সূর্যে বাধি বাসা

ইস্টারের লং উইকএন্ড চলছে। গুড ফ্রাইডে থেকে একেবারে সোমবার পর্যন্ত মোট চার দিনের ছুটি। অন্যান্যবার এই ছুটিতে আমরা কাছাকাছি কোথাও না কোথাও বেড়াতে যাই। অবশ্য বেশির ভাগ অস্ট্রেলিয়ান বাসার বাইরে চলে যায় এমন ছুটি কাটাতে। তারপর ছুটির সময়টা পরিবারের সঙ্গে কোথাও কাটিয়ে এসে আবার কাজে যোগ দেয়। আমাদের বাইরে যাওয়া হয় না কারণ দেখা যায় আমার কাজ না থাকলেও গিন্নির হাসপাতালে ডিউটি থাকে। আমরা তাই বাসার আশেপাশেই ঘুরি। অন্যান্য সময় ছেলেমেয়ে দুটোকে তেমন একটা সময় দেওয়া হয় না। তাই এই ছুটি সেই ক্ষতটা কিছুটা পুষিয়ে নিতে সাহায্য করে। আর আমাদের ছেলে রায়ান বাসার বাইরে বনে–জঙ্গলে ঘোরাঘুরি বেশি পছন্দ করে।

এই ছুটি সামনে রেখে অফিসে আলাপ হয় কে কোথায় যাচ্ছে। ছুটি থেকে ফিরে আলাপ হয় কার কেমন কাটল কিন্তু এবার সেসবের কিছুই হলো না। সবার মধ্যেই কেমন জানি একটা চাপা আতঙ্ক কাজ করছে। সবাই অফিস করছে কিন্তু তবু কেন জানি সবাই একধরনের ভয় নিয়ে চলাফেরা করছে যদিও সামাজিক দূরত্ব এবং হাইজিন সঠিকভাবে মেনে চলার ফলে ইতিমধ্যেই নিউ সাউথ ওয়েলসের করোনা সংক্রমণের মাত্রা অনেকখানিই কমে এসেছে।

যা–ই হোক, করোনার এই মহামারিতেও আমাদের পরিবারে তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি। যদিও এক–একটা দিন শুরু হয় অজানা আশঙ্কায়। আমি সেই সাতসকালবেলায় উঠে তৈরি হয়ে অফিসের উদ্দেশে রওনা দিই। ইদানীং উঠে তৈরি হতে হতেই ছেলে রায়ান টের পেয়ে যায়। তারপর আমাকে জড়িয়ে ধরে ভয়ংকর কান্না শুরু করে দেয়। সে আমার সঙ্গে যাবে। তাকে ছাড়িয়ে কোনোমতে দরজা খুলে বের হয়েই তাড়াতাড়ি দরজা আটকে দিই। তারপর স্টেশন পর্যন্ত একটা মিনি ড্রাইভ। আগে এই সময়টায় অন্ধকার থাকত চারপাশে। এখন আর অন্ধকার থাকে না। কারণ, সম্প্রতি ডে লাইট সেভিংস বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তাই আর এখন অন্ধকার থাকে না। স্টেশনের কার পার্কে গাড়ি রেখে যখন প্ল্যাটফর্মের দিকে হেঁটে যাই, তখন পূর্ব আকাশ আলোকিত হতে শুরু করে। এরপর প্ল্যাটফর্মে কিছু সময়ের জন্য অপেক্ষা। স্টেশনের কার পার্ক আগে পুরোপুরি ভরে উঠত গাড়ি দিয়ে। আর এখন সারা দিনই সেটা প্রায় ফাঁকা পড়ে থাকে। প্ল্যাটফর্মেও আগে যেখানে মানুষ গিজগিজ করত, এখন সেখানে একেবারে হাতে গোনা আমরা কয়েকজন অপেক্ষা করি। আগে যেখানে ট্রেনে উঠে সিট খুঁজে নিয়ে বসতে হতো, এখন সেখানে কোন সিটে গিয়ে বসব, সেটা নিয়েই বিভ্রান্তিতে পড়ে যাই। সিটে বসে যাওয়া শুরু করার পর সূর্য মামা উষার আগল ভেঙে পূর্ব আকাশে উদিত হয়ে যায়। ট্রেনের জানালার কাচ ভেদ করে সেই নরম আলো মুখে এসে পড়ে। তখন মনে হয়, দুনিয়ায় বেঁচে থাকাটা খুব একটা খারাপ ব্যাপার না।

