করোনা প্রতিরোধ সবকিছু ঠিক রেখেই

ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

হাইওয়ে সড়ক ঘেঁষে আমার বাসা। প্রতিদিন ভোরে ঘুম ভাঙে রাস্তায় চলতে থাকা গাড়ির শোঁ শোঁ শব্দে। সাপ্তাহিক ছুটির দিন শনি-রোববার ছাড়া এমন শব্দ আমার প্রতিদিনের নিত্যসঙ্গী। যেখানে গোটা পৃথিবী আজ নিস্তব্ধ। আকাশপথ–সড়কপথসহ সব পথের মানুষ যেখানে ঘরে বন্দী, সেখানে কর্মব্যস্ত কোরিয়ার মতো দেশ চলছে তার আপন গতিতে। ভোর হলেই কোরিয়ানরা ছুটে চলে তাদের কর্মস্থলে। একদিকে চলছে করোনার আতঙ্ক, অন্যদিকে চলছে তাদের কোরিয়ার অর্থনৈতিক চাকা।

আন্তর্জাতিক যাত্রীদের দেশে প্রবেশ উন্মুক্ত। ছিল না রাস্তায় চলাচলে জনসাধারণের ওপর কড়া নিষেধাজ্ঞা, বন্ধ হয়নি গণপরিবহন, সারা দেশে কোনো ধরনের লকডাউন ছাড়াই করোনাভাইরাস প্রতিরোধে অবিশ্বাস্য রূপ দেখিয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া। এমন কথা শুনলেই সত্যিই চমকে ওঠার মতো! যেখানে লকডাউন করেও যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, স্পেন, চীন, জার্মানি, ফ্রান্স, ইরান, যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ড ও তুরস্কের মতো দেশ করোনা প্রতিরোধে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে, সেখানে দক্ষিণ কোরিয়া হঠাৎ আমূল পরির্বতন। করোনা মোকাবিলায় তাদের সাফল্য প্রশংসা কুড়িয়েছে সারা বিশ্বেই। ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে হু হু করে বাড়তে থাকা ভাইরাসটি হঠাৎ কীভাবে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছিল এ দেশটি? কী করে প্রাণঘাতী এই ভাইরাসের মোকাবিলা করেছে দেশটির জনগণ? দক্ষিণ কোরিয়ার করোনা সাফল্যের নেপথ্যে কী ছিল?

চীনের প্রতিবেশী হয়েও দেশটিতে কোভিড–১৯ আক্রান্তে মৃত্যুহার ১ শতাংশের নিচে। উল্লেখযোগ্য হারে কমছে সংক্রমণও। গত বুধবার (৮ এপ্রিল) দেশটিতে নতুন করে আক্রান্ত হয় ৫৩ জন। ২০ জানুয়ারি প্রথম কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয় দক্ষিণ কোরিয়ায়। ৪ মার্চ সর্বোচ্চ ৮৫১ জন আক্রান্ত হয় দেশটিতে। তখন চীনের পরই করোনার বড় কেন্দ্র ছিল দক্ষিণ কোরিয়া। তবে কার্যকর ব্যবস্থা আর কঠোর পদক্ষেপের পরই কমতে শুরু করে সংক্রমণের হার। ৯ এপ্রিল সেই দেশটিতে নতুন রোগীর শনাক্তের সংখ্যা ৩৯ জন। অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় মৃত্যুহারও দক্ষিণ কোরিয়ায় অনেক কম। দ্রুতই সংক্রমণের লাগাম টেনে ধরেছে এ দেশটি।

এ দেশের দ্রুত চিকিৎসাসেবায় চিকিৎসকদের প্রচেষ্টা, প্রযুক্তি আর জনসচেতনতায় করোনা প্রতিরোধের দক্ষিণ কোরিয়ার এমন সফলতা দেখেছে বলে মত বিশেষজ্ঞদের।

করোনা এমন একটি ভাইরাস, সংক্রমিত মানুষটিকে ফেলে সবাই পালাচ্ছেন, তখন একমাত্র চিকিৎসকেরাই ছুটে যাচ্ছেন তাদের কাছে। ঝুঁকি নিয়ে, নিজের জীবন বাজি রেখে ছুটে চলছেন এক রোগী থেকে অন্য রোগীর কাছে। এই সেবা দিতে গিয়ে কোরিয়ায় একজন চিকিৎসকের মৃত্যুও হয়েছে। পরিবার ছেড়ে দেশ এবং দেশের মানুষদের জন্য আত্মনিয়োগ করেছেন এ দেশের চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা। দেশ রক্ষার স্বার্থে, দেশের মানুষদের জীবনের নিরাপত্তা দিতে গিয়ে দিন-রাত নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন তাঁরা।

বিশ্লেষকেরা জানিয়েছেন, বিশ্বের যেকোনো দেশের তুলনায় দক্ষিণ কোরিয়ায় করোনা পরীক্ষার হার সবচেয়ে বেশি। দক্ষিণ কোরিয়ায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বসানো হয়েছে ভ্রাম্যমাণ ল্যাবরেটরি বুথ। যে বুথ থেকে প্রতিদিন ২০ হাজার মানুষকে করোনা সংক্রমণের পরীক্ষা করা হচ্ছে।

