করোনাময় বিশ্বে কেমন আছেন স্লোভেনিয়ার বিদেশি শিক্ষার্থীরা

স্লোভেনিয়ায় ক্রমেই বেড়ে চলছে করোনাভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা। ছবি: লেখক
স্লোভেনিয়ায় ক্রমেই বেড়ে চলছে করোনাভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা। ছবি: লেখক

বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো স্লোভেনিয়াতে ক্রমেই বেড়ে চলছে করোনাভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা। ৩০ মার্চ স্লোভেনিয়ার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন বলা হয়েছে ৭৫৬ জন ভাইরাসের সংক্রমিত হয়েছেন। সংখ্যাটি ২৯ মার্চ ছিল ৭৩১ জনে। এক দিনের ব্যবধানে নতুন করে আরও ২৫ জন সংক্রমিত হয়েছেন। একই সঙ্গে গত ছয় দিনে আরও ৯ জনের মৃত্যুর খবর দেশটির বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। তাঁদের মধ্যে দুজন ছিলেন স্লোভেনিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম শহর ছেলইয়ের অধিবাসী।

এ নিয়ে স্লোভেনিয়াতে করোনাভাইরাসের সংক্রমণে মৃতের সংখ্যা পৌঁছাল ১১তে। আর সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ১০ জন। ১৯ মার্চ থেকেই প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধের জন্য স্লোভেনিয়াতে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। তবে এখনো স্লোভেনিয়ার বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান খোলা রাখা হয়েছে, বিশেষ করে কারখানাগুলো সীমিত পরিসরে কার্যক্রম চালাচ্ছে। সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ১৬ মার্চ থেকে বন্ধ ঘোষণা করা হয়। আশা করা যাচ্ছে, ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত সব প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হবে। বন্ধ আছে বাস ও ট্রেন সার্ভিস। সামগ্রিক পরিস্থিতির উন্নতি না ঘটা পর্যন্ত দেশটির রাজধানী লুবলিয়ানাতে ইয়োজে পুচনিক ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট থেকেও বিমান চলাচল স্থগিত রাখা হয়েছে।

স্থানীয় পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় না রেখে একই স্থানে পাঁচজনের অধিক জমায়েত হলে প্রত্যককে ৪০০ ইউরো করে জরিমানা করা হবে। এ ছাড়া ২৯ মার্চ স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে নির্দেশ দেওয়া হয় যে এখন থেকে খুব বেশি প্রয়োজন না হলে কেউ এক মিউনিসিপ্যালিটি থেকে অন্য মিউনিসিপ্যালিটিতেও যাতায়াত করতে পারবেন না। পাবলিক প্লেসে যাতায়াত করতে হলে সবাইকে মাস্ক ও হ্যান্ড গ্লাভস পরিধান করতে হবে। যেকোনো জরুরি প্রয়োজনে ১১২, ০৮০১৪০৪ কিংবা +৩৮৬৩১৬৪৬৬১৭—এ তিনটি নম্বরের যেকোনো একটি নম্বরে ফোন দিতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া স্লোভেনিয়াতে বসবাসরত অন্য দেশের নাগরিকদের নিজ দেশের নিকটস্থ অ্যাম্বাসি কিংবা কনস্যুলেট অফিসের সঙ্গেও যেকোনো প্রয়োজনে যোগাযোগ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

প্রতিবেশী ইতালির মতো ক্রোয়েশিয়া এবং হাঙ্গেরির সঙ্গেও স্লোভেনিয়ার সীমান্ত সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছে। কিছু নির্দিষ্ট পয়েন্ট ছাড়া বাকি সব ক্ষেত্রে অস্ট্রিয়ার সঙ্গে স্লোভেনিয়ার সীমান্ত আপাতত বন্ধ। করোনাভাইরাসের প্রভাবে গোটা পৃথিবীর মধ্যে ইতালি সবচেয়ে নাজুক অবস্থানে থাকলেও পশ্চিম স্লোভেনিয়াতে অর্থাৎ স্লোভেনিয়া ও ইতালির সীমান্তবর্তী অঞ্চলে করোনাভাইরাসের প্রকোপ সবচেয়ে কম। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত এ অঞ্চলে মাত্র ৯ জনকে শনাক্ত করা গেছে, যাঁদের শরীরে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি ধরা পড়েছে।

পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো স্লোভেনিয়াতেও বিস্তার লাভ করা করোনাভাইরাসের প্রভাব দেশটির অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করেছে। সাধারণ মানুষের জনজীবনে প্রবলভাবে হতাশা বিরাজ করছে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে স্লোভেনিয়ার ইনস্টিটিউট অব ম্যাক্রোইকোনমিক অ্যানালাইসিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের পক্ষ থেকে চলতি অর্থবছরে স্লোভেনিয়ার প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল সাড়ে ৩ শতাংশ। সাম্প্রতিককালে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো স্লোভেনিয়াতেও ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসের প্রভাবে এ প্রবৃদ্ধির হার অর্ধেকে নেমে আসতে পারে বলে দেশটির অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করছেন।

গত শনিবার সন্ধ্যায় রেডিও বার্তায় দেশটির অর্থমন্ত্রী আন্দ্রেই শিরচেলি বেশ কিছু প্রস্তাব তুলে ধরেন। যাঁরা বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তাঁদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা থাকবে। বিশেষ করে এ সময়ে আত্মনির্ভরশীল ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী যাঁদের প্রতি মাসে সরকারকে ৪০০ ইউরো করে প্রদান করতে হতো, কিন্তু এ পরিস্থিতিতে তাঁদের এ অর্থ প্রদান করতে হবে না। পাশাপাশি তাঁদের সরকারের পক্ষ থেকে অর্থ বরাদ্দ প্রদানের কথাও বলা হয়েছে। এ ছাড়া যাঁরা শিক্ষার্থী, তাঁদের এপ্রিল ও মে দুই মাস ২০০ থেকে ৩০০ ইউরো করে আর্থিক অনুদান প্রদানের কথাও বলা হয়েছে। তা ছাড়া এ পরিস্থিতির কারণে যাঁরা সাময়িকভাবে বেকারত্বের সমস্যায় ভুগছেন, তাঁদের এপ্রিল ও মে দুই মাসে ৭০০ ইউরো করে অর্থ সাহায্য দেওয়ার কথাও প্রস্তাবে উঠে এসেছে। একই সঙ্গে কৃষক এবং স্লোভেনিয়াতে যাঁরা পেনশনভোগী, তাঁদেরকেও বিশেষভাবে সহযোগিতা করার জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপের কথাও এ প্রস্তাবে উঠে এসেছে।

মনিকা জিভেচ। ছবি: লেখক
মনিকা জিভেচ। ছবি: লেখক

স্থানীয় গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, প্রস্তাবটি এ সপ্তাহের মধ্যে দেশটির সংসদে পাস হতে পারে। তবে এখনো বেশ কিছু বিষয়ে অস্পষ্টতা রয়েছে। স্লোভেনিয়াতে যাঁরা অন্যান্য দেশের অভিবাসী রয়েছেন, তাঁদের বিষয়ে আসলে সরকারের পক্ষ থেকে স্পষ্টভাবে কোনো নির্দেশনা আসেনি। বিশেষ করে একসময় যুগোস্লাভিয়ার অধীনে থাকা অন্যান্য দেশ, যেমন বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনা, কসোভো, ক্রোয়েশিয়া, মেসিডোনিয়া, সার্বিয়া, মন্টিনিগ্রো—এসব দেশের থেকে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ইমিগ্র্যান্ট স্লোভেনিয়াতে বসবাস করেন এবং তাঁদের অনেকের নিজস্ব ব্যবসা রয়েছে স্লোভেনিয়াতে। অনেকে আবার এখানে বিভিন্ন ধরনের জীবিকার সঙ্গে জড়িত এবং কেউবা আবার স্লোভেনিয়াতে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করছেন। তাঁদের বিষয়ে আসলে এখন পর্যন্ত স্লোভেনিয়ার সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ঘোষণা আসেনি, এমনকি এসব আর্থিক সাহায্যের অংশীদার তাঁরা হতে পারবেন কি না, কিংবা এঁদের মধ্যে যাঁদের এই মুহূর্তে এ পরিস্থিতির জন্য কোনো কাজ নেই কিংবা যাঁদের রেসিডেন্স পারমিট প্রায় শেষের দিকে, তাঁদের ব্যাপারেও স্পষ্ট কোনো সিদ্ধান্ত স্লোভেনিয়ার সরকারের পক্ষ থেকে এখনো আসেনি।