গিন্নি সকালে ঘুম থেকে উঠে বাচ্চাদের তৈরি করে তারপর নিজে তৈরি হয়ে হাসপাতালে যায়। অবশ্য যাওয়ার পথে বাচ্চা দুটোকে দুই জায়গায় নামিয়ে দিতে হয়। ওরা সেখান থেকে স্কুলে যায়। গিন্নি কাজ থেকে ফেরার সময় আবার তাদের তুলে নিয়ে আসে। আমি আগে এই কাজগুলো করতাম কারণ গিন্নির ডিউটি থাকত রোস্টার অনুযায়ী দিনের বিভিন্ন সময়ে। তবে ইদানীং আটটা–পাঁচটা নিয়মিত ডিউটি হওয়ায় সে–ই বাচ্চাদের নামানো–ওঠানোর কাজটা করছে। সামনে আবার রোস্টার বদলে গেলে আমাকে ফিরতে হবে আগের দায়িত্বে। করোনার প্রকোপ শুরু হওয়ার পর অবশ্য গিন্নির খাটুনি আরও বেড়ে গেছে। কারণ, সে আগে বাসায় ফিরে এসে গোসল দেয়, তারপর বাচ্চাদের তুলতে যায়, কারণ তাকে প্রায় দিনই করোনার রোগীদের সংস্পর্শে আসতে হয়। গত সপ্তাহের শুক্রবারে গিন্নিকে এবং তার রেজিস্ট্রারকে করোনার টেস্টের জন্য রক্ত জমা দিতে হয়েছিল। কারণ তার রেজিস্ট্রারের জ্বরের দেখা দিয়েছিল। এই টেস্টের রিপোর্ট পেতে ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টা লাগে। রিপোর্টে যদি করোনার জীবাণু ধরা পড়ে, তাহলে তাঁকে কল দেওয়া হবে আর না হলে খুদে বার্তা দিয়ে জানিয়ে দেওয়া হবে। শনিবার পর্যন্ত হাসপাতাল থেকে কোনো কল বা খুদে বার্তা এল না। আমরা মোটামুটি একধরনের ভয় নিয়ে দিনটা পার করলাম। রোববার বাসার কাজ নিয়ে অনেক ব্যস্ত হয়ে গেলাম আমরা। কারণ, সামনের সপ্তাহের জন্য বাজার রান্না সব করতে হবে। অবশেষে দিনের শেষ বেলায় যখন তার কাছে রিপোর্টের কথা জানতে চাইলাম, সে বলল, খুদে বার্তা দিয়েছিল কিন্তু ব্যস্ততার কারণে আমাদের জানাতে ভুলে গেছে। তখন আবারও নতুন করে উপলব্ধি করলাম, আসলেই বেঁচে থাকাটা অনেক বেশি আনন্দের।

গুড ফ্রাইডে থেকে আমার ছুটি শুরু হলো। আমি গিন্নিকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার ডিউটির কী অবস্থা। প্রশ্ন শুনে সে কেমন জানি রহস্যের হাসি দিল, যার অর্থ হ্যাঁ বা না যেকোনোটাই হতে পারে। আমার প্রশ্ন করার কারণ সব ছুটিতেই তার ডিউটি থাকে। শুক্রবার রাতে খাওয়া–দাওয়া শেষ করে আমরা বসে গেলাম ইউটিউবে নাটক দেখতে। ‘উড়ে যায় বকপক্ষী’ আমার বহুবার দেখা তবু বারংবার দেখি। গিন্নি বলল, আর কতবার দেখবে। এবার অন্য কিছু দেখা যাক। বললাম, তাহলে চলো ‘বহুব্রীহি’ ম্যারাথন শুরু করা যাক। এরপর থেকে বাসায় গত তিন দিন টানা ‘বহুব্রীহি’ চলছে। ইতিমধ্যেই জেনে গেছি এই প্রথম গিন্নির ডিউটি নেই ছুটির দিনে। কারণ, এই সময়ে তার দেশে যাওয়ার কথা ছিল শ্যালকের বিয়ের অভ্যর্থনায় যোগ দিতে কিন্তু করোনার প্রকোপ শুরু হওয়ার পর সেটা বাতিল করা হয়েছে আর সেই সঙ্গে তাদের ভ্রমণ পরিকল্পনাও আর আলোর মুখ দেখেনি।

