছুক্ষণ পরপর গৃহিণীর জিজ্ঞাসা, কি পেয়েছ? অগোছালোভাবে ট্রলি ভরতে থাকি আলু, চিনি, টিনজাত খাবার। কাউন্টারে এসে বাদ সাধে সব নেওয়া যাবে না। প্রতি আইটেমে তিনটির বেশি নয়। নো ক্যাশ পেমেন্ট, কাড আনলি। নোটে করোনা ছড়ায় গাণিতিক হারে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিধি মেনে সোশ্যাল দূরত্ব বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি। সবচেয়ে দ্রুত ভাইরাস ছড়ায় মানুষের ক্লোজ সংস্পর্শ থেকে। নিজ বাসায় থাকা। মানুষের সংস্পর্শে না যাওয়া। একটু পরপর হাত ধোয়া। প্রতিটি কিছু ছোঁয়ার পরে হাত ধোয়া। সম্ভব হলে একটু পর পর হাত স্যানিটাইজিং করা। এভাবে চলে আমাদের সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি। সবচেয়ে কঠিন ব্যাপার হলো বাচ্চাদের দেখাশোনা। স্কুল বন্ধ হওয়ায় চার দেয়ালের বন্দী সময়টুকু দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতম হয়। এ সময়ে বাচ্চাদের ব্যস্ত রাখা অত্যন্ত জরুরি। অনলাইন পড়ার ফাঁকে ফাঁকে খুব অল্প সময়ে বোর হয়ে যায়।

একটু পরপর আমার মেয়ে—
ড্যাডি, আই ফিল বোর!
চলো লুডু খেলি
না, আই লাইক ব্রালান্ডস ম্যান বাথ (কানামছি)।
ছেলের বায়না—
ব্যাক গার্ডেনে ফুটবল খেলা
অথবা ক্রিকেট
কনকনে ঠান্ডার প্রকোপ এখনো যায়নি। বাতাসের আর্দ্রতায় শীতের তীব্রতা দিগুণ। এর মধ্যে গৃহকর্ত্রীর ফরমাশে ব্যাক গার্ডেনের ঘাস কাটা। গার্ডেন পুকুরের অগাছা পরিষ্কার করা, গোল্ডফিশগুলো নাড়াচাড়া করা। গার্ডেনের মাটি কোপানো, আগাম রোপণ করা হলো আলু, মুলা, পিঁয়াজ, ধনিয়ার বীজ।

করোনার অনিচ্ছাকৃত সময় যেন কাটতে চায় না। বিড়বিড় করে গান করি, কাটে না সময় যেন আর কিছুতে। এভাবে সময় গড়িয়ে যায় দিনের পর রাত। নেট ফ্লিলিক্সে বাচ্চাদের নিয়ে লেটনাইট পর্যন্ত মুভি দেখা।

হোম কোয়ারেন্টিন। এ এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা। সবচেয়ে অবাক লাগে আশপাশের সাদা মানুষের পদচারণ দেখে। কোনো সাড়াশব্দ নেই। উকেন্ডের কোনো সরব কোলাহল নেই। সরাইখানাগুলো পুরোপুরি বন্ধ। করোনাভাইরাস সবার মনে এক অজানা ভয় কাজ করে। সাম্প্রতিক ইউকে চিফ মেডিকেল অফিসার ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, যদি ইউকে মৃতের সংখ্যা ২০ হাজারের নিচে রাখা যায়, তখনই আমরা সফল। মনে হচ্ছে, করোনাভাইরাসের এক ভয়াবহ পরিণতির জন্য ইউকেবাসী তৈরি হচ্ছে।

তবে লকডাউনকে নেতিবাচকভাবে নেওয়া মানসিকতা প্রত্যেকের থাকা উচিত। নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা এবং অন্যকে সংক্রমণ থেকে রক্ষা করা। হোম কোয়ারেন্টিনের এ অফুরান অবসরে ফ্যামিলিকে সময় দেওয়ার এ এক মোক্ষম সময়। নিজেকে ব্যস্ত রাখার জন্য রান্নার কাজে গৃহিণীকে সাহায্য করা যেতে পারে।

ইদানীং বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে করোনাভাইরাস নাকি বাতাসে উড়াল দিতে শিখেছে। তারা অনেক সময় ধরে বাতাসে থাকতে পারে। আগে করোনা উড়াল দিতে জানত না। তাই আজ থেকে দরজা–জানালা সব বন্ধ। আলো–বাতাসের কোনো প্রয়োজন নেই। বাইরে যাওয়া টোটালি নিষেধ। ব্যাক গার্ডেনের দরজা লক। করোনার এ গুজব এবং সংকটের পরিত্রাণ কোথায়?