করোনা: টেনশনের ১৪ দিন

সপরিবার সৌদি আরব পৌঁছায় ১ ফেব্রুয়ারি, এর আগেই করোনা নিয়ে আলোচনা চলছে সারা বিশ্বে। তবে চীন বাদে অন্য কোনো দেশে এই ভাইরাস তখনো প্রকাশ পায়নি। মার্চ মাসের শুরুর দিকে সৌদি আরবে করোনা রোগী শনাক্ত হয়, তবে তেমন একটা গুরুত্ব দিচ্ছে না কেউ, আমিও তেমন একটা গুরুত্ব দিইনি শুরুর দিকে।

এই এর মধ্যে ১৩ মার্চ বাজার করলাম খালি হাতে, মুখেও মাস্ক ব্যবহার করিনি। ১৭ মার্চ দুপুরে হঠাৎ আমার বড় ছেলে জাওয়াদ বায়না ধরল বাইরে ঘুরতে যাবে। ওকে এমনি প্রতিদিন বিকেলে বাড়ির পাশের পার্কে নিয়ে যেতাম, কিন্তু করোনাভাইরাস বিষয়টা ব্যাপকভাবে আলোচনা হওয়ার পর পার্কে যাওয়া বন্ধ করে দিই। তো যখন সে বায়না ধরল বাইরে ঘুরতে যাওয়ার জন্য, সঙ্গে তার মাও যোগ হলো, ‘বহুদিন বাইরে যাওয়া হয় না, আজকে যায়, তবে কেউ গাড়ি থেকে নামব না, শুধু গাড়ি নিয়ে ঘোরাঘুরি করব’ এই হলো যুক্তি। আমিও চিন্তা করে দেখলাম, গাড়ি থেকে না নামলে তো সমস্যা নেই, যাওয়া যেতেই পারে। তখনো কারফিউ জারি হয়নি।

সন্ধ্যা সাতটার দিকে বের হয়ে আমরা মদিনার রোড ধরলাম, প্রায় ঘণ্টাখানেক গাড়ি চালানোর পর জাওয়াদ বলল, কেএফসির চিকেন খাবে। আরও কিছুক্ষণ গাড়ি চালানোর পর তাজেজ নামক রেস্তোরাঁর সামনে গাড়ি দাঁড় করালাম। হোটেলে না ঢুকেই বয় ডেকে অর্ডার দিলাম, সবাই চিকেন এবং বার্গার খেতে খেতে আরও ৩০ মিনিটের মতো গাড়ি চালিয়ে বাসায় ফিরে আসার জন্য রওনা দিলাম। ফিরতি পথে ১০ থেকে ১৫ মিনিট গাড়ি চালানোর পর দেখলাম গাড়িতে তেল প্রায় শেষের দিকে, তাই একটা পেট্রলপাম্পে তেল নেওয়ার জন্য ঢুকলাম। তেল নেওয়ার পর প্রস্রাবের চাপ আসায় পেট্রলপাম্পের পাবলিক টয়লেট ব্যবহার করলাম (মোটামুটি নোংরা), গাড়িতে এসে স্যানিটাইজার হাতে মাখলাম। ভালোমতো বাসায় চলে এলাম রাত আনুমানিক সাড়ে ১০টার দিকে।

২০ মার্চ শুক্রবার জুমার নামাজের একটু আগে হঠাৎ শরীরটা একটা মৃদু দোলা দিল (খারাপ লাগছিল) এবং প্রচণ্ড রকমের দুর্বলতা অনুভব করলাম, জ্বর জ্বর ভাব, তবে সর্দি–কাশি কিছুই নেই। পেনাডল (প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ) খেলাম, কিন্তু শরীরের অবস্থার কোনো পরিবর্তন নেই। জাওয়াদেরও কাশি শুরু হলো। জাওয়াদের আম্মুর মাথাব্যথা। সব মিলে প্রচুর টেনশনে পড়ে গেলাম। বারবার পাবলিক টয়লেট ব্যবহারের কথা মনে পড়ছিল, কেন ব্যবহার করলাম? এই দুঃখ মনে। মদিনা রোডের পেট্রলপাম্পগুলো সাধারণত বিভিন্ন দেশে থেকে আগত ওমরাহ ও হজযাত্রীরা ব্যবহার করেন। তাই মনে মনে ধরে নিলাম যে হয়োতবা করোনা আক্রান্ত কেউ এই টয়লেট ব্যবহার করছে এবং এই টয়লেট ব্যবহার করার কারণে আমরাও হয়তো সংক্রমিত হয়ে গেলাম। একপ্রকার ধরেই নিলাম যে আমরা করোনা রোগী হওয়ার পথে, আল্লাহ হেফাজত করুন সবাইকে।

