নিউইয়র্কে টেস্ট না করে পাঠানো হলো বাড়িতে, পরে করোনায় মৃত্যু

ছবিটি প্রতীকী
ছবিটি প্রতীকী

আমার ছোটবেলার বন্ধুর বাপ-চাচার মোটামুটি পুরো খানদান নিউইয়র্কে থাকেন। এই শহরই বলতে গেলে তাঁদের ‘দেশের বাড়ি’।

তাঁর চাচাদের একজন গত সপ্তাহে অসুস্থ হয়ে পড়েন। জ্বর, কাশি। তিনি হাসপাতালে গেলেন। ওরা কোনো টেস্ট না করেই তাঁকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়। কারণ, আমেরিকাতেও টেস্টিং কিটের সংকট চলছে। নিশ্চিত না হয়ে টেস্ট করছে না।

এ সুযোগে আমেরিকান প্রস্তুতি সম্পর্কে কিছু কথা বলা যাক।

গুগল করুন ‘পিপিই চায়না’ লিখে, দেখবেন তাঁদের সুরক্ষা পোশাক কতটা মজবুত। পুরোদস্তুর এস্ট্রোনটদের স্পেসস্যুটের মতোন। তার পরই আমেরিকান চিকিৎসকদের পিপিই দেখুন, বাংলাদেশি চিকিৎসকদের মতোন বা তাঁদের চেয়ে একটু ভালো। রেইনকোটের মতোন একটা পোশাক পেঁচিয়ে তাঁরা নেমে গেছেন ফিল্ডে। পিপিইর অভাবে কেউ কেউ ‘স্কি জ্যাকেট’ গায়ে ‘ল্যাব গগলস’ চোখে জড়িয়ে কাজে আসছেন। কারণ, পিপিই নেই। প্রত্যেক রোগীর জন্য আলাদা পিপিই প্রয়োজন হয়। একেকজন চিকিৎসক প্রতিদিন গড়ে ৩০ থেকে ৪০ জন কোভিড-১৯-এর রোগী দেখছেন। আমেরিকান চিকিৎসকদের এত পিপিই নেই। ট্রাম্প সরকার যতই চাপাবাজি করুক, বিন্দুমাত্র প্রস্তুতি ছিল না আমাদের। বাংলাদেশ যে বলছে তাঁদের প্রস্তুতি ইউরোপ আমেরিকা থেকে ভালো, হয়তো কথাটা আংশিক সত্য। দেশে তো রোগীই ধরা পড়ছে না।

আমেরিকানদের একটা ভরসার প্রতীক, আমাদের হাসপাতালগুলো। এত আধুনিক প্রযুক্তি এবং জ্ঞানী চিকিৎসক ও চিকিৎসাসেবা পৃথিবীর আর কোথাও আছে বলে আমার ধারণা নেই।

কয়েক দিনের মধ্যেই আমাদের এই অহংকারের স্তম্ভ গুঁড়িয়ে গেল।

নিউইয়র্কের হাসপাতালগুলো রোগী সেবা সর্বোচ্চ কত দিতে পারে? ৫০ হাজার? ৬০ হাজার? আচ্ছা, ধরলাম এক লাখ। বর্তমানে নিশ্চিত থাকুন, নিউইয়র্ক শহরেই করোনা ভাইরাসের রোগীর সংখ্যা কয়েক লাখ। এবং তা প্রতি মুহূর্তে বাড়ছে। অন্যান্য রোগীদের কথা বাদই দিন। তাহলে হাসপাতালে কী পরিমাণ ভিড় হচ্ছে, বুঝতে পারছেন? চিকিৎসকেরা ১২-১৬ ঘণ্টা শিফট করতে করতে উন্মাদপ্রায় অবস্থা। কিছুতেই কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। একটা রোগী সুস্থ করলে নতুন ১০টা রোগী যোগ হচ্ছে। দ্বিতীয় রোগীর ট্রিটমেন্ট শুরুর আগেই আরও ১০০ জন অসুস্থ হচ্ছে। যে কারণে সেন্ট্রাল পার্কের খোলা ময়দানে তাঁবু খাটিয়ে অস্থায়ী ইমার্জেন্সি হাসপাতাল খোলা হয়েছে। সেটাও ভরে গেছে। কোথাও রোগী রাখার জায়গা নেই। তাই সবাইকে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

কেউ কেউ বলবেন, অফিশিয়াল হিসাবেতো নিউইয়র্কে ‘কয়েক হাজার’ বলছে, আপনি কেন কয়েক লাখ বলছেন?

