পরী বানু

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

‘ও পরী, কই গেলিরে মা?’ মেয়েকে না দেখতে পেয়ে হাঁক ছাড়লেন ফুলজান বেগম। পরী বানু দুপুরে খাওয়ার পরই বেরিয়ে গেছে। কে জানে কোথায় গেল মেয়েটা? এদিকে আকাশে ঘন মেঘ। মায়ের মন চিন্তায় অস্থির হয়ে ওঠে।

একটু পরেই দেখা মেলে পরীর। কাঁখে বেতের ঝুড়িভর্তি চাল। ‘কি রে, এতক্ষণ কোথায় ছিলি?’ পরীর হাত থেকে ঝুড়ি নিতে নিতে জিজ্ঞেস করেন ফুলজান বেগম।

‘জরিনা চাচির বাড়ি ছিলাম মা।’ শাড়ি থেকে খড়ের টুকরো ঝাড়তে ঝাড়তে উত্তর দিল পরী। ‘চাচি ধান ভাঙাতে ডাকল, আমি আর মানা করিনি।’

ফুলজান হাসেন। আপাদমস্তক শহুরে মেয়ে পরী বানু এতটা গ্রাম্য ললনা হয়ে উঠল কী করে, ভেবে পান না তিনি। কিছুদিন আগে পরীর বাবা মারা যাওয়ার পর মেয়েকে নিয়ে গ্রামে চলে এসেছিলেন তিনি। অল্প কয়েক দিনেই পরী গ্রামের একজন হয়ে উঠেছে। শহুরে পোশাক ছেড়ে ছাপা সুতির শাড়ি পরতে শিখেছে। পায়ের নূপুর ঝমঝমিয়ে এ-বাড়ি ও-বাড়ি দৌড়ে বেড়ায় পরী বানু। কারও বাড়ির ধান শুকানো হয়েছে, ঢেঁকির ওপর পরীকেই নাচতে দেখা যায়। কোনো বাড়ির মেয়ের সন্তান প্রসবের সময় হয়েছে, খবর পেয়ে সাহায্য করতে ছুটে যায় পরী। খেজুর, নারকেল আর আম-কাঁঠালের গাছের ছায়াঘেরা গ্রামটির ওপর মায়া পড়ে গেছে মা-মেয়ের। ফুলজান ভালোবাসেন মেয়ের মিশুক স্বভাব। বাধা দেন না কিছুতে।

‘তোমার মেয়ে যে বাড়িতে যাবে, ঘর আলো করে থাকবে গো।’ গ্রামের বউ-ঝিদের কথায় খুশি হন ফুলজান বেগম। মা হয়ে তিনিও চান একটা ছোট্ট সুখের সংসার হোক পরী বানুর।

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

কিন্তু চারপাশে কেমন যেন থমথমে পরিবেশ। ফুলজান শুনেছেন, সেদিন শেখ সাহেব (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান) অনেক কথা বলেছেন রেসকোর্স ময়দানে। বলেছেন, ‘এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ শহর-গ্রাম সব জায়গার মানুষ যেন খেপে উঠেছে শেখ সাহেবের ভাষণ শুনে। কেউ চায় না পশ্চিম পাকিস্তানে থাকতে। পৃথিবীর মানচিত্রের বুকে এক নতুন দেশ, বাংলাদেশ, সৃষ্টি করতে চায় সবাই।

ফুলজান ভয়ে কেঁপে ওঠেন সব খবর শুনে। আসলেই যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে দেশে। ছেলেরা দলে দলে যোগ দিচ্ছে মুক্তিযুদ্ধে। নিজেদের অল্পস্বল্প অস্ত্রশস্ত্র যা আছে তাই নিয়েই লড়ছে শত্রুসেনার বিরুদ্ধে। পাকিস্তানি মিলিটারি ইতিমধ্যে ঢুকে পড়েছে শহরে। ছোট ছোট শিশুদের বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে মারছে। ক্যাম্পে তুলে নিয়ে যাচ্ছে অল্পবয়সী মেয়েদের। সর্বস্ব লুটে নিয়ে ছুড়ে ফেলে দিচ্ছে শিয়াল-শকুনের খাবার হওয়ার জন্য।

সব শুনে প্রায় আত্মা উড়ে যায় ফুলজানের। তাঁর আদরের পরী বানু! ওর সঙ্গেও যদি এমন ঘটে? পরী যে বিধবা মায়ের একমাত্র সম্বল!

ধীরে ধীরে শহর ছেড়ে এবার গ্রামেও মিলিটারি ঢোকার খবর পাওয়া যেতে থাকে। পরীকে একদম বাড়ির বাইরে পা দিতে নিষেধ করেছেন ফুলজান। তবে দস্যি মেয়ে কথা শুনলে তো? এখনো সুযোগ পেলেই এ-বাড়ি ও-বাড়ি দাপিয়ে বেড়ায় পরী। এর মধ্যে খবর পেয়েছেন ফুলজান, জরিনার ছোট ছেলেটা নাকি যুদ্ধে গেছে মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে। এখন চারদিকে গুলির শব্দ প্রায়ই শোনা যায়।

একদিন রাতে ঘরের ভেতরেই এক কোণে মাটির চুলায় ভাত বসিয়েছিলেন ফুলজান। ভাত আর আলু ভর্তায় দুটো পেট ঠিক ভরে যাবে। পরী মায়ের পাশে বসে পেঁয়াজ কাটছিল ভর্তায় দেবে বলে। আচমকা দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে চমকে ওঠে পরী।

‘খবরদার দরজা খুলবি না, আমি দেখছি।’ ধমকে পরীকে খাটের তলায় ঢুকিয়ে দেন ফুলজান। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলেন: ‘কে ...কে?’

