জরুরি কমিউনিটি কাজের ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান

করোনাভাইরাস মানুষকে একসঙ্গে থাকতে দিচ্ছে না, এর সঙ্গে সহমত। তবুও কি আমরা একবার ভেবে দেখতে পারি, কীভাবে আমরা একসঙ্গে থাকতে পারি? আমরা কি একটু ভিন্নভাবে চিন্তা করতে পারি? আমি এসব নিয়ে নিচে লিখেছি, যদি ভালো মনে করেন, প্লিজ এগুলো অনুসরণ করুন। হয়তো ভাইরাস এটাই পরীক্ষা করছে, আমরা কতটুকু মহানুভব!

আমি কিছু কমিউনিটি (এই দুর্দিনে আশপাশের সবাইকে ধর্ম–বর্ণনির্বিশেষে মানুষ হিসেবে শ্রদ্ধা করাটাই কমিউনিটি) ম্যানেজমেন্ট প্র্যাকটিস নিয়ে নিচে লিখেছি, যদি ভালো মনে করেন, তাহলে কাজগুলো করে দেখতে পারেন। আমার নিজের কাজের ম্যানেজমেন্ট প্র্যাকটিস থেকে এই কথাগুলো লিখলাম, হয়তো এর মাধ্যমে আমরা করোনার প্রভাব বিস্তার রোধ করতে ও অনেকগুলো জীবন বাঁচাতে পারব। আমার এই লেখার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে ‘আমাদের একজনকে আরেকজনের দেখাশোনা করতে হবে জরুরি কাজ ব্যবস্থাপনা করার জন্য। সরকার ও বাকি প্রতিষ্ঠানগুলো এই সব ব্যবস্থা আমাদের জন্য করে দিতে পারবে না। এগুলো আমাদের করে নিতে হবে। আমরা এটাও জানি না, দেশের এই অবস্থায় কতজন মানুষ মানসিক দুশ্চিন্তায় আছেন। এই প্ল্যান আমাদের সবাইকে একসঙ্গে কঠিন সময় মোকাবিলায় শক্তি জোগাবে। এতে আমাদের মধ্যে সম্পর্ক ভালো হবে, আমাদের মধ্যে মানবিক বন্ধন আরও বেশি দৃঢ় হবে।

আমি এখানে মোটামুটি সবকিছু ব্যাখ্যা করেছি এবং আমি আপনাদের অনলাইনে, অর্থাৎ ফেসবুক, মেসেঞ্জার, ইমো, হোয়াটসঅ্যাপে এ বিষয়ে কাউন্সেলিং দিতে পারব, কীভাবে আরও বেশি ভালোভাবে আপনার কমিউনিটি প্ল্যান সেটআপ করা যায়। এই দুর্দশায় ঘরে থাকার পাশাপাশি জরুরি কাজগুলোর ব্যবস্থাপনায় আমাদের টেকনিক্যাল ও ব্যবস্থাপনা কৌশলগুলো কাজে লাগিয়ে করোনার সংক্রমণের প্রভাব কমাতে হবে এবং এটা সম্ভব যদি আমরা একসঙ্গে কাজ করি। মনে রাখতে হবে, আমাদের কাছে প্রতিরক্ষার সরঞ্জাম খুবই সীমিত, তাই আমি এই কৌশলগুলো কাজে লাগানোর জন্য লিখছি।

যেসব এলাকায় স্বেচ্ছাসেবক কমিউনিটি জরুরি কাজ করে দিচ্ছেন, সেখানে এই প্র্যাকটিসগুলোর দরকার নেই। আমাদের দেশের বড় শহরগুলোতে বসবাসের স্থান বেশির ভাগই দালানকোঠা। এ রকম একটি বিল্ডিংয়ে কমপক্ষে ২০-৩০ পরিবার বসবাস করে। প্রতিটি বিল্ডিংয়ে দুই বা তিনজন ব্যাচেলর ছেলে বা মেয়েরা যদি একসঙ্গে এগিয়ে এসে সব পরিবারগুলোর লিস্ট নিম্নলিখিতভাবে বানিয়ে ধাপগুলো অনুসরণ করেন, তাহলে হয়তো আমরা এখনো সবাই একসঙ্গে থেকে এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারব।

পরিবার টাইপ ১ - একজন বয়স্ক মানুষ
পরিবার টাইপ ২ - দুজন বা বেশি বয়স্ক মানুষ
পরিবার টাইপ ৩ - একজন অন্তঃসত্ত্বা মা
পরিবার টাইপ ৪ - কমপক্ষে একজন অন্তঃসত্ত্বা মা + কমপক্ষে একজন বৃদ্ধ
পরিবার টাইপ ৫ - তরুণ স্বামী/ স্ত্রী
পরিবার টাইপ ৭ - স্বামী/ স্ত্রী + শিশু
পরিবার টাইপ ৮ - স্বামী/ স্ত্রী + যুবক
পরিবার টাইপ ৯ - ব্যাচেলর
পরিবার টাইপ ১০ - দারোয়ান

