ভুয়া জন্মদিনের বিড়ম্বনা

মাহবুব মানিক। ছবি: সংগৃহীত
মাহবুব মানিক। ছবি: সংগৃহীত

নবম শ্রেণিতে নাম নিবন্ধন চলছে। সবাই গণহারে ফরম পূরণ করছে। কমন কিছু তথ্য একটা ফরমে লিখে দিলে বোর্ড থেকে কম্পিউটারাইজড নিবন্ধন কার্ড পাঠিয়ে দেবে। শ্রেণিশিক্ষক দেখলাম বেশ বুদ্ধি করে নিজেই আমার জন্মতারিখ বসিয়ে দিয়েছেন। ফরমে লেখা ১৫ আগস্ট হচ্ছে আমার ডেট অব বার্থ। স্কুলজীবনে প্রত্যেক শিক্ষকই আমাদের চোখে এক-একজন মোটামুটি লেভেলের বাঘ-ভাল্লুক। তাই তাঁদের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে পাঙ্গা নেওয়া অনেকটা ৩০২ ধারা টাইপের অপরাধ। তবু ভুয়া জন্মতারিখটা ঠেকাতে একরকম আঁতিপাঁতি করেই বললাম।

স্যার, আমার বার্থ ডে তো ১০ অক্টোবর।
স্যার তাঁর হাতের গতিশীল কলমে ব্রেক কষে চোখ পাকিয়েই তাকালেন। ঘাবড়ে গিয়ে ব্যাপারটা সামাল দিতে আরও একটু কাইকুই করে বললাম।
স্যার! তাইলে আর কষ্ট করে অক্টোবরের দিকে যেতে হবে না। প্রাইমারির স্যার ১০ আগস্ট করে দিয়েছিলেন। সো, আপনি দয়া করে সেটাই করে দ্যান। অন্তত জিনিসটা এক জায়গাতেই থাক।

স্যার কেন জানি বেশ দয়াপরবশ হয়ে উঠলেন। পাক্কা পাঁচ দিন কমিয়ে ১০ আগস্ট ফিক্সড করে দিলেন। এদিকে প্রাইমারি ক্লাস টিচার বৃত্তি পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশন ফরম পূরণ করার সময় তার মর্জি মোতাবেক ডেট অব বার্থ ১০ আগস্ট বসিয়ে দিয়েছিলেন। ত্বরিত চিন্তায় তাঁর মাথায় হয়তো আগস্টের ১০ তারিখ এসেছিল। অন্য কারও ক্ষেত্রে হয়তো অন্য কোনো তারিখ তাঁর মাথায় এসেছিল। সে সময় প্রাইমারির ক্লাসটিচারকে বাঘ-ভাল্লুক বললে কম বলা হবে। পুরোই ডাইনোসর! তাই তাঁর ওই জন্মতারিখজনিত সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটাও করতে পারিনি।

ভুয়া এই জন্মতারিখটা প্রাইমারি ও সেকেন্ডারিতে একরকম হওয়ায় একটা বড় রকমের সুবিধা হয়েছিল। এসএসসি পরীক্ষার আগে আমাকে দ্বিতীয় কোনো তারিখে জন্ম নেওয়ার মতো লজ্জায় পড়তে হয়নি। নয়তো আমার তিনটা জন্মতারিখ হয়ে যেতে পারত। সুতরাং এই শিক্ষক মহোদয় আমাকে তিন-তিনবার জন্ম নেওয়ার হাত থেকে রক্ষা করেছেন। আমি কৃতজ্ঞ।

আমার ব্যক্তিগত পরিসংখ্যান বলছে যে সবার এই দুই-তিনটা জন্মদিন থাকার জন্য পুরো ৫০ ভাগ দায়ী এই প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি স্কুলের শিক্ষকেরা। আর বাকি ৫০ ভাগ দায়ী মা-বাবা। শিক্ষকেরা যখন অতি উৎসাহী হয়ে মর্জি মোতাবেক জন্মতারিখ নির্ধারণ করে দেন, তখন মা-বাবারা এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করেন না। অথবা সন্তানের সঠিক জন্মতারিখ নিবন্ধনের ব্যাপারে তাঁরা মোটেই কেয়ারিং নন। এখানে অন্য একটা সাইকোলজি কাজ করে। কারণ, শিক্ষক বা মা-বাবার নিজেদের জন্মতারিখই ভুয়া। তাই সন্তানদের ক্ষেত্রেও সঠিক তারিখটি একাডেমিক কাজে রেজিস্ট্রি করা তাঁদের কাছে একেবারেই গুরুত্বহীন।

সেই থেকেই ভুয়া এই জন্মতারিখটা জীবনের সঙ্গে থাপ্পা মেরে দিয়েছি। আমার মতো যারা আশি ও নব্বইয়ের দশকে জন্ম নিয়েছে, সবারই মোটামুটি দুই-তিনটা করে জন্মতারিখ। আশি দশকের আগে যারা জন্ম নিয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে এই জন্মগত ত্রুটিগুলো অনেকটা মন্দের ভালো। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কেউ সঠিক তারিখটা জানে না। বাপ-দাদার হাত ধরে ভুয়া জন্মতারিখটা সার্টিফায়েড করে নিয়েছে। অনেকের অবস্থা আরও করুণ। তাদের জন্মতারিখ জিজ্ঞেস করলে তারা অনেকটা বিমোহিত ও আবেগপ্রবণ হয়ে উত্তর দেন।

