পৃথিবী, আজ আমার প্রণতি গ্রহণ করো

বাইরে বৃষ্টি, না ভয়টা বৃষ্টি নিয়ে নয়। প্রতিদিন করোনাভীতি ছড়িয়ে পড়ছে সবার মধ্যে। পৃথিবীর কাঁপানো পরাক্রমশীল শক্তিগুলো মুখ থুবড়ে পড়ছে একে একে। আর যার কাছে এই অসহায়ত্ব, আত্মসমর্পণ, তাঁকে আমরা চোখেও দেখি না। তাঁর শক্তির কথা, ক্ষমতার কথা আমাদের কাছে কয়েক মাস আগেও অজানা ছিল। কেন যেন মনে হচ্ছে আমাদের এই দিনটি দেখার দরকার ছিল।

টেলিফোন, কম্পিউটার ঠিকমতো কাজ না করলে আমরা যেমন শাটডাউন করে আবার রিস্টার্ট করি, তেমনি করোনা আমাদের মানব সভ্যতাকেও একটি প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে বুঝিয়ে দিতে চাইছে যে আমরা যা করছি, তা ঠিক নয়। একদম ঠিক নয়। আমাদের একটি মাত্র পৃথিবীকে আমরা আমাদের দাম্ভিকতায়, স্বেচ্ছাচারিতায় ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছি। আমরা নিজেদের সৃষ্টির সেরা জীব প্রমাণিত করতে গিয়ে ধীরে ধীরে ধ্বংস করে দিচ্ছি আমাদের বড় প্রিয়, বড় আপন একমাত্র পৃথিবীটাকে। আমাদের ‘চাই চাই চাই’ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে আকাশে-বাতাসে। পৃথিবীর সবকিছুতে মানুষ তার সিলমোহর লাগিয়ে ক্ষান্ত হয়নি, এখন আধিপত্য বিস্তারে জল স্থল ভূমণ্ডলের কোথাও একবিন্দু জায়গা বাদ নেই।

কিন্তু এই আধুনিক পৃথিবী তৈরি করতে গিয়ে আমরা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বা সাইড অ্যাফেক্টগুলোর কথা ভাবি না। ওষুধের গায়ে লেখা থাকে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কথা, কিন্তু যান্ত্রিক সভ্যতার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কথা তো কেউ বলে না। বললেও বাণিজ্যিক প্রচারের চাপে সে চিৎকার চাপা পড়ে থাকে। আমরা আমাদের বন উজাড় করে অট্টালিকা করেছি, যার জানালা খুললেও আকাশ দেখা যায় না। পাহাড় কেটে কারখানা করেছি, তার বর্জ্য গিয়ে পড়ছে আমাদের নদী-নালা-খালে। সেই নদীর পানি আমরা পান করা তো দূরের কথা, স্নান করতেও পারি না। পানিতে এত প্লাস্টিক যে বিশেষজ্ঞদের মতে এখন মার্কারির মতো প্লাস্টিকের জন্য মাছ খাওয়া নিরাপদ নয়। প্রাণিকুল খেয়ে উজাড় করেছি, তৈরি করেছি ফার্ম। মানুষ ভুলতেই বসেছে স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠা মাংসের স্বাদ। আর দুধ হলে তো চলবে না, সঙ্গে সুপারশপে থরে থরে সাজানো থাকতে হবে চকলেট মিল্ক, বাটার মিল্ক, বিভিন্ন স্বাদের বিভিন্ন গন্ধের মধ্যে হারিয়ে গেছে সত্যিকারের দুধের স্বাদ। হরেক রকম দই মেয়াদোত্তীর্ণ তারিখসহ।

মায়ের দুধ যেমন মানবসন্তানের জন্মের পর কয়েক বছরের জন্য প্রয়োজন হয়, গরু-ছাগলের ক্ষেত্রেও তাই। সব আয়োজন আমাদের মানবজাতির জন্য। গরুর দুধ লাগবে, মাংস লাগবে, লুই ভিটন বেগ লাগবে, লেদারের সোফা লাগবে। কিন্তু তাঁর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া? না না আমি মায়া-মমতার কথা বলছি না। প্রাণীর প্রাণের জন্য মায়া হবে কেন? প্রাণীর জন্য মায়া হতে নেই!

