এভাবে বিশৃঙ্খল থাকলে যুদ্ধে জিতব কীভাবে

দুদিন আগে এক আমেরিকান নার্সের ইন্টারভিউ দেখলাম। তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। কারণ, তাঁকে পিপিই ছাড়া কাজে পাঠানো হয়েছে এবং তিনি নিজের ও নিজের পরিবারের জীবন নিয়ে উদ্বিগ্ন। কেঁদে ফেললেন। কারণ, নার্সিং পেশাকে তিনি জীবনের অংশ মনে করতেন, এই পেশাকে ভালোবাসতেন, এটিই তাঁর ইবাদত। ২০ বছর ধরে তিনি এই পেশায় যুক্ত আছেন। কিন্তু এখন তিনি বাধ্য হলেন চাকরি ছাড়তে। কারণ, নিজের স্বামী-সন্তানের নিরাপত্তা তাঁর কাছে সবচেয়ে বেশি জরুরি।


ঘটনাটি এ দেশের আরও হাজারো নার্সের। হাজারো ডাক্তারের। পিপিই সংকটে পুরো দেশ পড়েছে। গোটা বিশ্বে এখন পরিস্থিতি এক। কার প্রায়োরিটি বেশি? রোগীর সেবাকারী নার্স? নাকি তাঁর চিকিৎসা করা ডাক্তার? আমরা অনেকেই বুঝতে পারছি না যে আমরা এখন যুদ্ধের ময়দানে আছি। যুদ্ধের সামনে থেকে লড়াই করা সেনাবাহিনীর মতোই গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছেন তাঁকে রসদ জোগানো জওয়ানেরা। একজন সৈনিক না খেয়ে কত দিন লড়তে পারেন? অস্ত্রের, গোলাবারুদের জোগান না এলে সে খালি হাতে লড়তে পারবে? অসুস্থ সৈনিককে চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করা ডাক্তার, সেবাদানকারী নার্স—সবাই একেকজন যোদ্ধা। এটা সবাই মানেন। তেমনি বর্তমান পরিস্থিতিতে, করোনার বিরুদ্ধে লড়তে থাকা ডাক্তার, নার্স, এমনকি হসপিটালের জেনিটার (মেথর) পর্যন্ত একেকজন যোদ্ধা। পদবি ভিন্ন, কিন্তু প্রত্যেকের ভূমিকা এখানে অপরিহার্য।

সঙ্গে যোগ করুন হসপিটালের বাইরের বিজনেসগুলো। যেমন গ্রোসারি। ধরা যাক ওয়ালমার্ট, টার্গেট, ক্রোগার, সিভিএস ফার্মেসি বা ওয়ালগ্রিন্স। এসব দোকান বন্ধ করে ফেললে রাতারাতি খাদ্যের আকাল নেমে আসবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর জোগান যেন স্থির থাকে, সে জন্য গ্রোসারি স্টোরগুলো চালু রাখতেই হবে। সেটাই সরকার রেখেছে। এবং এসব স্টোরে কাজ করা প্রত্যেক কর্মচারী একেকজন যোদ্ধা। তাঁদের মাস্ক থাকে, গ্লাভস থাকে, হ্যান্ড স্যানিটাইজার থাকে, তাঁদের দোকানের ফ্লোর অনবরত পরিষ্কার করা হচ্ছে কঠিন জীবাণুনাশক দিয়ে। পুরোদস্তুর যুদ্ধের প্রস্তুতি। কারণ তাঁরাও যোদ্ধা।

এই যুক্তিতেই, গার্মেন্টস শিল্প চালু রাখা মহাগুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যাপার। কারণ, পিপিই সাপ্লাই লাগবে। দেশের হসপিটালে লাগবে। বিদেশেও পাঠাতে হবে। না হলে ডাক্তার মরবে, নার্স মরবে, রোগীদের কথা বাদই দিলাম। কারণ, এ মুহূর্তে গার্মেন্টস কর্মীরাও একেকজন যোদ্ধা। তাঁরা আমাদের সেনাবাহিনীকে রসদ জোগান দেবেন। বিশ্বের সব দেশে গার্মেন্টস সিস্টেমই নেই, আমাদের দেশ সেই হাতে গোনা কয়েকটি দেশের অন্যতম। মানবজাতির পক্ষে এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমাদের ভূমিকা অতি গুরুত্বপূর্ণ।

