কোয়ারেন্টিন মানুষকে আবার বাস্তব জীবনে ফিরিয়েছে

দুশ্চিন্তা আর আতঙ্কের প্রহর পেরিয়ে পার হচ্ছে একেকটা দিন। সবাই বলছেন বাসায় থাকুন, নিরাপদ থাকুন, নিরাপদ রাখুন। করোনা মহামারিকে রুখে দেওয়ার এই একটাই মোক্ষম উপায় এখন পর্যন্ত মানুষের আয়ত্তে আছে যত দিন পর্যন্ত না প্রতিষেধক বাজারে আসছে। এখন আমরা আসলে বায়ুসমুদ্রে ভাসমান করোনার জালের মধ্যে বেঁচে আছি। কখন যে করোনার কারেন্ট জাল কার গলার ফাঁস হবে, কেউ বলতে পারে না। আর এই জাল কে বড় আর কে ছোট, সেই বাছবিচার করছে না। শত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং সাবধানতাও এই জীবাণুর প্রাদুর্ভাব রুখতে পারছে না। জানি না কোথায় গিয়ে এর শেষ হবে।

এর মধ্যেও আমাদের অফিস চলছে পুরোদমে। কারণ কনস্ট্রাকশন ইন্ডাস্ট্রি যেকোনো দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকা শক্তি আর এ কথাটা অস্ট্রেলিয়ার জন্য আরও বেশি সত্যি। অবশ্য অফিসে যথাযথ নিয়ম মেনে চলা হচ্ছে। এমনিতে অফিসে আমাদের তলায় মানুষগুলো আমরা বসি অনেক দূরে দূরে, তাই সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাটা খুব একটা সমস্যা হচ্ছে না। এ ছাড়া অফিসে ঢোকার দরজা এবং টয়লেটে যাওয়ার দরজা এখন সারাক্ষণই খুলে রাখা হচ্ছে ইট দিয়ে ঠেকনা দিয়ে। আর অফিসে ঢোকার মুখেই রাখা আছে স্যানিটাইজারের বোতল, যাতে বাইরে থেকে কেউ এলে সবার আগে সেটা দিয়ে হাত জীবাণুনাশক করে নেয়। এ ছাড়া অফিসে একটা তালিকা টানিয়ে দেওয়া হয়েছে, কে কখন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালাবে। সেই মোতাবেক আমরা সবাই রুটিন করে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখছি।

এরই মধ্যে গত সপ্তাহের বুধবার যেতে হলো সাইট পরিদর্শনে। প্রত্যেক মাসেই সাইটের কাজের অগ্রগতি দেখতে যেতে হয়। পারামাটা স্টেশনের পরিবর্ধনের কাজ চলছে। আজ থেকে বছর পাঁচেক আগে যাঁরা পারামাটা স্টেশনকে দেখেছেন এখন তাঁরা আর সেটা চিনতে পারবেন না। পরিবর্ধনের কাজকে অনেকগুলো স্লটে ভাগ করে কাজ চলছে। আমাদের কোম্পানি তার মধ্যে চারটা স্লটের ম্যাশনারির (রাজমিস্ত্রির) কাজ পেয়েছিল। দুটোর কাজ ইতিমধ্যেই শেষ হয়েছে, এখন চলছে বাকি দুটোর কাজ।

পারামাটা সিডনি শহরের অন্যতম ব্যস্ত এলাকা। স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম লোকে লোকারণ্য থাকে সব সময়। সেই পারামাটা স্টেশনে এখন কজন মানুষ ট্রেনের অপেক্ষায় আছে, সেটা আঙুলের কর গুনেই বলে দেওয়া যায়। পারামাটা স্টেশনের ভেতরে যাওয়া এবং বাইরে যাওয়া পথের পাশে স্যানিটাইজার রেখে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া সাইটগুলোতে রাখা হয়েছে স্যানিটাইজার।