মুশফিক হাসান স্লোভেনিয়াতে বসবাসরত একজন প্রবাসী বাংলাদেশি শিক্ষার্থী। ইরাসমাস মুন্ডুস শিক্ষাবৃত্তির আওতায় ইউনিভার্সিটি অব লুবলিয়ানার অধীনে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে মাস্টার্স সম্পন্ন করছেন তিনি। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো স্লোভেনিয়াতেও ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসের প্রভাবে তিনি বেশ শঙ্কিত। স্লোভেনিয়ার সরকার সাময়িক সময়ের জন্য সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করায় তিনি খানিকটা অস্বস্তিতে পড়েছেন। যদিও বর্তমানে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এরপরও ইউনিভার্সিটি খোলা থাকলে যে সুবিধাগুলো পাওয়া যেত (নিয়মিত লাইব্রেরি অথবা গ্রুপ ওয়ার্ক কিংবা সরাসরি কোনো শিক্ষকের অধীনে থেকে কোনো একটি প্রজেক্টে কাজ করা), এখন সে সুবিধাগুলো থেকে বঞ্চিত হতে হচ্ছেন। এ ছাড়া শিগগিরই সামগ্রিক পরিস্থিতির উন্নতি না ঘটলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বর্তমান সেমিস্টার শেষ করতে পারাটা আদৌতে সম্ভব কি না, তা নিয়েও তিনি বেশ সন্দিহান। তবে ইউরোপের অন্য দেশ ইতালি, স্পেন, পর্তুগাল, ফ্রান্স, জার্মানির তুলনায় স্লোভেনিয়াতে করোনাভাইরাসের বিস্তার তুলনামূলক কম থাকায় এবং একই সঙ্গে তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে এ ধরনের পরিস্থিতিতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের সতর্কতামূলক নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে বলে অনেকটা দুশ্চিন্তামুক্ত থাকতে তিনি পারছেন বলে জানিয়েছেন।