হ্যাঁ, আমাদের দেশে ‘হয়তো’ টাকার কারণেই গার্মেন্টস চালু রাখা হয়েছে। হয়তো পিপিই আমাদের দেশে কম এবং বিদেশে পাচার বেশি হবে, কিন্তু আমাদের পিপিই লাগবেই। এইটা ফ্যাক্ট। ডাক্তারের পয়েন্ট অব ভিউ থেকে চিন্তা করুন, নার্সের পয়েন্ট অব ভিউ থেকে চিন্তা করুন। কিছুদিন আগেই সরকার যখন বলেছে, পিপিই ছাড়া হলেও ডাক্তাররা চিকিৎসা দিতে বাধ্য, তখন আমরাই সরকারকে গালাগালি করেছি।

এই পর্যন্ত সবাই সহমত?
এখন আসি আসল ঘটনায়।
যেহেতু এটি একটি যুদ্ধক্ষেত্র, তাই এখানে একটি মাস্টারপ্ল্যান থাকা প্রয়োজন। সঙ্গে প্ল্যান বি, প্ল্যান সি, প্ল্যান ডি থেকে শেষ পর্যন্ত অনেক ব্যাকআপ থাকতে হয়। একটা কাজ না করলে স্মুদলি ট্রানজিশন যেন হয়, সেটা খেয়াল রাখতে হয়। এখনকার ভয়ংকর পরিস্থিতিতে যেমন যেসব কোম্পানি বাড়ি থেকে কাজ করার সুবিধার নিয়ে প্রস্তুত ছিল, তারা প্রাথমিক ধাক্কা সামলে উতরে গেছে। যাদের এই প্রস্তুতি ছিল না, তারা ইতিমধ্যেই বন্ধ হয়ে গেছে। এটাকে বলে প্ল্যান বি।

আপনি আপনার সিপাহির হাতে মরিচের গুঁড়া দিয়ে বললেন, বিপক্ষের এম-১৬ বা একে-৪৭ এর বিরুদ্ধে গিয়ে লড়ো, তা হয় না। সব যোদ্ধাকেই কিছু না কিছু প্রস্তুতি দিয়ে মাঠে নামানো হয়। আমাদের দেশে সেটারই অভাব। এই যে এত দিন ধরে চিল্লাচিল্লি করা হলো যেন মসজিদ বন্ধ হয়, জুমা স্থগিত হয়, স্কুল–কলেজের বন্ধ বাড়ানো হয়, অফিস বন্ধ হয়, মিলিটারি নামানো হয়—সব এক ফুৎকারে উড়ে গেল এই গার্মেন্টস চালুর ঘটনায়। লাখে লাখে মানুষ গায়ের সঙ্গে গা ঘেঁষে ঢাকা শহরে ফিরেছেন। মুখে মাস্ক থাকলেই এই রোগ থেকে বাঁচা যায় না, এ সামান্য সচেতনতা পর্যন্ত তাঁদের নেই।

‘কিয়ের সামাজিক দূরত্ব? মায়েরে বাপ। আমি আইছি আমার কাম করতে।’ এই হচ্ছে গার্মেন্টস কর্মীদের মেন্টালিটি। তাঁদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। বিশ্বের অন্য বড় বড় রাষ্ট্রের মতো এই ঘটনার একদম শুরু থেকেই আমরা অতি বিশৃঙ্খলভাবে এগোচ্ছি।

