বাবাময়

বাবার সঙ্গে লেখক ছেলে। ছবি: সংগৃহীত
বাবার সঙ্গে লেখক ছেলে। ছবি: সংগৃহীত

যেকোনো বিচারেই বাবা দিবসের গুরুত্ব মা দিবসের চেয়ে বেশি নয়। আমার মনে হয় শুধু মা দিবস হলে খারাপ দেখায় বলে বাবা দিবসের অবতারণা! মাকে নিয়ে যত ভালো ভালো কবিতা, গান পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় রচিত হয়েছে, তুলনামূলক বিচারে বাবা নিয়ে তেমন কিছুই হয়নি!

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও মাকে নিয়ে মর্মস্পর্শী কবিতা, গান রচনা করেছেন। বাবাকে নিয়ে আলাদা কিছু লিখেছেন, এ রকম আমার অন্তত জানা নেই!

দেশের মোটামুটি সব সংবাদপত্রই বাবা দিবসে নামকাওয়াস্তে কিছু তারকা টাইপ মানুষদের প্রথম বাবা হওয়ার অনুভূতি প্রকাশ করে! খুব ইনিয়ে–বিনিয়ে প্রথম বাবা ডাক শুনতে কেমন লেগেছিল, কেমন লাগে এগুলোই তারকারা বর্ণনা করেন, আমরা পড়ে পুলকিত হই। কেউ কেউ হয়তো তারকাদের অনুভূতির সঙ্গে নিজের বাবা হওয়ার অনুভূতি মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করেন, আমিও সে চেষ্টা করি কিন্তু প্রতিবার নিজের বাবা ডাক শোনার অনুভূতি মনে করার আগে, আমার নিজের বাবার ছবিটা মনের মধ্যে চলে আসে! বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন ১০ বছরের বেশি আগে। তবু কারও সঙ্গে বাবাকে নিয়ে কথা বলতে গেলে বা যেকোনো আলাপেই বাবা প্রসঙ্গ এলে আমাকে থামতে হয়, গলা ভারী হয়ে চোখ ভিজে যায়! এ ক্ষেত্রে সময় আমার বাবাকে পেছনে ফেলতে পারেনি। এই কথাগুলো লিখতে গিয়ে পর্যন্ত কান্না এসে হাত থামিয়ে দিচ্ছে! সবাই হয়তো ভাবছেন না জানি কেমন আলাদা ধরনের মানুষ ছিলেন আমার বাবা? আসলে তিনি ছিলেন খুব বেশি সাধারণ, আর এখানেই তাঁর অসাধারণত্ব! সবকিছু ছাপিয়ে যে জিনিসটি আমাকে সবচেয়ে বেশি পীড়িত করে তা হলো, বাবাকে দেখাতে পারিনি যে তাঁকে কত ভালোবাসি! নিষ্ঠুর প্রবাসজীবন বাবার সান্নিধ্য থেকে আমাকে বঞ্চিত করেছে। আমার প্রতি বাবার যে তীব্র ভালোবাসা ছিল, তা আমি এই সুদূর প্রবাসে বসে প্রতি মুহূর্তে টের পেতাম, মনে মনে আজও আমি তাঁর স্নেহ টের পাই, এটা শুধুই তাঁর সঙ্গে আমার সম্পর্ক! অন্য ভাইবোনদেরও বাবা ভালোবাসতেন হয়তোবা কিছু ক্ষেত্রে আমার চেয়ে বেশি, কিন্তু তাঁর সঙ্গে আমার একধরনের আলাদা বোঝাপড়া ছিল, যা আমি বর্ণনা করতে পারছি না। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের মতো বড় লেখক হলে হয়তোবা অনুভূতিটা লিখতে পারতাম! আফসোস!

ডায়াবেটিস নামের নিষ্ঠুর অসুখটি তাঁর কিডনি, লিভার নষ্ট করে দিয়েছিল! খেতে পছন্দ করা মানুষদের জন্য ডায়বেটিস ভয়ংকর অসুখ। আমার মা আর বোন বাবাকে যেভাবে পাহারা দিয়ে রাখতেন, যাতে ডায়াবেটিস বেড়ে যায় এমন খাবার না খেতে পারেন, পৃথিবীতে বিরল! এই নিয়ে আব্বা টেলিফোনে মাঝেমধ্যেই অনুযোগ করতেন, আজ আর অনুযোগ করার কেউ নেই! যেদিন তিনি মারা যান, সেদিন ১ এপ্রিল! আমাদের সবাইকে এপ্রিল ফুল জানিয়ে চলে গেলেন। মৃত্যুসংবাদটা মেজ ভাইটি ফোনে আমাকে দিয়েছিলেন। তিনি পাগলের মতো কাঁদতে কাঁদতে ঠিক কী বলেছিলেন, আমার মনে নেই। এটুকুই বুঝলাম, বাবা নেই! সেই কণ্ঠ এখনো আমার কানে লেগে আছে! আগে এত প্রিয়জন কেউ মারা যায়নি আমার! খুব তীব্র শোকের সময় কী করতে হয় জানা নেই, আমি স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে থাকলাম যেন কিছু হয়নি। শুধু মনে হচ্ছিল যেভাবেই হোক আমাকে দেশে যেতে হবে, যত তাড়াতাড়ি পারা যায়, না হলে আম্মাকে বাঁচানো যাবে না!

বিদেশে বহু মানুষের তাৎক্ষণিক দেশে যাওয়ার সামর্থ্য থাকে না, আমারও ছিল না। তবু টিকিট জোগাড় করলাম, ওই দিন ফ্লাইট ছিল না, পরের দিন যেতে হবে, দেশে গিয়ে নামব ৩ এপ্রিল ভোরবেলা! ইতিমধ্যে দেশে আমাদের বাসায় আত্মীয়স্বজন গিয়েছেন, কেউ একজন আমাকে ফোনে জানালেন যে মরদেহ বেশিক্ষণ রাখা ঠিক নয়। ইসলামে মরদেহ তাড়াতাড়ি কবর দেওয়া উত্তম! কিছু মুহূর্ত থাকে, যখন নিজের মতামত দেওয়ার অবস্থায় মানুষ থাকে না। আমি শুধু বলেছি ঠিক আছে। দেশে গিয়ে যখন বাবার কবরের সামনে দাঁড়িয়েছি, শুধু বুক চিরে হাহাকার বেরিয়ে এল, মানি না এই মৃত্যু! কোনোভাবেই গ্রহণ করতে পারব না! আমরা কেউ মৃত্যুকে গ্রহণ করি না, মেনে নেই, উপায় কি আছে মেনে নেওয়া ছাড়া? নেই!