সুইডেনে করোনা কাড়তে পারেনি বসন্তের সৌরভ
করোনাভাইরাস দমন করতে গিয়ে যখন ইউরোপ–আমেরিকাসহ পৃথিবীর বেশির ভাগ অঞ্চল যখন কার্যত অচল তখন ইউরোপের সুইডেনে জনজীবন প্রায় স্বাভাবিক গতিতেই চলছে। শীত শেষে এখানে বইছে বসন্তের বাতাস। মৃত ঘাস ফুঁড়ে পথে পথে উঁকি দিচ্ছে, ড্যাফোডিলস আর নানা রঙের টিউলিপেরা। চেরি ফুলের ওপর রোদের আলো পড়ে গোলাপি-সাদা আভা ছড়িয়ে ঝলমল করছে পুরো শহর।
বুধবার সকালে দেশটির দ্বিতীয় বড় শহর গোথেনবার্গের গার্ডেন সোসাইটিতে গিয়ে দেখা গেল শিশুদের ছোটাছুটি। নিয়মিত হাঁটাহাঁটি করতে এসেছেন কেউ কেউ। গণপরিবহনগুলোয় যাত্রীদের সংখ্যা অন্য সময়ের চেয়ে কম থাকলেও রাস্তায় কিংবা পরিবহনে কোথাও কাউকেই মুখে মাস্ক কিংবা হাতে গ্লাভস পড়তে দেখা যায়নি। সুপার শপগুলোতেও নিত্যপণ্যের কেনাকাটাও অনেকটাই স্বাভাবিক সময়ের মতো চলছে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনলাইনের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করলেও ১৬ বছরের কম বয়সী শিশুরা নিয়মিত স্কুলে গিয়ে পড়াশোনা করছে। মোটকথা সার্বিক পরিবেশ দেখলে বোঝার উপায় নেই পৃথিবী তার ইতিহাসের এক ভয়ংকর দুর্যোগকাল পার করছে। প্রশ্ন জাগতেই পারে, তবে কি সুইডেন এ মহামারিকে একেবারেই গা করছে না! এমন নয় যে সুইডেনে করোনা আক্রান্ত বা এতে মারা যাওয়ার লোকের সংখ্যা কম। বুধবার গভীর রাত পর্যন্ত দেশটিতে (সরকারি হিসেবে) মোট আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় সাত হাজার ৯২৭ জন, মৃতের সংখ্যা ৬২৩ জন, যা প্রতিবেশী স্ক্যান্ডিনেভিয়ার আরও দুই দেশ নরওয়ে ও ডেনমার্কের চাইতেও বেশি। সুইডেনে মৃতের সংখ্যাও এই দুই দেশের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি। যে কারণে করোনা মোকাবিলায় সুইডেনের কৌশলের বিষয়টি এখন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোর বুলেটিনের অন্যতম নিউজ আইটেম।
করোনা বিষয়ে বাংলাদেশে সাধারণ মানুষকে যতটা উদ্বিগ্ন হতে দেখা গেছে, এখানকার নাগরিকদের দেখা যাচ্ছে ততটাই নির্ভার। বিশ্ববিদ্যালয়ের সুইডিশ সহপাঠীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল সরকারের প্রতি এখানকার নাগরিকদের রয়েছে অগাধ বিশ্বাস ও আস্থা। তাই সাধারণ মানুষের ওপর সরকারি কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার মতো কোনো ঘটনা ঘটবার কোনো অবকাশও নেই। যে কারণে করোনা নিয়ন্ত্রণের ব্যপারেও সরকার নাগরিকদের যখন যা করার বা নয়া করার পরামর্শ দিচ্ছে সুইডিশরা তা পালন করছে অক্ষরে অক্ষরে। যেমন মার্চের শুরুতে পাঁচশ মানুষ বা তার বেশি মানুষের একসঙ্গে না হওয়ার পরমার্শ দেওয়ার পরপরই রেস্তোরাঁ, হোটেল ও বারগুলোতে ভিড় একেবারেই কমে গেছে। এতে চাকরি হারিয়েছেন এ খাতে কাজ করা প্রায় ৩৭ হাজার মানুষ। যদিও তাঁরা বিভিন্ন শর্তানুসারে সরকারের বিশেষ প্রণোদনার আওতায় নিয়মিত বেতন–ভাতা পাবেন। আর মার্চের শেষ সপ্তাহে এসে কোথাও পঞ্চাশ বা তার বেশি মানুষের সমাগমের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এসব সিদ্ধান্তের পাশাপাশি সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলা, সঠিক নিয়মে নিয়মিত হাত ধোয়ার পরামর্শগুলোও মেনে চলছেন প্রায় সবাই।