প্রথমে আমরা উড়িয়েই দিলাম ‘এটি কোনো ব্যাপারই না। সর্দি–কাশির মতন ঘটনা’ বলে। আমাদের কোনো প্রস্তুতিই ছিল না, যখন আঘাত এল, তখন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ভদ্রলোক বলে দিলেন, ‘হোম কোয়ারেন্টিনই আমাদের গত আড়াই মাসের প্রস্তুতি।’
কথাটা কিন্তু খুবই যৌক্তিক। আমাদের দেশে আসলেই সম্ভব নয় সবাইকে হসপিটালে এনে চিকিৎসা করানোর। আমাদের সেই বাজেট নেই, আমাদের সামর্থ্য নেই। ইউরোপ আমেরিকার সঙ্গে তুলনা করে লাভ নেই, আমরা গরিব দেশ, এইটা স্বীকার করে নিতেই হবে। তা এই ব্যাপারটা আগে থেকে বলবেন না? মানুষ তাহলে আড়াইটা মাস ধরে প্রস্তুতি নিতে পারত। বিটিভিকে ব্যবহার করা যেত গণসচেতনতা বৃদ্ধিতে। নব্বইয়ের দশকে যেমন আমাদের সচেতন করা হতো বৃক্ষরোপণের ব্যাপারে, খাওয়ার স্যালাইনের ব্যাপারে, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে, জাটকা মাছ না ধরার ব্যাপারে, পোলিওসহ সব ধরনের টিকা গ্রহণে—মনে আছে সেই সব বিজ্ঞাপনের কথা? আব্দুল কুদ্দুস বয়াতি গান গাইতেন হুমায়ূন আহমেদের লেখা গণশিক্ষাবিষয়ক অমর গান, ‘এই দিন দিন নয় আরও দিন আছে, এই দিনেরে নিবা তোমরা সেইদিনেরও কাছে...।’ মনে আছে?

দেশের সব কয়টা টিভি চ্যানেল একযোগে প্রচার চালালে আড়াইটা মাসে আমরা শিখে যেতাম কীভাবে হোম কোয়ারেন্টিনে থাকতে হয়। কী করতে হয়, কী থেকে বিরত থাকতে হয়। কিন্তু যতক্ষণে মন্ত্রী সত্য স্বীকার করেছেন, তত দিনে আমরা দেখলাম, কোয়ারেন্টিনে থাকা লোকজন বাজারে ঘুরে বেড়াচ্ছে, না হয় কোয়ারেন্টিন জিনিসটা কী, সেটা দেখতেই লোকে ভিড় করছে।

কিংবা যেদিন স্কুল বন্ধের ব্যাপারে শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্যের পরদিনই ঘোষণা আসে স্কুল-কলেজ বন্ধের। এসবের মানে আমরা নিজেরাই কোনো প্ল্যান ছাড়া এগোচ্ছি। হুজুগে চলছি।

এনিওয়ে, একই কথা বারবার ঘ্যান ঘ্যান করতে ভালো লাগে না। যা হওয়ার হয়ে গেছে। এখন বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলা যাক।

এখন যেমন গার্মেন্টস কর্মীদের আমাদের দরকার, তেমনি তাঁদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণটাও আমাদের প্রয়োজন। তাঁরাই আমাদের পিপিই বানাবেন, এবং তাঁদেরকেই সবার আগে পিপিই শরীরে জড়িয়ে কারখানায় যেতে হবে। গ্লাভস হাতে সবকিছু হ্যান্ডেল করতে হবে। মুখের মাস্ক খুলতেই পারবে না। জীবাণুনাশক দিয়ে প্রতি ১০ মিনিট পরপর হাত ধুতে হবে। ব্লিচিং পাউডার দিয়ে শরীরের কাপড় প্রতিদিন ধুতে হবে, পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। গোটা গার্মেন্টস ফ্লোর অনবরত জীবাণুনাশক দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে ইত্যাদির প্রস্তুতি আমাদের গার্মেন্টস মালিকেরা নিয়েছেন? গার্মেন্টস কর্মীদের রোগটি সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন করা হয়েছেন তো? না হলে ‘সামাজিক দূরত্বের মায়েরে বাপ’ বলা লোকদের নিয়ে কীভাবে মাঠে নামবেন?

সবাইকে ঢাকা শহরে ডেকে এনে বিজিএমইএ হুট করে ঘোষণা দিল, ১৪ তারিখ পর্যন্ত কারখানা বন্ধ রাখতে হবে, এ থেকেই তো বোঝা যাচ্ছে, আমরা এখনো অগোছালোভাবে লড়ছি। আমাদের প্ল্যানিংয়ে কোনোই স্পষ্টতা নেই, ধারাবাহিকতা নেই। এভাবে বিশৃঙ্খল থাকলে আমরা যুদ্ধে জিতব কীভাবে?