ইতালি - যেখানে এখন বিষাদ খেলা করে

বসন্তে ফুটেছে ফুল। ছবি: লেখক
বসন্তে ফুটেছে ফুল। ছবি: লেখক

ইতালিতে বসন্তকাল শুরু হয়েছে বেশ কদিন হতে চলল। কিছুদিন আগেও যেসব গাছে কোনো পাতা ছিল না, কেবল কাণ্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট-বড় সব গাছকেই মৃত মনে হতো। মাঠের সবুজ, গাছের ফুল কোনো কিছুই ছিল না। অথচ বসন্ত আসতেই আবার সবুজে- ফুলে-পাতায় ভরে উঠছে চারপাশ। বসন্তের হিমশীতল বাতাস বইছে। তবে, এবারের বসন্তকাল আগের বসন্তকালগুলোর মতো নয়। আগের বসন্তকালগুলোয় যেমন প্রাণের স্পন্দন থাকে, এবারে তা নেই। মানুষ এবার আসেনি বসন্তকে বরণ করে নিতে। করোনার ছোবলে সবকিছু যেন এলোমেলো। ইতালির আমুদে-ফুটবলপ্রিয়-হাসিখুশি জনতাকে এবারে বিষণ্নতার খাঁচায় আবদ্ধ করেছে করোনা।

বসন্তে ফুটেছে ফুল। ছবি: লেখক
বসন্তে ফুটেছে ফুল। ছবি: লেখক

ইতালির মানুষ মূলত যে আনন্দপ্রিয়, তার দেখা পাওয়া যেত সবখানে। বাইরে বেরোলেই ফুটপাতে কিংবা পার্কে মানুষের দৌড়ানো কিংবা একটু বয়স্ক লোকের সঙ্গে একটা কুকুর রশিতে বাঁধা। কুকুর সঙ্গে নিয়ে হেঁটে চলেছেন, এ রকম মানুষের সংখ্যা কম চোখে পড়ে না। কম বয়সীদের অনেককেই বাইক কিংবা দৌড়ে চলেছে কানে হেডফোন গুঁজে। বিনোদন এবং পর্যটনকেন্দ্রগুলোতেও মানুষের ঢল নামত। থিয়েটারে কোনো বিশেষ শো কিংবা জাদুঘরগুলোতে দেশি-বিদেশি ভ্রমণপিপাসুদের ভিড় লেগেই থাকত। সেসব পার্ক ও পর্যটনকেন্দ্র সবখানেই এখন সুনসান নীরবতা। যে সড়কে প্রতিদিন হাজার হাজার গাড়ি ছুটে চলে শতাধিক কিলোমিটার গতিতে, সেসব সড়ক এখন খালিপ্রায়; মাঝেমধ্যে সাইরেন বাজিয়ে ছুটে চলছে অ্যাম্বুলেন্স। ব্যক্তিগত গাড়ি দু-একটি। বিগত কয়েক দিন জানালার পর্দা সরিয়ে তাকিয়ে থাকি সড়কটার দিকে। কোনো দিন একটি পাবলিক বাস চোখে পড়েছে, কিন্তু খালি, একজন যাত্রীও নেই। কোনো দিন হয়তো পাবলিক বাস চোখেই পড়েনি।

ফুটে আছে সুন্দর ফুল। ছবি: লেখক
ফুটে আছে সুন্দর ফুল। ছবি: লেখক

বাংলাদেশের রাস্তার মোড়ে মোড়ে মুদিদোকানের মতো এখানেও দোকান আছে অনেক। তবে মূলত বার এবং মদের দোকান। কাজ থেকে ফিরে পানীয় নিয়ে ঘরে ফিরতেন মানুষ, কেউবা রাত অবধি বারে কাটিয়ে দিতেন। আবার কখনো কখনো মেতে উঠতেন সংগীতসন্ধ্যায়। সেসব মুখরিত বার কিংবা সংগীতমঞ্চ আজ পুরোনো দিনের ভুতুড়ে বাড়ি যেন। জাদুঘরগুলোতে দেশি-বিদেশি মানুষের আনাগোনা ছিল নিয়মিত, করোনায় লকডাউনের প্রথম দিন থেকেই মিউজিয়াম, সিনেমা হল বন্ধ ঘোষণা করা হয়। সেগুলোতে হয়তো নিঃশব্দ হাহাকার এখন। বন্ধুবৎসল মানুষেরা চেনা-অচেনা যে কাউকে দেখলে হাসিমুখে সম্ভাষণ জানাতেন, আর এখন দেখা হলেও সম্ভাষণে সে মাধুর্য নেই এবং নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে সংক্ষেপে কথা শেষ করছেন।

তুরিনের রাস্তা। ছবি: লেখক
তুরিনের রাস্তা। ছবি: লেখক

এ দেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিদিনের প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, এখনো মৃত্যুর সংখ্যা কমার নাম নেই। সাড়ে ছয় কোটি জনবসতির দেশটিতে করোনার ছোবল থামবে কবে, তার নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারছেন না। হয়তো থামবে ঠিকই, আবার জনপদে ফিরবে জনতার পদচারণ, প্রাত্যহিক ব্যস্ততায় ডুববে মানুষ। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এত বড় আঘাতে জর্জরিত ইতালির মানুষের আপনজন হারানোর শোক এবং সব ধকল সামলে উঠে বর্তমানের বিষণ্নতার দেয়াল ভাঙতে পারবে কবে, তা এখনো অজানা।