দক্ষিণ কোরিয়া রোগ নিয়ন্ত্রণ ও সুরক্ষা কেন্দ্র (কেসিডিসি) তথ্যমতে, দক্ষিণ কোরিয়ায় মোট করোনা আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৪৫০। তাদের মধ্যে মারা গেছে ২০৮ জন (৯ এপ্রিল পর্যন্ত)। আর সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছেড়েছে ৭ হাজার ১১৭ জন। এখানে কোরোনা আক্রান্তের সুস্থতার সমীকরণে বলে দেয় চিকিৎসক ও স্বাস্থকর্মীর সেবা সত্যিই প্রসংশনীয়।

করোনাভাইরাস যুদ্ধ জয়ে জাতির ক্রান্তিলগ্নে নিম্ন আয়ের মানুষকে খাদ্য, চিকিৎসাসামগ্রীসহ সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য নিরাপত্তা পিপিই ও স্যানিটেশন সামগ্রী বিতরণ এগিয়ে এসেছে দেশের বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান।

বাংলাদেশেও সেবা দিতে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছেন অনেক চিকিৎসক। এর আগেও এমন হয়েছে—ভবিষ্যতেও হয়তো হবে। অথচ কখনোই মানুষের নিরাপত্তা রক্ষায় সৈনিক হিসেবে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের ভূমিকা কখনোই সেভাবে আলোচিত হয় না।

কোভিড-১৯ প্রতিরোধ করার জন্য বিশ্বের অনেক দেশে সচেতনতার পাশাপাশি বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা বলছেন, ছোঁয়াচে এই ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বাঁচার এখন পর্যন্ত একমাত্র উপায় হোম বা সেলফ কোয়ারেন্টিন।

দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রথম কয়েকজন সংক্রমিত হলেও তেমন একটা গুরুত্ব লক্ষ করা যায়নি এ দেশের সরকার ও জনগণের মাঝে। যখনই সংক্রমণ বাড়তে থাকে, তখনই ভাইরাস প্রতিরোধে জনসাধারণকে সচেতন করতে প্রচারের কোনো কমতি ছিল না। বাস কিংবা মেট্রো—সব যানবাহনে কিছুক্ষণ পরপর কোরিয়ান ও ইংরেজিতে বেজে উঠত করোনা প্রতিরোধে সাবধানতা। এমনকি রাস্তাঘাটে বড় বড় বিলবোর্ড কিংবা প্ল্যাকার্ডে প্রচারের কমতি ছিল না। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি দেগু সিটির শিনশিওঞ্জি চার্চের হাজারো মানুষের জনসমাগমে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ার প্রমাণ পাওয়া গেল, মানুষ তখন অক্ষরে অক্ষরে সরকারের নির্দেশনা ফলো করতে লাগল। যেকোনো জনসমাবেশ নিষিদ্ধ করা হলো। ধর্মালয়গুলো বন্ধ রাখার অনুরোধ করা হলো। খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া মানুষকে বাড়ির বাইরে আসতে নিরুৎসাহিত করা হলো।

সর্বাধুনিক টেলিপ্রযুক্তির সাহায্যে সম্ভাব্য রোগীদের ট্রেকিং করে ভাইরাস টেস্টের আওতায় নিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে, যারা ভাইরাসে পজিটিভ হয়েছে, তাদের মুভমেন্ট জনসাধারণকে জানিয়ে দেওয়া হচ্ছিল কোরিয়া সরকারের পক্ষ থেকে, যেন মানুষ সচেতন হতে পারে। কড়া নিয়ম মানা হয় কোয়ারেন্টিন আর আইসোলেশনেও। এমনকি সিসিটিভি ফুটেজ দেখেও খুঁজে বের করা হয় আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে কারা এসেছিল। বিমানবন্দর বন্ধ না করলেও স্ক্রিনিং ও কোয়ারেন্টিন বাধ্যতামূলক করা হয় যাত্রীদের জন্য। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ সাফল্য থেকে শিক্ষা নিতে পারে পশ্চিমারাও।


তবে সচেতনতা কেউ কাউকে তৈরি করতে পারে না, যতক্ষণ না সে নিজের এবং দেশের ভালো–মন্দ না বুঝবে। চীন থেকে যখন কয়েকটি দেশে এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ভয়াবহ আকার ধারণ করছে, তখনো আমার দেশের অনেকে এমন মন্তব্যও করেছেন যে ‘এ রোগ চায়নার সৃষ্টি, বেশি দিন টিকবে না’। করোনা নিয়ে এমন ঠাট্টা আর গান তৈরিতে ব্যস্ত ছিল কিছু মানুষ। খুব অল্প সময়ের বদলে গেছে পৃথিবীর দৃশ্যপট। লাখো মানুষকে মৃত্যুর মিছিলে যোগ করছে করোনাভাইরাস। বিশ্বে মহামারি আকার ধারণ করার পরও আমাদের সচেতনতা কোথায় যেন অচেতন হয়ে আছে! সরকার লকডাউন করেও ঘরে রাখতে পারছে না মানুষকে। এখনো সময় আছে সচেতন হওয়ার, এখনো সময় আছে দেশ বাঁচানোর, দেশের মানুষদের বাঁচানোর। এটা অত্যন্ত ছোঁয়াচে। অতএব সচেতনতাই কেবল পারে আমাদের করোনা থেকে রক্ষা করতে।