পারামাটা সাইট পরিদর্শন শেষে যেতে হলো সিডনির প্রাণকেন্দ্রে। সেখানে রীতিমতো অবাক হয়ে গেলাম। রাস্তার ফুটপাত একেবারে ফাঁকা যেখানে আগে হাঁটতে বেগ পেতে হতো। এখন সেখানে হেলেদুলে হাঁটলেও কারও সঙ্গে ধাক্কা খাওয়ার সুযোগ নেই। সিডনি শহরে নতুন বেশ কিছু ট্রামলাইন বসানো হয়েছে কিন্তু মানুষ আগের মতোই ইতিউতি ট্রামলাইনগুলো পার হতো বলে জরিমানা পর্যন্ত করা হয়েছে। সেখানে কোনো জনমানুষ নেই। আমি উইনার্ড স্টেশনে নেমে হেঁটে হেঁটে সাইটে যাচ্ছিলাম আর আশপাশে দেখছিলাম। ফুটপাতে বসা উদ্বাস্তুগুলোও নেই। শুধু মার্টিন প্লেসের ঝরনার পাশে এক ভদ্রলোক পোজ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ওনার সেদিনের বিষয়বস্তু ছিল উনি দেশের বাইরে যাচ্ছেন। ওনার ডান হাতে একটা ছোট স্যুটকেস ধরা, বাতাসে ওনার গলার টাই পেছনে উড়ে যাচ্ছে আর উনি ত্রস্তে পা ফেলছেন। ঠিক এই ভঙ্গিমায় বেশিক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। তাই উনি একটু পরপর সোজা হয়ে সামনে রাখা বাক্সে মানুষের ফেলা কয়েন গুনে গুনে পকেটে রাখছেন। আমার কাছে কোনো নগদ টাকা না থাকাতে ওনাকে কোনো ধরনের সাহায্য করা সম্ভব হলো না।

শহরের সাইট পরিদর্শন শেষ করে ট্রেনে করে সিডনির প্রধান ট্রেন টার্মিনাল সেন্ট্রালে ফিরে এলাম। সেন্ট্রাল স্টেশন সব সময়ই লোকজনের ভিড়ে গমগম করে কিন্তু সেদিন সেখানে কোনো ভিড়ই চোখে পড়ল না। প্ল্যাটফর্মে আসা-যাওয়ার সিঁড়িতে মানুষের সঙ্গে অবধারিত ধাক্কা লাগে কিন্তু সেদিন আর কোনো ধাক্কা লাগার ভয় ছিল না। আমি এলিজাবেথ স্ট্রিটের দিকে বের হয়ে এলাম। এলিজাবেথ স্ট্রিট পার হয়ে আমাদের অফিসে যাওয়ার বাসে উঠতে হয়। এই রাস্তা পার হওয়ার সময় অনেক ভিড় থাকে। অনেক মানুষ দুদিক থেকে একসঙ্গে রাস্তা পার হয় তাই খুব সাবধানে রাস্তা পার হতে হয়, অন্যথায় অন্য দিক থেকে আসা মানুষের সঙ্গে ধাক্কা লেগে মাঝরাস্তায় পপাত ধরণিতল হওয়ার সুযোগ থাকে কিন্তু সেদিন আমি একেবারে আয়েশ করে রাস্তা পার হলাম আর মাত্র দুজন মানুষের সঙ্গে।

এদিকে বাসায় সবাই মোটামুটি অবরুদ্ধ দিন পার করছেন। নিয়ম অনুযায়ী আপনি পার্কে যেতে পারবেন কিন্তু সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। অনেকেই সেটাকে বুঝেছে যে অকারণে বাইরে যাওয়া নিষেধ। আমিও তেমনটাই বোঝালাম, তাই শুধু বাজারঘাট আর আমার এবং বাচ্চাদের চুল কাটানো ছাড়া বাইরে যাচ্ছি না। অন্যদিকে গিন্নি প্রতিদিন হাসপাতাল থেকে ফিরে এসে আগে গোসল করে তারপর বাচ্চাদের ধরে, কারণ চিকিৎসা করতে গিয়ে তাকে প্রায় দিনই করোনা-আক্রান্ত রোগীদের সংস্পর্শে আসতে হয়। গত শুক্রবারে সে এবং তার রেজিস্ট্রার হাসপাতালে করোনার পরীক্ষার জন্য রক্ত জমা দিয়েছিল। ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ফলাফল দেওয়ার কথা। যদি পজিটিভ হয়, তাহলে কল দেবে, আর যদি নেগেটিভ হয় তাহলে খুদে বার্তা দেবে। শনিবারও কোনো উত্তর এল না হাসপাতাল থেকে। রোববার আমি তাই জিজ্ঞেস করলাম। উত্তরে সে বলল, হাসপাতাল থেকে খুদে বার্তা দিয়েছে ফলাফল নেগেটিভ। আমরা অনেকটা হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম কিন্তু কত দিন নেগেটিভ থাকা যাবে জানি না, কারণ প্রাদুর্ভাব এখন পর্যন্ত মহামারির রূপ নেয়নি।