দরজার ওপাশে কণ্ঠস্বরটা পরিচিত। ‘খালাম্মা, খোলেন, আমি খোকা।’ খোকা, মানে প্রতিবেশী জরিনার ছেলে। দরজা খুলে খোকার সঙ্গে পরিচিত আরও দুজনকে দেখতে পান ফুলজান। এ ছেলেগুলোকে ছোট থেকে চেনেন তিনি। সবাই মুক্তিযোদ্ধা।

‘মায়ের কথা মনে পড়ছিল, তাই অন্ধকারে মাকে একনজর দেখেই চলে এসেছি।’ শুকনো কণ্ঠে বলে খোকা। ‘বাড়িতে ঢুকলে মা আর বের হতেই দেবেন না যে!’ ‘সেটাই তো স্বাভাবিক, তাই না?’ স্নেহার্দ্র স্বরে বললেন ফুলজান।

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

সেদিন রাতে মা-মেয়ের রান্না করা আলু ভর্তা আর ভাতে পেট ভরে খোকা আর তার দুই বন্ধুরও । তবে পুব আকাশে আলো ফোটার আগেই বেরিয়ে যায় ওরা। ফুলজান গামছায় বেঁধে একটু শুকনো চিড়া আর পাটালি গুড় দেন ওদের সঙ্গে। এরপর থেকে মাঝেমধ্যে রাতের আঁধারেই পরীদের বাড়িতে আসত খোকা তার দুই বন্ধু নিয়ে। ঘরে থাকা জাউ দিয়েই রাতের খাবার সারত তারা। ফুলজানের নিজের কোনো ছেলে ছিল না। তিনি নিজের ছেলের মতোই স্নেহ করতেন খোকাকে।

কিন্তু বিধি বাম! একদিন রাতে খেয়ে সবে শুয়েছে মা-মেয়ে, দরজায় ধুমাধুম ধাক্কা! পরীর মনে হলো কেউ যেন লাথি মারছে দরজায়। খোকা আর যা-ই করুক, লাথি মারবে না। ফুলজান মেয়েকে খাটের তলায় ঢুকিয়ে দিলেন। দরজা খুললেন না কিছুতেই, তবে শেষ রক্ষা হলো না। স্বাস্থ্যবান দুই পাকিস্তানি সেনার বুটের আঘাতে খসে পড়ল হালকা কাঠের দরজা।

‘ঘরমে অর কোই হ্যাঁয় (বাড়িতে আর কেউ আছে)?’ গোঁফ নাচিয়ে প্রশ্ন করল খাকি পোশাকের পাকিস্তানি সেনা।

‘না না.. বাড়িতে আর কেউ নেই।’ ভয়কে মনে চেপে দৃঢ় কণ্ঠে বললেন ফুলজান। ‘আমি একা।’

‘ঝুট বোল রাহি হ্যাঁয় আপ! সাঁচ বাতাইয়ে! (মিথ্যা বলছেন আপনি! সত্যিটা বলুন!)’ বলতে বলতে ফুলজানের তলপেটে সজোরে লাথি মারল এক পাকিস্তানি সেনা। অচেতন হয়ে পড়লেন ফুলজান বেগম।

এতক্ষণ খাটের তলা থেকে সব দেখছিল পরী বানু। মায়ের এই অবস্থা দেখে আর সহ্য করতে পারল না সে। খাটের তলায় রাখা শুকনো মরিচের গুঁড়া থেকে এক মুঠো নিয়ে ছুড়ে দিল দুই পাষণ্ডের দিকে। এটাই কাল হলো। পরীকে পা ধরে টেনে বের করল ওরা। এক টানে পরীর গায়ের শাড়িটা খুলে ফেলল একজন। পরী বানু দাঁত বসিয়ে দিল একজনের হাতে, লাথি চালাল। তবে পাকিস্তানি সেনাদের গায়ে যে অসুরের শক্তি!

লালসা মিটিয়ে অর্ধ-উলঙ্গ পরীর দেহটা বাড়ির উঠানে কচি ঘাসের ওপর ছুড়ে ফেলল দুই পাষণ্ড। বুলেটে ঝাঁজরা করে দিল ওর শরীর। ঘাসের ওপর নিজের রক্তের নদীতে নিথর পড়ে রইল পরী বানু। ঠিক সবুজের বুকে লাল সূর্যের মতো।

উৎসর্গ: নাম না জানা সেই অসংখ্য বীরাঙ্গনাদের, যাঁদের সম্ভ্রমের বিনিময়ে স্বাধীন বাংলাদেশের সৃষ্টি।

27th March, 2020