থমকে যাওয়া জীবন, মৃত্যুর আলিঙ্গনে

বোনের সঙ্গে লেখক।
বোনের সঙ্গে লেখক।

আমি কানাডার ছোট্ট যে শহরে থাকি, এর নাম সাস্কাতুন। প্রচণ্ড ঠান্ডা বলে এখানে লোকবসতি কম। এ বছর মার্চের প্রথম দিককার কথা। তখনো শীতে সবকিছুই জমে আছে। বরফ জমে রাস্তা শক্ত–পিচ্ছিল হয়ে আছে। রাস্তায় শক্ত বরফেই গাড়ি চালাতে হয় সাবধানে। বরফ গলতে গিয়েও গলে না। একটু উষ্ণতা ছড়াতেই আবার হিমশীতল ঠান্ডায় প্রকৃতির বিরামহীন রসিকতা। শহরের বাসিন্দারা প্রকৃতির এসব রহস্যময়তায় মোটামুটি অভ্যস্ত। এই গরম হলো, আবার পরদিনই ঠান্ডায় জমে যাওয়া। সেদিনও মাইনাস ১৫। প্রকৃতির এ রকম রহস্যময়তায় মন কিন্তু বেশ ক্লান্ত হয়। এ রকমই ক্লান্ত মন-শরীরে বাসায় ঢুকেই চমৎকার কুসুম গরম পানিতে গোসল সারি প্রতিদিনই। এরপর এক প্লেট ভাত খেয়ে দিই আরামের ভাতঘুম। এ সময়ের ঘুমের মতো এত আরামের ঘুম অন্য সময় কখনোই হয় না। এমনিতেই থাকি ভীষণ ক্লান্ত, এরপর আবার ভাতের শর্করা শরীরকে ভীষণই শক্তিহীন করে দেয়। তাই গভীর ঘুমে তলিয়ে যেতে সময় লাগে না। উঠি রাত আটটায়। এরপর তিন-চার ঘণ্টা পূর্ণোদ্যমে থাল-বাটি, মাজা, ঘরবাড়ি গুছিয়ে পরের দিনের রান্না আর কাজে যাওয়ার প্রস্তুতি।

আমার কাছের লোকেরা সবাই এটা জানে বলেই এ সময় ফোন করেন না। যারা আমাকে ভালোবাসেন, এই সময় একটু আরাম করে ঘুমাতে দেয় আরকি। সেদিনও তো সে রকমই হওয়ার কথা। কিন্তু ফোনটা বেসুরো সুরে বেজেই চলেছে। আমি মাত্র শুয়েছি। ধরব কি ধরব না ভাবছি। হাত বাড়িয়ে চেস্ট অব ড্রয়ার থেকে ফোনটা হাতে নিতেই দেখি, আমার ছোট বোন শীলার ফোন। সে বছর চারেক ধরে কানাডায়। আমার বাড়ির খুব কাছেই ওর বাড়ি। এরপরও শীতের সময় বলে হুটহাট দেখা হয় না। বেশির ভাগ সময়ই মেসেঞ্জারে কথা বলি। একটু ভয় নিয়েই ফোন ধরলাম, কিরে ফোন দিয়েছিস কেন?

এই শোন, করোনাভাইরাস নাকি চীন থেকে ইউরোপ হয়ে এখন কানাডায় আসছে।

আমি হাসলাম। মনে মনে চীনের হুবেই থেকে সাস্কাতুনের দূরত্ব মেপে নিলাম। চোখ বন্ধ করতেই গোল পৃথিবীটা স্পষ্ট দেখতে পেলাম।

ওকে চোখ বন্ধ করেই বললাম, আরে কোথায় হুবেই আর কোথায় সাস্কাতুন।

সত্যি বলছি। আজকে কসকোতে প্রচুর লোক। খাবারদাবার কিনছে পাগলের মতো। টয়লেট পেপার, হ্যান্ড স্যানিটাইজার—সবকিছু শেষ।
আরে কানাডিয়ান সাদারা অল্পতেই ভয় পায়। একটা আতশবাজির আওয়াজেই ঘরের ভেতর লুকায়।
না সত্যিই ভীষণ সিরিয়াস। কসকো গেলে বুঝতে পারতি। আমিও বাজার করে রাখছি।

কসকো কানাডিয়ান একটা গ্রোসারি দোকান। চোখ বন্ধ করে কসকোকেও কল্পনায় দেখলাম।

আরে না কোথায় চীন আর কোথায় কানাডা।

আরে চীনা লোক কম আছে নাকি কানাডায়?