বাচ্চাগুলো যেহেতু বাইরে যেতে পারছে না, তাই বাসায় বসে বিরক্ত। কতক্ষণ আর ঘরে বসে থাকতে ভালো লাগে। অনেকেই বাচ্চাদের সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের নতুন নতুন খেলাধুলা করছে। কেউ হয়তোবা খেলছে আমাদের শৈশবের চোর-পুলিশ খেলা আবার কেউই হয়তোবা বসে গেছে লুডু নিয়ে আবার কেউ বসে গেছে ক্যারম নিয়ে। আমাদের বাসায় খেলাধুলার এসব উপকরণের পাশাপাশি ফুটবল, বাস্কেটবল, ক্রিকেট খেলার সরঞ্জামও আছে কিন্তু চার বছরের রায়ানকে এর কোনো কিছুর সঙ্গেই যুক্ত করা যায় না। কারণ সে এক মুহূর্তের জন্যও কোথাও স্থির হয়ে বসে না। এমনকি আমি একদিন রাস্তায় সাইকেলের একটা পুরোনো টায়ারও কুড়িয়ে নিয়ে এসে রেখেছিলাম। আমার মেয়ে তাহিয়া সেটা বেশ কদিন চালিয়েওছিল। এ ছাড়া ঘরের মধ্যে লাফালাফি করার জন্য ছোট একটা খেলনা কিনে এনে রাখা হয়েছে। আমাদের দুজনের যেহেতু অফিস চলছে, তাই বাধ্য হয়ে ওদেরকেও স্কুলে এবং চাইল্ড কেয়ারে যেতে হচ্ছে কিন্তু স্কুলে উপস্থিতির হার একেবারে কমে এসেছে। আমার মেয়েটার স্কুলে মোট ৩২০ জন ছাত্রছাত্রীর মধ্যে এখন সর্বসাকল্যে ২০ জন আসে আর ওদের ক্লাসে এখন হাতেগোনা দুই-তিনজন আসে। তাই আপাতত মেয়েটাকে এখন আমাদের প্রতিবেশী বড় ভাই আশফাক ভাই দিশা আপুদের বাসায় রাখা হচ্ছে। তাহিয়া সারা দিন ওখানেই থাকে আর ওনাদের মেয়ে আলিশা এবং ছেলে দৃপ্তর সঙ্গে খেলাধুলা করে। আর রায়ান যথারীতি কেয়ারে যাচ্ছে।

