জার্মানিতে করোনার দিনগুলো

করোনা ভাইরাসের কারণে কেউই বাইরে বের হচ্ছেন না।
করোনা ভাইরাসের কারণে কেউই বাইরে বের হচ্ছেন না।

বিশেষ প্রয়োজনে একপ্রকার বাধ্য হয়েই আজকে ( ২৫ মার্চ) বাইরে বের হয়েছিলাম। কাজ সেরে ভাবলাম, বের যেহেতু হয়েছি পাশেই সুপারশপ টুকটাক দরকারি জিনিসপত্র কিনেই যাই।

হ্যান্ডসাম, হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহারের পরও যথেষ্ট সতর্কতার সঙ্গে বাজার করলাম। যাওয়ার সময় হেঁটে আর আসার সময় বাধ্য হয়েই বাসে আসলাম তবে দাঁড়িয়ে, স্পর্শ এড়িয়ে চলা আরকি!

স্বামী আগে থেকেই রুমের দরজা, বাথরুমের দরজা খুলে রেখেছিল। বাইরে ব্যবহৃত পোশাক, ব্যাগ আলাদা রুমে রাখি। বাইরে যাওয়ার আগেই বাথরুমে গোসলের প্রয়োজনীয় সব রেখে গিয়েছিলাম যেন বাসায় কোনো কিছু স্পর্শ না করে গোসল করে, কিছুটা নিরাপদ হয়ে বাসার কাজকর্ম করতে পারি। আমি বাথরুমে থাকাকালীন স্বামী স্যানিটাইজার দিয়ে দরজার হাতল পরিষ্কার করে ফেলেছে, যদিও আমি ওসব সেভাবে স্পর্শ করিনি।

ফ্রেশ হয়ে দুজন মিলে বাইরে থেকে আনা প্রতিটা জিনিস প্যাকেট পরিবর্তন করে নতুন প্যাকেটে নিয়ে তবেই ফ্রিজ আপ করেছি। ফ্রুট আলাদা করে রাখা হয়েছে ভালো করে ক্লিন করার জন্য। আর জুসসহ অন্যান্য প্যাকেট জাতীয় খাবার জীবাণুনাশক দিয়ে মুছে রাখা হয়েছে। হয়তো একটু বেশি অশুচি দেখানো হয়েছে কিন্তু এই একটু বাড়াবাড়ি যদি একটু বেশি নিরাপদ রাখে তা দোষের না। তারপরও মনের ভেতর খচখচ করছে, অশুচি লাগছে।


এতসব নিরাপত্তা কারণ বাসায় আমাদের ছোট্ট সোনা আছে। নিজেদের আর সব থেকে বেশি তার নিরাপত্তার কথা আমাদের ভাবতে হয়। ছেলের কথা ভেবে দুজনেই চাকরি ছেড়ে বাসায় থাকি। প্রতিদিন ফল, বাদাম, পর্যাপ্ত পানি, জুস, ভিটামিন সি যুক্ত খাবার আর প্রোটিন খাওয়ার চেষ্টা করি। তবে যেহেতু বাজার করতে সমস্যা আর আগের থেকে অনেক কম মুভিং হয় তাই খাবার একটু কম খাওয়া হয়। কম খাবার বেশি পুষ্টি।

ফেসবুক, মুভি, নাটক দেখা, বই পড়া, গান শোনা আর আল্লাহর নাম নিয়ে নতুন ভোরের আশায় কেটে যাচ্ছে ভয়ংকর দিনগুলো।

জার্মানিতে দিন দিন করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়ছে। গত সপ্তাহের আগে একবার বাইরে গিয়েছিলাম তাও বিশেষ প্রয়োজনে। যে বাসে বেশির ভাগ সময় দাঁড়িয়ে যেতে হতো সেই বাসে আমি একলা যাত্রী! রাস্তাঘাটে লোকজন কম, খুব প্রয়োজন ছাড়া কেউ বাইরে যাচ্ছেন না। সুপারশপগুলোতে টয়লেট টিস্যু, কিচেন টিস্যু, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, গ্লাভস, ক্যান ফুডস ছাড়া অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস পাওয়া যাচ্ছে। আর পণ্যদ্রব্যের দামও স্বাভাবিক। তবে বড় শহরগুলোতে শুনেছি দাম না বাড়লেও পণ্যদ্রব্যর বিশেষ অভাব রয়েছে। ফলে যেসব পণ্যের চাহিদা বেশি সেসব পণ্য একজন ব্যক্তি একটার বেশি কিনতে পারেন না।