করোনা মোকাবিলায় সুইডেনের নেতৃত্বের ভার তুলে দেওয়া হয়েছে দেশটির হেলথ এজেন্সির ওপর। করোনার বিষয়ে সম্প্রতি নিয়মিত সংবাদ সম্মেলন করে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা যেমন বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কাছে পরিচিত। ঠিক তেমনি সুইডেনের প্রধান রোগতত্ত্ববিদ এন্ডারস টেগন্যাল এখন সুইডিশদের কাছে পরিচিত। বলা যায়, সুইডিশদের ভাগ্য এখন অনেকটাই নির্ভর করছে টেগন্যালের সিদ্ধান্তের ওপর আর তিনি নির্ভর করছেন দেশটিতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে করা গবেষণার তথ্য–উপাত্ত্বের ওপর।
১ এপ্রিল বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সুইডেনকে লকডাউন না করার পেছনে কিছু কারণ উল্লেখ করেছেন এন্ডারস টেগন্যাল। তিনি বলছেন, দীর্ঘ সময় ধরে যদি লকডাউন ঘোষণা করা হয়, তবে তার পরিণতি হবে আরও ভয়াবহ। উদাহরণসরূপ তিনি জানান, ‘যদি সুইডেনের স্কুলগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়, তবে এখানকার প্রায় ২৫ ভাগ মানুষ বেকার হয়ে পড়বে।’ এ কথার পেছনে তাঁর যুক্তি হলো, বেশির ভাগ মা–বাবা কর্মজীবী। ফলে কাজ ফেলে রেখে শিশুদের পেছনে সময় দেওয়ার সুযোগ তাঁদের নেই বললেই চলে। তাই অফিসের সময়টায় স্কুলের শিক্ষকেরাই শিশুদের দেখভালের দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়া সুইডেন চাচ্ছে সমস্যাটাকে একটু দীর্ঘ সময় নিয়ে মোকাবিলা করতে। যাতে একবারে অনেক মানুষ আক্রান্ত না হয়ে যদি অল্প অল্প মানুষ আক্রান্ত হয়। এতে স্বাস্থ্যসেবাব্যবস্থা ভেঙে না পড়ার ঝুঁকি কমে যাবে। লকডাউন না করার যে সিদ্ধান্ত তিনি নিয়েছেন, তা সঠিক কি না এবং নিজের সিদ্ধান্ত নিয়ে তাঁর কোনো সন্দেহ আছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে টেগন্যাল বলেন, ‘এখন পর্যন্ত কেউ বলতে পারবে না কার সিদ্ধান্ত কতটা সঠিক। তবে আমরা দেশ ও সারা পৃথিবীর পরিস্থিতির ওপর সব সময় নজর রাখছি। প্রয়োজনে যেকোনো সময় যেকোনো নতুন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে আমরা পুরোপুরি প্রস্তুত। যদি দেখি অন্য কোনো দেশে অন্য কোনো উপায় অবলম্বন করে সফল হয়েছে, তাহলে আমরাও সেটা প্রয়োগ করার চেষ্টা করব। শুধু আমি নই, ব্রিটেন, জার্মানি, ইতালিসহ প্রায় সব দেশের নীতিনির্ধারকেরাও নিজেদের সিদ্ধান্ত সঠিক কি না, তা নিশ্চিত নয়। কারণ, পৃথিবীর কোনো দেশ এর আগে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়নি। কীভাবে এর সমাধান করতে হবে, সে টোটকা জানা নেই কারোরই।’
*লেখক: শিক্ষার্থী, রাজনৈতিক যোগাযোগ, ইউনিভার্সিটি অব গোথেনবার্গ, সুইডেন