পরিবেশদূষণের কথা বলছি। বায়ুদূষণের কথা বলছি। এই আলো-বাতাসে এই মহান মানবজাতিকে সেবা দিতেই তো প্রাণীদের জন্ম, তাই না! কিন্তু বিজ্ঞান প্রকৃতিকে অনেক ক্ষেত্রে জয় করেছে যার সবকিছুই কিন্তু আমাদের জন্য ভালো নয়। আমাদের এ আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজে শিল্পবিপ্লব বলে কথা। ‘আরও চাই আরও চাই’ সভ্যতায় বিজ্ঞান গিয়ে পড়েছে তাঁদের হাতে, যাঁরা আগামীকালের চিন্তা না করেই তৈরি করেছে গবাদিপশুর ফার্ম, প্লাস্টিকের কারখানা, গ্যাস রিফাইনারি। উন্নত বিশ্বের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমাদের দেশের মতো উন্নয়নশীল দেশেও চলে প্লাস্টিক বোতল ব্যবহার। যেখানে আবর্জনা সঠিকভাবে ফেলার জায়গা নেই, সেই দেশে রিসাইকেল কী করে করবে?

বাংলাদেশে মুরগির ফার্মগুলোর মতো গবাদিপশুর ফার্ম হয়েছে কি না, আমার জানা নেই। আমেরিকাতে প্রচুর আছে এবং এ দেশের মানুষের প্রোটিন খাওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাঙালিদের গরুর মাংস না হলেই নয়। তাদের জন্য দুটো কথা। পৃথিবীতে যত বায়ু দূষণ হচ্ছে তার ১৮ শতাংশ গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গত হয় এই গবাদিপশুর ফার্ম থেকে। কম মনে হচ্ছে, তাহলে তুলনা করে দেখা যাক। পৃথিবীর যত গাড়ি, উড়োজাহাজ, ট্রাক, জলজাহাজ গ্যাস নির্গত করে তার চেয়েও এর পরিমাণ বেশি। আর এই যে এত বেশি গবাদিপশু তাদের রক্ষণাবেক্ষণ করতে যা খাদ্য লাগে তা দিয়ে ৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন মানুষকে খাওয়ানো যেত। আর এত পশু একসঙ্গে রাখার কারণে রোগ নিরাময় এবং ওজন বাড়ানোর জন্য প্রচুর অ্যান্টিবায়োটিক দিতে হয়। তা আমাদের শরীরে সয়ে যায়, তার কারণে এমন একটা সময় আসবে, আমাদের আর কোনো অ্যান্টিবায়োটিকই কাজ করবে না। ধারণা করা হয়, শুধু যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছর ২৩ হাজার মানুষ মারা যায় অ্যান্টিবায়োটিকরোধী ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে। আমাদের রসনা নিবারণের মাংসের জন্য এই যে মানুষের তৈরি আবর্ত সৃষ্টি হয়েছে এর থেকে কীভাবে আমাদের মুক্তি হবে? কবে হবে? আদৌ কি হবে?

সাইকোলজিতে আমরা Nature vs. Nurture Theory পড়েছি, অর্থাৎ প্রকৃতি বনাম প্রতিপালন, কিন্তু তার মর্মার্থ কখনো অনুধাবন করিনি। আমিও আমেরিকায় না এলে আর আমার ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে না জানলে শিখতেই পারতাম না যে আমরা মানুষ হিসেবে কত স্বার্থপর, কতটা আত্মকেন্দ্রিক, কতটা বোকার রাজ্যে বাস করি। আমরা আমাদের প্রেমে কতটা মশগুল। আমরা শুধু মানুষ হয়ে মানুষের মধ্যেই শ্রেণি-বিদ্বেষ করি না, আমরা মানুষ হয়ে ভাবি, আমরা সৃষ্টির সেরা জীব, তাই শুধু মানুষ কেন, সমগ্র প্রাণিকুল, সমগ্র পরিবেশ সবকিছু শুধু আমাদের আরাধনা করবে। আমরা মানুষ হয়ে মানুষকে সমান ভাবতে পারি না, কী করে অন্য প্রাণী, কিংবা পরিবেশকে সম্মান করব। সম্মান বলতে আমি লালন বোঝাতে চাইছি। এ পৃথিবীকে আমরা লালন করতে বা প্রতিপালন করতে পারিনি, পারছি না। মানুষকে আমরা লালন করতে শিখিনি। আমরা রিকশাওয়ালাকে তুই বলি আর বসকে স্যার। আমরা রাস্তার কুকুরকে অকারণে পিটিয়ে মেরে ফেলি। আমরা আমাদের সন্তানের হাতে ছুরি তুলে দিই পশু জবাই করার জন্য। আমরা জ্যান্ত ব্যাঙ যিশুর মতো চার হাত-পায়ে গজাল ফুটিয়ে বিজ্ঞান শিখেছি। এর মধ্যে কোনো নির্মমতা দেখি না। আমরা কী করে পরিবেশকে লালন করব?