স্লোভেনিয়া সরকারের সিদ্ধান্তে স্বস্তি
মনিকা জিভেচ লুবলিয়ানাতে ফ্যাশন ডিজাইনিং অ্যান্ড বিউটি থেরাপির ডিপ্লোমা শিক্ষার্থী। পাশাপাশি তিনি ম্লিনোটেস্ট নামে একটি বেকারি শপে পার্টটাইম কাজ করেন। ম্লিনোটেস্ট স্লোভেনিয়াতে মূলত একটি চেইন শপ। কিন্তু বর্তশান পরিস্থিতির কারণে তিনি কাজে যেতে পারছেন না। এই মুহূর্তে তাঁর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। গ্রেট ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, জার্মানি, নেদারল্যান্ডসসহ কয়েকটি দেশে আইন আছে—একজন শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় সপ্তাহে হয় তো বা ২০ ঘণ্টা কিংবা ৩০ ঘণ্টার বেশি কাজ করতে পারবেন না। স্লোভেনিয়ার আইনে এমন কিছু বলা নেই এবং এ কারণে স্লোভেনিয়াতে চাইলে শিক্ষার্থীরা ফুলটাইম কাজও করতে পারেন। এ জন্য অনেক কোম্পানি কিংবা অনেক রেস্তোরাঁ অথবা দোকানের পক্ষ থেকে যখন কোনো একজন শিক্ষার্থীকে চাকরির অফার দেওয়া হয়, তখন স্বভাবতই কর্তৃপক্ষ চায় তাঁকে দিয়ে ফুলটাইম কাজ করাতে। কিন্তু বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর পক্ষে লেখাপড়ার পাশাপাশি ফুলটাইম অর্থাৎ দিনে সাত–আট ঘণ্টা কাজ করে পড়াশোনা করার সুযোগ হয় না। মনিকার বাড়ি আইডসচিনায়। আইডসচিনা আসলে একটি মফস্বল এলাকা। রাজধানী লুবলিয়ানা থেকে প্রায় ৮২ কিলোমিটার দূরের এলাকা। এমন পরিস্থিতিতে যদি তাঁর চাকরি চলে যায়, তাহলে এটি হবে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো। প্রথমত, এখন যেহেতু স্লোভেনিয়াতে পর্যটকদের সে রকম আনাগোনা নেই এবং সামগ্রিকভাবে বলতে গেলে কেউই আসলে খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে বের হতে পারছেন না। তাই মনিকার প্রতিষ্ঠানে বিউটি ট্রিটমেন্ট কিংবা ম্যাসাজ থেরাপির জন্য কেউ আসছেন না। অন্যদিকে চাকরি গেলে নতুন করে তাঁকে কোনো অন্য চাকরির চেষ্টা চালাতে হবে, যা এ ধরনের পরিস্থিতিতে প্রায় অসম্ভব একটি ব্যাপার। ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স, জার্মানি, সুইজারল্যান্ডের তুলনায় স্লোভেনিয়াতে করোনায় সংক্রমণের হার অনেকটা কম—এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে মনিকা জানান, পুরো স্লোভেনিয়া আসলে ডিসেন্ট্রালাইজড। অর্থাৎ স্লোভেনিয়াতে মানুষের জীবনযাত্রা কেবল বড় শহর যেমন লুবলিয়ানা কিংবা মারিবোরের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; পাশাপাশি স্লোভেনিয়ার জনসংখ্যার ঘনত্ব খুবই কম। স্লোভেনিয়া সুউচ্চ পর্বতমালা ও ঘন বন-জঙ্গল দ্বারা আচ্ছাদিত হওয়ায় এখানে জনবসতি অত্যন্ত বিক্ষিপ্ত, যার প্রভাবে স্লোভেনিয়াতে তেমন হারে এখন পর্যন্ত ইউরোপের অন্য দেশের মতো করোনাভাইরাস বিস্তার লাভ করতে পারেনি। তিনি স্লোভেনিয়া সরকারের নেওয়া কিছু পদক্ষেপের প্রশংসা করেন। ইতালি ও স্পেনে প্রথম করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ে তখনই সরকারের কিছু পদক্ষেপ, যেমন ইতালির সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোতে মানুষের চলাচল ও জনসমাগম নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নেওয়া এবং মানুষকে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে জনসচেতনতামূলক কমর্কাণ্ডে সচেষ্ট হওয়ার উদ্যোগ নেওয়ায় এ ভাইরাস ছড়াতে পারেনি বলে মনিকা অভিমত ব্যক্ত করেন। পাশাপাশি বর্তমান খাদ্য ও কৃষিমন্ত্রী ড. আলেকজান্দ্রা পিভেচ দাবি করেন, পরিস্থিতি যতই নাজুক অবস্থার দিকে যাক না কেন, স্লোভেনিয়াতে এই মুহূর্তে বড় কোনো খাদ্যঘাটতির আশঙ্কা নেই, যা দেশটির অন্যান্য অনেক সাধারণ মানুষের মতো মনিকাকেও খানিকের জন্য হলেও স্বস্তি দিচ্ছে।