এবার পরামর্শ অনুযায়ী একটা তালিকা করে নিন। তালিকাগুলো হবে জরুরি (ইমার্জেন্সি) অবস্থার জন্য। কারণ, সবকিছু বন্ধ হয়ে গেলে কমিউনিটি ইমার্জেন্সি ব্যবস্থাপনা প্ল্যান আমাদের করে রাখতে হবে।

যাঁরা এই স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করবেন, তাঁদের নাম হবে ‘ক্যাপ্টেন’।

ক্যাপ্টেন কী করবেন?
এই প্রস্তাবিত জরুরি ব্যবস্থাপনা প্ল্যানের একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে, ‘ক্যাপ্টেন’ সাহায্য করবেন কমিউনিটির জরুরি কাজ সম্পন্ন করায়। সব ক্যাপ্টেন নিজেদের মধ্যে কাজ ভাগ করে নেবেন এবং প্রতিটি পরিবারকে জানিয়ে দেবেন কোন ক্যাপ্টেন কোন ফ্ল্যাটের জন্য। ক্যাপ্টেনরা নিজেদের মধ্যে প্রতিটি জরুরি কাজ সম্পন্ন করার জন্য রিসোর্স প্ল্যান করে নেবেন। যেমন আশপাশের ফার্মেসির মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করবেন, ফার্মেসির লোকজনের সঙ্গে কথা বলে তাঁদের ডেলিভারি কীভাবে হয়, সেটা জানার জন্য। এ রকমভাবেই অ্যাম্বুলেন্সের ফোন নম্বর, রেস্তোরাঁ কোথায় আছে, রেস্তোরাঁর ডেলিভারি প্ল্যান, কমিউনিটিতে কার নিজস্ব গাড়ি আছে, ডাক্তারদের ফোন নম্বর হাতে রাখা, ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ ও প্রতিরক্ষা বাহিনীর ফোন নম্বর সংগ্রহের মতো কাজগুলো করতে হবে। ক্যাপ্টেনদের ভালো কোলাবোরেশনই যেকোনো জরুরি কাজ সম্পন্ন করার জন্য সহায়ক হবে। এভাবে কাজ করতে পারলে আমরা করোনার অনেক খারাপ প্রভাব প্রতিরোধ করতে পারব।

১.
লিস্ট তৈরি করে বিল্ডিংয়ের সবাইকে বুঝিয়ে বলতে হবে, আপনি কী করছেন। কীভাবে বুঝিয়ে বলবেন? প্রথমত, দারোয়ান থেকে একটা ফ্ল্যাটের একজন পুরুষের নম্বর নিন, তাঁর সঙ্গে কথা বলুন। তাঁকে বুঝিয়ে বলুন, আপনি কীভাবে সাহায্য করবেন। তাঁর মতামত পেলে তাঁর কাছ থেকেই অন্য আরেকটা ফ্ল্যাটের আরেকজন পুরুষের নম্বর নিন। তাঁকে প্রথম ফ্ল্যাটের ব্যক্তির রেফারেন্স দিয়ে কথা বলুন। এভাবে আপনি তাঁদের নাম ও মোবাইল নম্বরগুলো সংগ্রহ করবেন।

২.
এরপর বানিয়ে ফেলুন একটা হোয়াটসঅ্যাপ (WHATSAPP) গ্রুপ। এই গ্রুপের মাধ্যমে সবাইকে জানিয়ে দিন সেই ফ্ল্যাটের জন্য ক্যাপ্টেনের নাম ও মোবাইল নম্বর।

৩.
লিস্ট অনুযায়ী ক্যাপ্টেনরা প্রতিটি ফ্ল্যাটের দায়িত্ব ভাগ করে নেবেন।

৪.
ক্যাপ্টেন সরকার ও কর্তৃপক্ষের জরুরি মোবাইল ও ল্যান্ডলাইন নম্বরগুলো সংগ্রহ করবেন এবং এগুলো সব ফ্ল্যাটের পয়েন্ট অব কনটাক্টের সঙ্গে শেয়ার করবেন।

৫.
ক্যাপ্টেন লিস্ট অনুযায়ী সব ফ্ল্যাটের ‘জরুরি মেডিসিন’–এর একটা লিস্ট বানাবেন। লিস্টে মেডিসিনের নাম, জেনেরিক নাম, ব্র্যান্ড নাম, ডোজ, পরিমাণ লিখে রাখতে হবে। ফ্ল্যাটের ব্যক্তিকে বলতে হবে, প্রতিটি মেডিসিন কতদিন পর্যন্ত চলবে, সেটার একটা ধারণা দিতে।

