গৃহবন্দীর জবানবন্দি-৩

করোনাভাইরাসের কারণে ফাঁকা শহর। ছবি: সংগৃহীত
করোনাভাইরাসের কারণে ফাঁকা শহর। ছবি: সংগৃহীত

ঘরে বসে বসে সময় পার করা এক নীল বেদনা। প্রতিদিন ঘুম থেকেই জেগেই ভাবি, আজ বাইরে একবার। তা হোক শপিংয়ের জন্য অথবা জগিংয়ের জন্য। তারপর আবার অনেক নেতিবাচক মনোনিবেশ এক অজানা অন্ধকারে ডুবিয়ে ফেলে। কিন্তু শপিং না করলে তো না খেয়ে থাকতে হবে। আর না খেয়ে থাকা মানে তো ধীরে ধীরে মরে যাওয়া। মৃত্যুর ভয়ে মরার আগেই মরে যাওয়া অনেকটা বিড়ম্বনাই বলা যায়। বাইরে গেলে রিস্ক।

ইংল্যান্ডে মানুষ ঘর থেকে বের না হলেও সরকার ঘরে ঘরে খাদ্যদ্রব্য পাঠিয়ে দেবে। এখানে প্রতিটি কাউন্সিলে ফুড ব্যাংক আছে। আবার আছে বেনিফিট ব্যবস্থা। সরকার জনগণের দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছে।

মানুষ সবাই ঘরে। ছবি: সংগৃহীত
মানুষ সবাই ঘরে। ছবি: সংগৃহীত

২৭ মার্চ, রাত ১২টা। রাতে পাশের এক প্রতিবেশীর শপিং করে এনে দিলাম। রাস্তাঘাট ফাঁকা। আমার মতো যাঁরা বের হয়েছেন তাঁরা সবাই নিত্যপ্রয়োজনীয় খরচাপাতি করতেই বের হয়েছেন। সবাই ভীত। একজন অন্যজনকে ভয় পায়। কেউ কাছে এলে অন্যজন দূরে সরে যাচ্ছে। আমিও এর ব্যতিক্রম নই। সুপার স্টোরে যতক্ষণ ছিলাম ততক্ষণ ভয়ে ভয়ে একটির পর আরেকটি দ্রব্য নিজের ট্রলিতে ভরছি আর অন্যদের থেকে নিজেকে যতটুকু পারছি নিরাপদ দূরত্বে রাখছি। শুধু পারসন টু পারসন, নাকি বাতাসের মাধ্যমেও এই ভাইরাস ছড়াচ্ছে, বোঝা যাচ্ছে না। হাত ধুয়ে ধুয়ে এই করোনাভাইরাস থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার মতো নয়। কিন্তু ন্যূনতম প্রচেষ্টা মাত্র। আমরা জানি, হাতে থাকলও অনেক সময় শরীরের ভেতর ঢুকতে নাও পারে, যদি আমরা ভালো করে হাত ধুয়ে নিই। যদি শুধু হাত ধুলে এ ভাইরাস থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যেত, তবে প্রিন্স চার্লস এবং প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনকে এই ভাইরাসে নিশ্চয়ই আক্রান্ত করত না! তো আমার নিজের শপিং যেহেতু করতে মাঝেমধ্যে রিস্ক নিয়েই বাইরে যেতে হয়, তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যাঁদের শরীর সুরক্ষিত নয় অথবা যাঁরা স্বাস্থ্যগত কারণে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে ঘর থেকে বের হতে পারছেন না, তাঁদের শপিং করে দেব। জীবন সায়াহ্নে দাঁড়িয়ে যদি সামান্য কিছু অন্যের জন্য করতে পারি, মন্দ কী।

এখানে টিভি দেখা এখন একমাত্র কাজ। আর টিভির সংবাদে নিজেকে ডুবিয়ে রাখা মানে আতঙ্কের সাগরে হাবুডুবু খাওয়া। কিছুক্ষণ পরপরই হোয়াটসআপ গ্রুপে একটির পর একটি অনাকাঙ্ক্ষিত সংবাদ! কখনো মৃত্যুর সংবাদ আবার কখনো অন্য আরেকজন সংক্রামিত হয়ে যাওয়ার খবর। খবরগুলো পরিচিতজনের, অপরিচিতজনের।

তাহলে আর নিউজ দেখব না। টিভি চ্যানেল পরিবর্তন করে অন্য প্রোগ্রাম দেখি। তাতেও মন বসে না। কেউ কেউ হয়তো পারেন। কেউ কেউ ইন্ডিয়ান নাটকের সিরিজগুলো দেখছেন মনোযোগ দিয়ে। আর কেউ কেউ ফিকিরে ব্যস্ত! তো যে যেভাবেই সময় কাটান না কেন, সবাই এখন ঘরে। বাচ্চাকাচ্চা, ঘরের কর্তা, বৃদ্ধ দাদা দাদি অথবা গৃহকর্ত্রী। একঘরে থেকেও আবার এক অজানা আশঙ্কা। কেউ কারও কাছে আসে না। বাচ্চারা মা-বাবাকে জড়িয়ে ধরে আদর করছে না। অজানা ভয়!