বোগদান পেট্রোভিচ, স্লোভেনিয়ার ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছার ফ্যাকাল্টি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ম্যানেজমেন্টের ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট। স্লোভেনিয়ার করোনা পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি জানান, সাম্প্রতিক এ পরিস্থিতি তাঁর কপালে বিশেষভাবে ভাঁজের সৃষ্টি করছে। বিশেষ করে বাইরে কোথাও বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া বের হতে না পারায় এবং একই সঙ্গে তিনি যেহেতু পড়াশোনার পাশাপাশি পার্টটাইম চাকরির সঙ্গেও জড়িত, কিন্তু এ পরিস্থিতির কারণে তিনি কাজে যেতে পারছেন না। তাই একধরনের হতাশার মধ্য দিয়ে তিনি দিন পার করছেন। তবে তাঁর নিজ দেশ সার্বিয়ার তুলনায় স্লোভেনিয়া এখন পর্যন্ত বেশ স্বস্তিদায়ক পরিস্থিতিতে রয়েছে বলে তিনি মতামত ব্যক্ত করেন।

বোগদান পেট্রোভিচের তথ্যমতে, গত শুক্রবার পর্যন্ত সার্বিয়াতে ৬৫৯ জনের মতো আক্রান্ত হয়েছেন প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে। তাঁদের মধ্যে ১০ জন ইতিমধ্যে মৃত্যুবরণ করেছেন। ইউরোপের অনেক দেশের তুলনায় অর্থনৈতিকভাবে সার্বিয়া অনেকটা দুর্বল আর এ কারণে দেশটির চিকিৎসাসেবার মান খুব একটা সন্তোষজনক নয়। যদিও সার্বিয়ার সরকার এ পরিস্থিতিতে চীন থেকে করোনাভাইরাস টেস্ট করার কিট এবং অন্যান্য মেডিকেল সরঞ্জাম আমদানির ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু তাঁর মতে সার্বিয়ার সরকার এখনো ইউরোপের অন্যান্য দেশের মতো করোনাভাইরাস পরিস্থিতিকে তেমনটা গুরুত্বের সঙ্গে নেয়নি বলে তিনি জানান। যদিও সার্বিয়ার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী আনা ব্রানাভিচ করোনার বিস্তার রোধে দেশটিতে কারফিউ জারি করেছেন। রাজধানী বেলগ্রেডসহ দেশটির সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোতে জরুরি সেনা মোতায়েন করা হয়েছে, কিন্তু দেশটিতে আইনের শাসন অনেকটা সীমিত হওয়ায় এবং একই সঙ্গে দেশের সাধারণ মানুষের আইনের প্রতি তেমন শ্রদ্ধাশীল না হওয়ায় সার্বিয়া আদৌ কতটুকু সফল হবে সামগ্রিক পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে, তা নিয়ে তিনি বেশ শঙ্কা প্রকাশ করেছেন।

বাঁ দিক থেকে সার্বিয়ার শিক্ষার্থী বোগদান পেট্রোভিচ, মাঝে লেখক ও ডান রাশিয়ান শিক্ষার্থী আলেকজান্ডার চিস্টিয়াকোভ। ছবি: সংগৃহীত
বাঁ দিক থেকে সার্বিয়ার শিক্ষার্থী বোগদান পেট্রোভিচ, মাঝে লেখক ও ডান রাশিয়ান শিক্ষার্থী আলেকজান্ডার চিস্টিয়াকোভ। ছবি: সংগৃহীত