দুই দিন শরীরের অবস্থার পরিবর্তন না হওয়ায় হেল্পলাইনে কল দিয়ে বিস্তারিত বললাম। তারা বলল, টেনশনের কোনো কারণ নেই। বাসায় থাকেন, জ্বর ও শ্বাসকষ্ট হলে যেন তাদের আবার ফোন করি। সন্দেহ দূর করার জন্য এরই মধ্যে আমি দু–তিনটা প্রাইভেট হসপিটালে ফোন করে করোনা টেস্ট করে কি না জিজ্ঞেস করলাম। সবার একই কথা, এই টেস্ট করবে শুধু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।

যা–ই হোক, শরীরের অবস্থার পরিবর্তন যখন হচ্ছে না, তখন একটা প্রাইভেট হসপিটালে কল দিয়ে চিকিৎসক পাঠাতে বললাম। বিস্তারিত শোনার পর দুজন চিকিসৎক ও একজন নার্স পাঠালেন। একজন জেনারেল চিকিৎসক, আরেকজন শিশু বিশেষজ্ঞ। তাঁরা এসে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করে অভয় দিয়ে বললেন, ‘শতভাগ নিশ্চিত যে আপনারা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হননি। তবে কোনো একটা ভাইরাল ইনফেকশন হতে পারে।’ আমার আর জাওয়াদের জন্য ওষুধ দিলেন, অ্যান্টিবায়োটিক–সহ। খাওয়ার পর প্রায় সাত দিন বাদে আমাদের অবস্থা স্বাভাবিক হলো, আলহামদুলিল্লাহ।

১ এপ্রিল আমাদের কোয়ারেন্টিনের ১৪ দিন পূর্ণ হলো। অবশ্য মাঝখানে দুবার ৩০ মিনিটের জন্য বের হয়েছিলাম খুব সতর্কতার সঙ্গে, কোয়ারেন্টিনের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর বাজার করতে গেলাম মুখে ডাবল মাস্ক, হাতে তিনটা গ্লাভস লাগিয়ে। কিন্তু সুপারশপে গিয়ে দেখি অনেকেই হাতে গ্লাভস ও মুখে মাস্ক ছাড়াই দিব্যি কাজ করছে ও বাজারসদাই কিনছে। অবাক হলাম।

যে কথা বলতে চাচ্ছি, কোনো কারণে যদি সন্দেহ লাগে যে আপনি আক্রান্ত হয়েছেন বা হওয়ার পথে, তাহলে সর্বপ্রথম আপনার যে বিষয়টা করা প্রয়োজন সেটা হচ্ছে, মানসিকভাবে শক্ত থাকা, আমরা অনেকে একটু জ্বর–সর্দি হলেই মনে করি যে আমার মনে হয় করোনা হলো। অসুখ হবে মনে হয়, হলো মনে হয়, আমি মনে হয় আক্রান্ত—এই রকম চিন্তা মানুষকে শেষ করে দেয়।

আবার আমার হবে না, আমাকে ধরবে না, এমন চিন্তা নিয়ে যত্রতত্র ঘোরাফেরা করাটাও ঝুঁকিপূর্ণ। এই মুহূর্তে ছোট থেকে ছোট ঝুঁকিপূর্ণ চলাচল পরিত্যাগ করা উচিত। তাই আসুন, নিজের এবং পরিবারের প্রতি যত্ন নিই, ঝুঁকিপূর্ণ চলাচল পরিত্যাগ করি।

*লেখক: পিএইচডি গবেষক, কিং আবদুল আজিজ ইউনিভার্সিটি, জেদ্দাহ, সৌদি আরব। [email protected]