কোয়ারেন্টিনের এই সময়ে সবাই মোটামুটি বাসাবন্দী। যাঁরা হোম অফিস করছেন তাঁরা তো বাসাতেই আছেন। এ ছাড়া যাঁরা অফিস করছেন তাঁরাও সপ্তাহান্তের দুটো দিন এখন বাসাতেই কাটাচ্ছেন পরিবারের সঙ্গে। এতে করে পরিবারে অনেকটাই ছন্দ ফিরে আসতে শুরু করেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে আমি সব সময়ই অসামাজিক বানানোর যন্তরমন্তর ঘর বলি। ইদানীং বিষয়টা এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছিল মানুষের স্বাভাবিক জীবন হুমকির মুখে পড়েছিল। কোয়ারেন্টিন মানুষকে আবারও বাস্তব জীবনে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে। অবসরে পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানোর পাশাপাশি এখন দূরদূরান্তে থাকা আত্মীয়স্বজনকেও তাঁরা খোঁজ নিতে পারছেন অফুরান সময়ের প্রভাবে। যাঁদের সঙ্গে বহু দিন কথা হয়নি তাঁদের পর্যন্ত খোঁজ নেওয়ার সময় পাওয়া যাচ্ছে। যার ফলে বাস্তব জীবনের স্বাভাবিক সামাজিকতা ফিরে আসতে শুরু করেছে। এ ছাড়া কোয়ারেন্টিনের এই কঠিন সময়ে মানুষ যখন নিজেদের ঘরে সবকিছু মজুত করতে শুরু করেছে, তখন অনেকেই আবার নিজেদের জীবন বিপন্ন করে এগিয়ে এসে মানবতার জয়গান গাইছে।

কোয়ারেন্টিনের দিনগুলোতে পৃথিবী কিছুটা হলেও তার হারানো সৌন্দর্য ফিরে পেতে শুরু করেছে। ঢাকা শহরের ফুটপাত এবং রাস্তার মাঝের দ্বীপগুলোতে লাগানো গাছগুলো ধুলার পুরো আস্তরণে সব সময় আবৃত থাকত তাই ঠিক বোঝা যেত না সেগুলো জীবিত না মৃত। এখন সেগুলোতে বসন্তের আগমনী বার্তা দেখা যাচ্ছে। ফুলে ফুলে গাছের শাখাগুলো ভরে উঠেছে। অস্ট্রেলিয়াতে সবাই বাসার বাইরে বাগানের পরিচর্যায় মনোযোগী হয়ে উঠেছে। শম্পা আপু আর নাসের দুলাভাই আরও একটু বড় পরিসরে তাঁদের কাজ শুরু করেছেন। ওনারা পুরো বাসার ল্যান্ডস্কেপিং বদলে দেওয়ার প্রজেক্ট হাতে নিয়েছেন। যার ফলে বাসার সৌন্দর্য বহুগুণে বেড়ে যাচ্ছে। ওনারা সময়ে সময়ে আমাদের বুদ্ধি দিয়ে যাচ্ছেন আমরা আমাদের বাসার সামনে-পেছনে আর কী কী ফুল-ফলের গাছ লাগাতে পারি।

যা-ই হোক, দুঃস্বপ্ন এবং দুর্ভাবনাকে সঙ্গে করে জীবনের একেকটা দিন তার নিজস্ব নিয়মে চলে যাচ্ছে। আর আমরা আশাবাদী হচ্ছি একদিন এই মহামারি কাটিয়ে উঠে আমরা আবারও স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারব। ইতিমধ্যেই অস্ট্রেলিয়ার একদল বিজ্ঞানী দাবি করেছেন, তাঁরা করোনার টিকা আবিষ্কার করে ফেলেছেন। এখন চলছে তার পরীক্ষামূলক প্রয়োগ। এক সময় এই টিকা বাজারে চলে আসবে সেদিন হয়তোবা আর বেশি দূরে নয়, তত দিন আমাদের একটু কষ্ট করে হোম কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে। অবশ্য কোয়ারেন্টিনে থাকাটা একেবারে খারাপ না, কারণ অনেক বন্ধন নতুন করে জোড়া লাগছে। কোয়ারেন্টিনের এই দিনগুলোতে আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে আমাদের পাশেই অনেক মানুষ অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটাচ্ছে। আমরা প্রত্যেকেই যদি আমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী তাঁদের পাশে দাঁড়াই, তাহলে আবারও আমরা সবাই সম্মিলিতভাবে করোনার এই মহামারি কাটিয়ে সুন্দরভাবে বাঁচতে পারব। আর পাশাপাশি প্রকৃতির সঙ্গেও বিমাতাসুলভ আচরণ করা থেকে আমাদের বিরত থাকতে হবে, কারণ একটা প্রাকৃতিক, সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং সুন্দর পৃথিবী গড়তে হলে আমাদেরই একসঙ্গে কাজ করতে হবে।