রাশিয়া নিয়ে হতাশ আলেকজান্ডার চিস্টিয়াকোভ
আলেকজান্ডার চিস্টিয়াকোভ বোগদান পেট্রোভিচের মতো ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছাতে অধ্যয়নরত ইন্টারন্যাশনাল শিক্ষার্থী। পরিবেশবিজ্ঞানে স্নাতক করছেন। তিনি জানান, এখন পর্যন্ত যেহেতু তিনি সুস্থ রয়েছেন, তাই ব্যক্তিগতভাবে তিনি এখনো নির্ভার। তবে তাঁর দেশ রাশিয়ার সম্ভাব্য পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করে তিনি বেশ উদ্বিগ্ন। এখন পর্যন্ত রাশিয়াতে ১ হাজার ২০০–এর বেশি মানুষের শরীরে কোভিড-১৯–এর সংক্রমণ ধরা পড়েছে, যাঁদের মধ্যে পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে বলে তিনি বিভিন্ন সূত্র থেকে খবর পেয়েছেন। তবে রাশিয়াতে সে অর্থে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা না থাকায় এবং গণমাধ্যমগুলোর ওপর সরকারের একচ্ছত্র আধিপত্যের কারণে তিনি বেশ হতাশা প্রকাশ করেছেন। কেননা তাঁর মতে, হয়তোবা এহেন পরিস্থিতিতে দেশটির গণমাধ্যমগুলো কতটা প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরতে পারবে, তা নিয়ে তিনি বেশ সন্দিহান।

আক্ষরিক অর্থে আমরা কেউই বলতে পারি না যে সামগ্রিকভাবে কবে এ পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে। একদিকে যেমন প্রতিদিন নতুন করে করোনাভাইরাসে সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে সারা পৃথিবীতে, অনেকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন; অন্যদিকে গোটা পৃথিবীর অর্থনৈতিক ব্যবস্থা একটি বড় দুর্যোগের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। অনেকেই ইতিমধ্যে চাকরি হারিয়ে বেকার, অনির্দিষ্টকালের জন্য সবাই একধরনের গ্যাঁড়াকলে আবদ্ধ। এ ভাইরাস প্রতিরোধে এখন পর্যন্ত নেই কোনো কার্যকর ভ্যাকসিন, নেই সঠিক কোনো চিকিৎসা। কোনো ধরনের সামরিক যুদ্ধ নয়, নয় কোনো ধরনের পারণবিক অস্ত্র কিংবা নয় কোনো কোনো ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ; সামান্য কয়েক ন্যানোমিটারের ক্ষুদ্র এক মাইক্রোঅর্গানিজমের কাছে আজ গোটা পৃথিবী অসহায়। খালি চোখে দেখা যায় না অথচ কোনো এক অদৃশ্য শক্তিরূপেই গোটা পৃথিবীকে সে অচল করে দিচ্ছে এবং বিশ্বের প্রায় সব দেশ এক হয়েও রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে এ ক্ষুদ্র অণুজীবটির কাছে। পৃথিবী যেন আজ মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে শুধু এই একটি ভাইরাসের কারণে। তবে দক্ষিণ আফ্রিকার রসায়নবিদ মাইকেল লেভিট (২০১৩ সালে মাল্টিস্কেল মডেলিংয়ের ওপর গবেষণার জন্য নোবেল পান) সম্প্রতি বলেছেন, হয়তোবা এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে নাটকীয়ভাবে করোনাভাইরাসে সংক্রমিত রোগীর হার কমতে শুরু করবে। তাঁর এ দাবিকে তিনি একটি গ্রাফ আকারে উপস্থাপন করেছেন এবং বলেছেন, চীনে যেভাবে একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর এই ভাইরাসে সংক্রমণের হার কমে আসতে শুরু করে, পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও এ সময়কে আদর্শ হিসেবে ধরে নিলে আগামী এপ্রিল মাসেই আমাদের জন্য এক সুসংবাদ অপেক্ষা করছে।

মাইকেল লেভিটের এই ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হলে শিগগিরই আমাদের জন্য নতুন এক ভোরের অপেক্ষা করছে।

*লেখক: শিক্ষার্থী, ব্যাচেলর অব সায়েন্স ইন ফিজিকস অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিকস, ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা, স্লোভেনিয়া।