অলস সময়। অনেকেই নিজেকে ব্যস্ত রাখার তাগিদে নতুন নতুন পন্থা ইতিমধ্যেই আবিষ্কার করে ফেলছে। তবে যে যা-ই করুক, তাদের কর্মকাণ্ড কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে কেন্দ্র করে অথবা সামাজিক যোগাযোগকে মাধ্যম করেই করছে। কিছু একটা করেই মানুষের জীবন অতিক্রম করে। ছাত্রছাত্রীরা পড়াশোনা করে জীবন অতিক্রম করে। ফাঁকে ফাঁকে কিছু আনন্দ, কিছু চিত্তবিনোদন প্রভৃতি।

আর কর্মজীবীরা কর্ম করে করে নিজেদের মূল্যবান সময় অতিবাহিত করেন। যখন আর কিছুই করার থাকে না, তখন কেউ কেউ মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হয়ে মৃত্যুর অপেক্ষা করেন অথবা কেউ কেউ প্রস্তুত হওয়ার আগেই মরে যান। প্রকৃতির চিরাচরিত নিয়ম। এবারই নিয়মের একটু ব্যতিক্রম। এখন কঠিন সময়। মৃত্যু আসছে অনাকাঙ্ক্ষিত। অসহায়। মানুষ আর মৃত্যু মুখোমুখি। বাইরে যাওয়ার উপায় নেই। চাইলেও যাওয়া যাবে না। অফিসে যাওয়া যাচ্ছে না। কাজ নেই। অফিস আদালত, দোকানপাট বন্ধ। আমি জানি না কত দিন বন্ধ রাখবে। তবে চীন দেশের উহানের দিকে লক্ষ করলে দেখা যায়, একটি নির্দিষ্ট সময় পর সবকিছু ঠিক হয়ে যায়। এ রকমই আশা এখানে। শুধু ইংল্যান্ডের কথাই বলব না, প্রতি দেশেই এ রকম আশা করছে। কিন্তু কোনো কিছুই নিশ্চিত নয়।

মানুষ আশায় আশায় থাকার মাঝে প্রেরণা পায়। প্রেরণা পায় বেঁচে থাকার, প্রেরণা পায় নতুন কিছু করার। এখন সবাই আশা করছেন, একদিন এই করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন আবিষ্কার হয়ে যাবে। সবকিছু নরমাল হয়ে যাবে। কিন্তু তখন দুনিয়ার কতজন মানুষ বেঁচে থাকবেন, দুনিয়ার অর্থনীতিতে কোন ধরনের ধস নামবে, তা চিন্তা করতেও ভয় হয়।

বি. দ্র. ইংল্যান্ডে মানুষ ঘর থেকে বের না হলেও সরকার ঘরে ঘরে খাদ্যদ্রব্য পাঠিয়ে দেবে। এখানে প্রতিটি কাউন্সিলে ফুড ব্যাংক আছে। আবার আছে বেনিফিট ব্যবস্থা। সরকার জনগণের দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছে। আমাদের দেশের কথা চিন্তা হয়। এই যে সারা দেশের মানুষ কোয়ারেন্টিনে চলে গেছেন। যাঁরা দিনে কাজ করেন এবং রাতে খান, তাদের কী হবে। ভিক্ষুকদের কী হবে। নাহ! আর ভাবতে পারছি না। এই যে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা বৃদ্ধ লোকদের নির্দয়ের মতো পাঠাচ্ছেন দেখলাম পত্রিকায়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। কেন? এই অফিসাররা কী এই বৃদ্ধ লোকদের ঘরে খাবারের ব্যবস্থা করবেন? এখন বাংলাদেশ তথা পৃথিবীর জন্য ক্রান্তিকাল। এখন আমাদের পরস্পরের পাশে দাঁড়ানোর সময়। আমি আহ্বান করছি প্রশাসনের দায়িত্বে যাঁরা আছেন তারা নিজেদের দায়িত্ব পালনকালে যেন অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে প্রতিটি ঘটনা কেস বাই কেস বিবেচনা করেন। আমাদের দেশে কোয়ারেন্টিন যেভাবে মানতে হবে তেমনি প্রশাসনকে পারিপার্শ্বিক আর্থসামাজিক অবস্থাও চিন্তা করতে হবে। (চলবে...)

*লেখক: ব্যারিস্টার