আমি বলছি, কারণ নিউইয়র্কের মেয়র বলেছেন, যে সংখ্যাটা অফিশিয়ালি দেখছেন, সেটা কেবল টেস্ট করা রোগীর সংখ্যা। অসংখ্য কেস আছে, যেগুলো টেস্ট করা সম্ভব হয়নি। মার্কিন সরকার অনুমান করছে, এই দুর্যোগে আমাদের এক থেকে দুই লাখ মানুষ মারা যাবে। সহজ কথা না।

যা-ই হোক, বন্ধুর চাচাকেও নির্দেশনা দেওয়া হয় হোম কোয়ারেন্টিনে থাকতে। কারণ তাঁর বয়স তুলনামূলক কম, ৫৪ বছর। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ৬০-৭০ বছরের ওপরের রোগীদের মৃত্যুহার বেশি (৭৫%)। তাই তাঁদের ইমিডিয়েট ভর্তি করা হচ্ছে।

তাঁকে বলা হয়, যতক্ষণ না তাঁর শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, ততক্ষণ হসপিটালে না আসতে। চিকিৎসকদের আশা, তাঁর শরীর আপনাতেই রোগের সঙ্গে লড়াই করে সুস্থ হবে। আল্লাহ ভরসা! তিনি সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে বাড়িতে থাকতে শুরু করলেন। গত পরশু রাতে তাঁর শ্বাসকষ্ট ওঠায় ৯১১ নম্বরে কল করেন। অ্যাম্বুলেন্স আসে। রাত সোয়া ১২টায় তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়। বাড়ির কাউকে সঙ্গে নিতে দেওয়া হয়নি। আধঘণ্টা পর হাসপাতাল থেকে ফোনে জানানো হয় তিনি মারা গেছেন। তাঁর করোনা ছিল।

বাড়ির প্রত্যেকের জ্বর-কাশি চলছে। কাউকে লাশ দেখতে আসতে দেওয়া হয়নি। সবাই সুস্থ থাকলেও আসতে দিত না। করোনাভাইরাস কোনো ফাইজলামির বিষয় না। আবেগ থেকেও এ দেশে মানুষের জীবন বাঁচানো বেশি জরুরি।

বন্ধুর বাবারা মোটামুটি সব ভাই নিউইয়র্কেই থাকেন। আপন ভাইয়ের মৃত্যুতে কেউ লাশ দেখতে পারছেন না। কারোর বিশ্বাসই হচ্ছে না এখনো যে ভাই আর নেই। এমন হঠাৎ মৃত্যুতে লাশ না দেখা পর্যন্ত, কবর না দেওয়া পর্যন্ত কেউই বিশ্বাস করতে পারে না। এখানে তো সেই সুযোগটা পাচ্ছেন না। হাসপাতালই ওদের লোক দিয়ে জানাজা পড়িয়ে দাফনের ব্যবস্থা করবে। আপন কেউ জানাজায় থাকতে পারবেন না। ভিডিও স্ট্রিমিংয়ের মাধ্যমে বাড়িতে বসে দেখতে হবে তাঁর শেষকৃত্য।

এই হচ্ছে আমেরিকার সবচেয়ে বড়, আধুনিক এবং ধনী শহর ‘বিশ্বের রাজধানী’ খ্যাত নিউইয়র্কের অবস্থা।

তার পরও, যখন এক হাজার রোগীর শয্যা নিয়ে একটি জাহাজ এই শহরের সমুদ্রতটে ভেড়ে, সেই তামাশা দেখতে সেই শহরেরই হাজারও মানুষ ভিড় করে। বাপের জন্মেও কেউ জাহাজ দেখে নাই। এই জাহাজ না দেখলে দুনিয়া আখিরাত দোজাহানের অশেষ নেকি হাসিল হওয়া থেকে সবাই বঞ্চিত হতেন। বেহেশত ছুটে যেত। এখন জাহাজ দেখা শেষ। এখন জিন্দেগি ধন্য হলো। সবাই শান্তিতে মরতে পারবে।

আশপাশে বাঘ দেখলে বনের হরিণও দৌড়ে পালায়। মানুষের চেয়ে নির্বোধ প্রাণী পৃথিবীতে কয়টা আছে?