পরিবারের সঙ্গে লেখক।
পরিবারের সঙ্গে লেখক।

জার্মানিতে টয়লেট টিস্যুর মারাত্মক সংকট চলছে! প্রায় প্রত্যেকেই প্রয়োজনীয় পণ্য সপ্তাহ থেকে মাসের জন্য মজুত করে রেখেছেন। বাজারে কোনো কিছুর অভাব সেভাবে নেই কিন্তু বাইরে বের হওয়া ঝুঁকি বলে কেউ খুব প্রয়োজন ছাড়া বের হতে চায় না। এখানেও ফার্মেসি, ব্যাংক, ডেলিভারি খাবারের দোকান, হসপিটাল, সুপার শপ ইত্যাদি খোলা আছে। সরকার ঘোষণা দিয়েছে দুজনের বেশি মানুষ এক সাথে আড্ডা দিতে পারবেন না আর বাইরে দেড় মিটার দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হবে।

শীত প্রধান দেশে রৌদ্র জ্বল দিন মানেই পার্টি আমেজ, তার মধ্যে তাপমাত্রা এখনো ১-১০ ডিগ্রির মধ্যে। ৩-৪ দিন হয় দারুণ রোদ উঠছে, তাই লোভ সংবরণ অনেকের কাছেই সম্ভব হচ্ছে না। বিশেষ করে কাপলরা বের হচ্ছে বেশি। এখানেও কিছু লোকজন আছে যারা এই ভাইরাস সংক্রমণের ব্যাপারটি কে এখনো সেভাবে গুরুত্ব দিচ্ছেন না, তাদের এই অসচেতন আচরণের কারণেই সংক্রমণের সংখ্যা বাড়ছে!

প্রবাসে আমাদের সময়ই কাটে দেশের চিন্তা করে। করোনার ভয়াল থাবায় আমাদের দেশের কথা ভেবে আমরা প্রবাসীরা ঘুমাতে পারি না, প্রতি মুহূর্তে দেশের সবাইকে সতর্ক করছি কিন্তু কেউ যে ব্যাপারটা সেভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে না এটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মানুষজন যতটা না সচেতন পোস্ট দিচ্ছে বাস্তবে আসলে তারা সেরকম সচেতন না। তার প্রমাণ স্কুল ছুটিতে বিনোদন স্পটে ঘুরতে যাওয়া, গ্রামে মানুষের ঢল, প্রবাস থেকে ব্যাপক পরিমাণ মানুষ দেশে ফেরা! অনেকেই প্রবাসীদের অসচেতন বলে গালি দিয়েছে অথচ সেই শিক্ষিত লোকজনই সরকারি ছুটি পেয়ে গ্রামে ঈদের আনন্দ করতে ছুটে চলেছে।

আমাদের দেশের সাধারণ জনগণ বাস্তবিক অর্থে সচেতন আর দায়িত্ববান নয়। ভয়ংকর পরিণতি অপেক্ষা করছে আমদের জন্য, ভাবতেই গা শিউরে ওঠে। মহান আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা ছাড়া আর কিছুই করার নেই আমাদের প্রবাসীদের। আমরা ইউরোপে থেকে নিয়ন্ত্রিত আর নিয়মমাফিক জীবন চালাতে পারছি। নিজেরা একটু সচেতন থাকলে এই বিপদ থেকে দেশের বিদেশে সবাই রক্ষা পাব। কিন্তু অনিয়ন্ত্রিত হলেই বিপদ। আল্লাহ সবাইকে রক্ষা করুন।

*লেখক: শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব গিজেন, জার্মানি