বিরক্ত লাগছিল। আজকের আরামের ঘুমটাই মাটি হলো ভেবে। হাই তুলে বললাম, বাদ দে। ঘুমাতে দে।

শীলার ফোনটা কেটে রাগও লাগছে। একটু ঘুমাব আরাম করে। সে উপায় আর থাকল না।

কিন্তু সেদিন কেন জানি আর ঘুম হলো না। কম্পিউটারে পত্রিকা খুলে বসলাম। পত্রিকাগুলো উহানের খবর লিখেছে। ইতালি পর্যন্ত ছড়িয়েছে কোভিড–১৯। আবারও মনে হলো দূর কোথায় ইতালি আর কোথায় সাস্কাতুন। সুদূর ইতালি থেকে কীভাবেই ছড়াবে এটি। এরপরও কেন জানি পত্রিকার পর পত্রিকা খুঁজে খুঁজে করোনা নিয়েই ব্যস্ত থাকলাম।

আজ আর ঘুম এল না। রান্নাঘরে গিয়ে বসে রইলাম। এ দেশে রান্নাঘর আর ডাইনিং একসঙ্গেই থাকে। কেন জানি কাজ করতে ভালো লাগছিল না। সিংকে জমে আছে প্রচুর থালাবাটি আর হাঁড়িপাতিল। সকালে তাড়াহুড়ো করে বের হওয়ায় অনেক কিছু সিংকে জমে। সবকিছুই পড়ে থাকে। আমি ডাইনিং চেয়ারে বসে ভাবতে থাকলাম, আজ আমাকে কত কাজ শেষ করতে হবে। এরপর রান্না, ঘর ঝাড়ু, মোছা, কাপড় ধোয়া। মাঝেমধ্যে এসব কাজ একদম করতে ইচ্ছা হয় না। কিন্তু এখানে এসব করার জন্য কাউকে পাওয়া যাবে না। হয় নিজে করো, নয় ফেলে রাখো। ফেলে রাখলাম।

এজাজ বাসায় আসতেই খাবার টেবিলে প্রশ্ন করলাম, তুমি কি জানো করোনাভাইরাস সম্পর্কে?
শুনেছি একটু।
লোকজন নাকি বাজার করে সবকিছু স্টক করছে।
এই হচ্ছে বাঙালির সমস্যা। ভীষণ নিস্পৃহভাবে উত্তর দিল।

আরে বাঙালি নয়, বলছি কানাডীয়দের কথা। তারাই বাজার করে সব সয়লাব করে ফেলছে।
আরে লোকজন হুজুগে পড়ে এসব করছে। তাদের দেখে তুমি আবার ঝাঁপিয়ে পোড়ো না, বুঝলে?

এজাজের এসব পাত্তা না দেওয়ায় কথায় আমি তেমন আশ্বস্ত হলাম না। সে এমনই, কোনো কিছুই সিরিয়াসভাবে নেয় না। এ কারণে তাকে অনেক পস্তাতে হয়। মনে মনে বেশ বিরক্তি নিয়েই ঘুমাতে গেলাম।

পরদিন স্কুলে কমন রুমে এ্যানিকে বললাম, জান তো করোনার খবর।
এ্যানি বলল, জানি, এইটা পলিটিক্যাল। আমেরিকা করাচ্ছে। আমেরিকার চাল।

এ্যানি এসেছে কঙ্গো থেকে। কঙ্গোর রিফিউজি ছিল। নিজের দেশ ছাড়তে হয়েছে আমেরিকা তাদের দেশে গৃহযুদ্ধ লাগিয়ে রেখেছে বলে। তাই পৃথিবীর সব নষ্টের গোড়া মনে করে আমেরিকাকে।

ওর সঙ্গে এই আলোচনা বেশিক্ষণ চালানো গেল না। কারণ, এখন আমেরিকা যে কত খারাপ, কালোদের যে কত অত্যাচার সহ্য করতে হয়, সে বিষয়ে বিশাল এক বক্তৃতা হবে। আমার ব্রেকের সময়টুকু আমেরিকার সমালোচনা শুনতে ভালো লাগছিল না।

আরেক সহকর্মী সীনাকে বললাম, তোমার করোনা নিয়ে কী ভাবনা? ইউটিউব থেকে ভিডিও বের করল। সেখানে বলা হচ্ছে, কোভিডে ভয়ের কিছু নেই। মানুষ অযথাই শঙ্কা তৈরি করছে, সবার উচিত হাত ধোয়া, ইত্যাদি ইত্যাদি। এখানেও আমার পছন্দমতো উত্তর না পেয়ে মনে মনে একটু হতাশই হলাম।

কোভিড তাহলে তেমন ভয়ংকর কিছু নয়। চীনাদের মতো আমরা মারা যাব না। একটু যেন নিশ্চিন্তই হলাম। বাচ্চাদের সঙ্গে কাজ করতে করতে ভুলে গেলাম করোনা নামের হাজারো শিং ওয়ালা ভাইরাসটিকে। নানা রকমের বাহারি রহস্যময় রংওয়ালা কোভিড নাইন্টিনকে তখনো বুঝে উঠে পারিনি। এ যেন শুধু সংবাদের পাতায়, আর টেলিভিশনের পর্দায়, কিংবা আলোচনার টেবিলেই নতুন বিষয় হয়েই বেশ গুরুত্ব নিয়ে বিরাজ করতে থাকল মানুষের মধ্যে। আমাদের মতো সাধারণ মানুষের ভবিষ্যৎ কী হবে, সেটি বোঝার ক্ষমতা তো এর বেশি এগোতে পারে না। কারণ, আমরা সাধারণ মানুষ।