সেই যে গেল বছর বন্যা গেল, তারপরে যেই বছরে চরম খরা পড়ল না? তারই মাস তিনেক আগে! সেই দিন খুব বৃষ্টি হইছিল!
অনেক ক্ষেত্রেই ভুয়া জন্মতারিখটা কবে দেব, এই জিনিসটা ভাবার অবকাশ ও অনেকের মধ্যে থাকে না! তাই বেশি ভাগ ক্ষেত্রে ১ জানুয়ারিই অনেকের ভরসা। এই একটি কারণেই বছরের প্রথম দিনে ফেসবুকে বন্ধুতালিকায় জন্মদিনের সুনামি বয়ে যায়। আসলে ভুয়া জন্মতারিখে কেউ উইশ করলে সেই উইশে জন্ম নেওয়ার সুন্দর মুহূর্তটা অনুভূত হয় না। বরং ছোটবেলার ক্ষমার অযোগ্য ভুলের জন্য আফসোস বাড়তে থাকে। অন্যদিকে চেপে যাওয়া আসল জন্মতারিখটা সব সময়ই অনুভূতি প্রবণ ও সংবেদনশীল। দেশে থাকা পর্যন্ত ভুয়া জন্মতারিখঘটিত বিষয় নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়নি। আমাদের সমসাময়িক সময়ে প্রায় সবারই জন্মের সময় ঠিক নেই। আই মিন জন্মতারিখের ঠিক নেই। যত বিড়ম্বনা সব জার্মানিতে এসে পোহাতে হয়েছে। এখানে জন্মতারিখে ঘটা করে উইশ করা একটা বুরোক্রেটিক ও সিস্টেমেটিক ব্যাপার। এটা যেমন বিরাট আনন্দের ব্যাপার, আবার কারও দুইটা জন্মতারিখ আছে, সেটাও অস্বাভাবিক ও অবাস্তব ব্যাপার। প্রতিবছরেই ভুয়া জন্মদিনে বিভিন্ন রকমের অফিশিয়াল উইশ পেয়ে থাকি। দিনটিতে ব্যাংক, বিমা, ভার্সিটি, অফিস, শপিং মেম্বারশিপ, অনলাইন মানি ট্রান্সফার অ্যাকাউন্ট থেকে নানা রকমের উইশ ও ডিসকাউন্ট ভাউচার পেয়ে আসছি।

জবে জয়েন করার পর ফার্স্ট টাইম যখন ভুয়া জন্মদিনে এক জার্মান কলিগ উইশ করল, তখন আমতা-আমতা করে তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম।
দেখো, এইটা আসলে আমার আসল জন্মতারিখ নয়।
বেচারার তখন চেয়ার থেকে পড়ার মতো অবস্থা।
ভুয়া জন্মতারিখ আবার হয় নাকি?

দেখলাম যে বড়ই লজ্জার ব্যাপার! দুইটা জন্মতারিখের ব্যাপার একটা নিতান্তই দুর্ঘটনা এবং ব্যক্তিগত সমস্যাজনিত কারণ দেখিয়ে তাঁকে শান্ত করার চেষ্টা করলাম। তবে সেই বেচারা আমাকে লজ্জার হাত থেকে বাঁচিয়ে ইস্তফা দিয়ে চাকরি ছেড়ে চলে গেছে। এরপর তাঁর সঙ্গে আর দেখা-সাক্ষাৎজনিত বিড়ম্বনায় পড়তে হয়নি। সেই যে আসল জন্মতারিখের ব্যাপারটা অফিশিয়ালি চেপে গিয়েছি। ভুয়া জন্মতারিখটাই অফিসে সিরিয়াস রকমের আসল হয়ে গেছে। প্রতিবছর সহকর্মীরা ভুয়া জন্মদিনে এত ঘটা করে উইশ করে আর উপহার দেয় যে মুখ হাসি হাসি করে সব সাদরে গ্রহণ করলেও মনে মনে লজ্জায় পড়ে যেতে হয়।

বউয়ের সঙ্গে একবার পর্তুগালে বেড়াতে গেলাম। কাকতালীয়ভাবে ভুয়া জন্মতারিখটা হাঁটাহাঁটি করে হোটেলে থাকতেই চলে এল। সেদিন হ্যাংআউট করে হোটেল রুমে ফিরে এসেই থ হয়ে গেলাম। একটা ট্র্যাডিশনাল ওয়াইনের বোতল বরফের বাকেটে চোবানো। পাশেই একটা সুন্দর বার্থ ডে উইশিং কার্ড৷ আমার জন্মদিনের উপহার সাদরে গ্রহণ করলাম ঠিকই, যদিও ভুয়া ভুয়া একটা খটকা রয়েই গেল। আসল জন্মতারিখটা এখন ফ্রেন্ডস অ্যান্ড ফ্যামিলি কেন্দ্রিক হয়ে গেছে৷ তা-ও খুব গোপনীয়তায়। বিড়ম্বনা এড়াতে সোশ্যাল মিডিয়াতেও মোটামুটি গোপন করে দিয়েছি। পাছে অফিসের কেউ জেনে গেলে না আবার লজ্জায় পড়তে হয়।

*মাহবুব মানিক: গবেষক, মার্সেবুর্গ ইউনিভার্সিটি অব অ্যাপ্লাইড সায়েন্স, হালে, জার্মানি