আমি জানি, আপনারা অনেকেই বলবেন, না আমরা কাজের মানুষকেও এক চালের ভাত দিই। বিষয় সেটা নয়। আমাদের মধ্যে যে অহমিকা রন্ধ্রে রন্ধ্রে আছে, তার একটি ছোট্ট উদাহরণ দিই। জানি, আমি যে বিষয় দিয়ে শুরু করেছিলাম তার থেকে অনেক দূরে চলে এসেছি, কিন্তু ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে রেখেই বলছি। সময়টা ছিল যখন আমরা সপরিবারে বাংলাদেশে গিয়েছিলাম। আনন্দে কাটছে দিনকাল। দিনরাত মজার মজার খাওয়া, ক্যারম খেলা, আড্ডা চলছে। আমাদের গৃহকর্মী জেসমিন সারা দিন আনন্দে কাজ করে যাচ্ছেন। চাওয়ার আগেই সব হাজির। আমার ছেলেমেয়ে তাকে জেসমিন আপা বলে ডাকে। একদিন আমরা বসে বসে ক্যারম খেলছি। জেসমিন এল। আমার ছেলে চেয়ার থেকে উঠে বলল, ‘জেসমিন আপা, বসো।’ জেসমিন কিছুতেই বসবে না। ‘আঞ্জিশু ভাইয়্যা, তুমি বসো।’ আমার ছেলেও বসবে না, জেসমিনও বসে না। আমি জেসমিনকে ধমক দিয়ে বললাম, ‘বসিস না কেন? বস।’ জেসমিন বসল বটে, কিন্তু কাঁচুমাচু হয়ে যেন অপরাধ করে ফেলেছে। আমার ছেলেমেয়ে খুব লজ্জিত মায়ের এহেন ব্যবহারে, কিন্তু আমি কী অপরাধ করেছি নিজেই জানি না। পরে জানতে চাইলাম কী অপরাধ করেছি? You have something in your voice that tells that you are better than Jesmin apa. তারপর শুরু হলো, কেন ওকে তুই বলো, তুমি তো সবাইকে তুই বলো না।

আমি নিজেকে ‘উদার’ প্রকৃতির মনে করতাম। কিন্তু আমাদের রক্তের ভেতরে যে ঔদ্ধত্য তাতো বদলাতে পারিনি এত দিন বিদেশে থেকেও। আমরা যে পরিবেশে বড় হয়েছি সেখানে নারচার অর্থাৎ লালন বা প্রতিপালন করার কোনো শিক্ষা নেই। সম্মান করার শিক্ষা নেই। বিজ্ঞান কি আশীর্বাদ না অভিশাপ, সে বিতর্ক স্কুলের বিতর্ক প্রতিযোগিতায়ই সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে। আমরা সীমা টানতে শিখিনি। আমরা বড় ভুল করে অনেকটা পৃথিবী ধ্বংস করে দিয়েছি। আমরা পৃথিবীর প্রাণটা টুঁটি চেপে ধরে মরতে বসেছি। আজ করোনা আতঙ্কের দিনগুলোতে পৃথিবী বুক ভরে নিশ্বাস নিচ্ছে। আমরা দূরদর্শনে দেখছি এখন পৃথিবীর বায়ুদূষণ কমে গেছে।

ইতালির খালগুলোতে রাজহংস ভেসে বেড়াচ্ছে যেমন কথা ছিল। সমুদ্রসৈকতে সাগর থেকে উঠে এসে কাছিমেরা নির্বিঘ্নে ডিম পেড়ে যাচ্ছে যেমন কথা ছিল, ডলফিনেরা সমুদ্রসৈকতের কাছে খেলছে, হরিণেরা শহরের পথে ঘুরছে, মানুষের ঘরের পাশেই চলছে, যেমন মানুষ আর সব প্রাণীর পৃথিবীটাতে মিলেমিশে থাকার কথা ছিল। আর মানুষ তার আপনজনদের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছে যেমন কথা ছিল। এভাবেই আবার পৃথিবী তার কেন্দ্রে ফিরে এসেছে।

একদিন করোনা নিশ্চয়ই চলে যাবে। পৃথিবীর সব দুর্যোগ মানুষ সয়ে যায়, আবার মানবসভ্যতা জেগে ওঠে। এবারও উঠবে, কিন্তু এবার যেন আমরা আর একটু মানবিক হতে শিখি, মানুষের প্রতি, প্রতিটি প্রাণের প্রতি—সে প্রাণ মানুষ, কুকুর কিংবা মৌমাছির হোক। আমরা যেন পৃথিবীকে লালন করতে পারি, পৃথিবীর প্রতি আমরা যেন আর একটু বিনয়ী হই। কারণ পৃথিবী বুক ভরে নিশ্বাস নিলে আমরা বাঁচব! তখন ভালোবাসা ছাড়া আর কোনো ছোঁয়াচে ব্যাধিতে পৃথিবী আক্রান্ত হবে না।