৬.
এবার ক্যাপ্টেনরা একটা সম্মিলিত লিস্ট (গুগল শেয়ার শিট দিয়ে বানিয়ে নিন, তাহলে সবাই দেখতে পাবেন এবং সবাই একসঙ্গে কাজ করতে পারবেন) তৈরি করবেন, যেখানে তাঁরা দেখবেন কোন ফ্ল্যাটে কখন মেডিসিনগুলো লাগবে এবং তাঁরা এটাও দেখবেন যে অন্য ফ্ল্যাটে কমন মেডিসিন আছে কি না। ফ্ল্যাটের ব্যক্তিদের বুঝিয়ে বলতে হবে যে এটা ইমার্জেন্সি প্ল্যান, তাই কারও কাছে অতিরিক্ত থাকলে সেটা দিয়ে যদি অন্য কাউকে বাঁচানো যায়, সেটাই হচ্ছে আপনাদের উদ্দেশ্য।

৭.
ক্যাপ্টেনরা এভাবে সব জরুরি কাজের পরিকল্পনা করবেন। মনে রাখতে হবে, পরিকল্পনা হচ্ছে সাফল্যের অন্যতম চাবিকাঠি।

ক্যাপ্টেন কীভাবে কাজ করবেন?
১.
প্রতিটি ফ্ল্যাটের জন্য নির্ধারিত ক্যাপ্টেন ওই ফ্ল্যাটের জন্য প্রথম পয়েন্ট অব কনটাক্ট হিসেবে কাজ করবেন।
২.
যদি কোনো ফ্ল্যাটে কোনো ধরনের জরুরি কাজ করার দরকার হয়, তাহলে ওই ফ্ল্যাটের ব্যক্তি প্রথমে ওই ফ্ল্যাটের জন্য নির্ধারিত ক্যাপ্টেনকে জানাবেন।
৩.
ক্যাপ্টেন বাকি ক্যাপ্টেনদের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন এবং ওই ফ্ল্যাটের ব্যক্তির সমন্বয়ে কাজটা সম্পন্ন করবেন।

# লিস্টে ‘যখন দরকার’ মানে হচ্ছে, এই কাজগুলোর যখন প্রয়োজন হবে, তখন সেবা দেওয়া হবে।
# মানসিক দুশ্চিন্তা ব্যবস্থাপনা করার জন্য প্রাথমিক থেরাপি হচ্ছে, ব্যক্তিকে পরিবারের মানুষের আশ্বাস দেওয়া, প্রাথমিক কাউন্সেলিংয়ে না হলে তারপর ক্যাপ্টেন টেলিফোনিক কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করবেন ‘লাইফ কোচ’ থেকে।

কেন এই প্ল্যান?
এই প্ল্যানের মাধ্যমে প্রতিটি কমিউনিটি থেকে শুধু ক্যাপ্টেন বাইরে যাবেন পিপিই পরে এবং সব সতর্কতা অবলম্বন করে, তাহলে যে পরিবারে বৃদ্ধ বা শিশু আছে, তাঁদের বাইরে যেতে হবে না এবং যদি ভাইরাস সংক্রমণ হয়, তাহলে শুধু একজন ক্যাপ্টেন আক্রান্ত হবেন। আপনাদের কাছে যদি প্রতিরক্ষার সরঞ্জাম খুবই সীমিত থাকে, অর্থাৎ এক সেট পিপিই থাকে, ওই এক সেট দিয়ে একজন ক্যাপ্টেন কমপক্ষে ২-৩টি পরিবারকে সাহায্য করতে পারবেন। যদি আমরা ক্যাপ্টেনকে হারিয়ে ফেলি এই কাজ করতে গিয়ে, তাহলে একজন ক্যাপ্টেনকেই আমরা হারাব, আমাদের কমিউনিটির বাকিরা নিরাপদ থাকবেন, মানসিক চিন্তা থেকে দূরে থাকবেন, কারণ, আপনাদের মনে সব সময় একটা সাহস থাকবে যে আমাদের সাহায্য করার জন্য কেউ আছেন। ক্যাপ্টেনদের অবশ্যই সব সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। যেমন ফ্ল্যাটে ডেলিভারি করার সময় ফ্ল্যাটের ডোর খোলার আগে ক্যাপ্টেন মালামাল রেখে সেখান থেকে দূরে সরে যাবেন, এরপর ফ্ল্যাটের একজন শুধু হাতে স্যানিটাইজার লাগিয়ে সেটা বাসায় নিয়ে যাবেন এবং সতর্কতার সঙ্গে সেটা খুলে আবার হাত ধুয়ে ফেলবেন।

সবাই যদি এই প্ল্যান প্রতিটি বিল্ডিং ও গ্রামের জন্য করতে পারেন, দেখবেন এটা আমাদের জরুরি কাজের ব্যবস্থাপনায় অনেক উপকারে আসবে। আমরা জাতি হিসেবে অনেক দূর এগিয়ে যাব।