এই কটা দিন সকাল শুরু হচ্ছে একটু দেরিতে। যদিও ছোট রায়ান রুটিন অনুযায়ী সেই ভোরবেলা উঠেই এ ঘর–ও ঘর করা শুরু করে। সবার একসঙ্গে এত বড় একটা সময় কাটানোর সুযোগ পাওয়া গেছে অনেক দিন পর, তাই আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি এই দুর্ভাবনার দিনেও একটু ভালো সময় কাটানোর। শনিবার রান্না করতে করতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল, তাই গিন্নিকে বললাম, চলো, আমরা বারান্দার টেবিলে বসে সবাই একসঙ্গে খাওয়া–দাওয়া করি। সেখানে একটা গোল টেবিল ঘিরে দুটি চেয়ার ছিল, তাই আমি ঘর থেকে আরও দুটি চেয়ার নিয়ে গেলাম। আমরা তিনজন শান্ত হয়ে বসে খাওয়া শেষ করলেও রায়ান তার চিরাচরিত নিয়মে কখনো চেয়ারে বসে আবার কখনো বাসার পেছনের জায়গায় একটা চক্কর দিয়ে এসে এক গাল ভাত নিয়ে যায়। এভাবেই খাওয়া শেষ হলো।

রোববার সকালবেলা উঠেই ভাবছিলাম আজকের নাশতাটাও পেছনের বারান্দায় করলে কেমন হয়। যথারীতি আমরা নাশতা তৈরি করে বারান্দায় চলে গেলাম। অবশ্য বারান্দায় নাশতা করতে যাওয়ার আরও একটা কারণ ছিল। আমাদের বাসার মধ্যে তখনো বেশ শীত করছে কিন্তু বাইরে যেহেতু সূর্যের আলো এসে পড়ছে, তাই বেশ উষ্ণ বোধ হচ্ছিল। আমরা নাশতা নিয়ে টেবিলটাকে যতদূর সম্ভব বারান্দার পূর্ব দিকে ঠেলে নিয়ে বসে গেলাম। আমাদের শরীরে সকালবেলার মিষ্টি রোদ এসে পড়েছে। যথারীতি রায়ানের দুষ্টুমি চলতে থাকল। নাশতা শেষ করে গিন্নি বের হয়ে গেল কারণ বাসার মধ্যে তার দমবন্ধ লাগছে। তাই কাছের নার্সারিতে গেল গাছের খোঁজে। অন্যান্য সময় হলে আমরা পুরো পরিবার একসঙ্গে যেতাম কিন্তু এখন সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হচ্ছে। তাই সে শুধু একাই বের হলো। আমি তাহিয়া আর রায়ান বাসার পেছনের জায়গাটায় খেলাধুলো শুরু করে দিলাম। রায়ানের জন্য কোনো খেলাই বেশিক্ষণ খেলা যাচ্ছিল না। সে ক্ষণে ক্ষণে সিদ্ধান্ত বদলায়। এই ফুটবলে কিক করে তো সেই প্লাস্টিকের ক্রিকেট ব্যাট নিয়ে নামে আবার র‍্যাকেট দিয়ে প্লাস্টিকের বলে বাড়ি দেয়। এসব করতে যেয়ে বেশ কয়েকটা প্লাস্টিকের বল আশপাশের বাড়ির সীমানাপ্রাচীরের মধ্যে গিয়ে পড়ল। বেশ আগে ছোট এক ব্যাগ প্লাস্টিকের এই বল কিনে আনা হয়েছিল। এত দিন কোনো কাজে লাগেনি। করোনার কারণে সেগুলো এখন খেলার উপকরণ হয়ে উঠেছে। অবশেষে আমি আর তাহিয়া ক্লান্ত হয়ে ইউটিউবে নব্বইয়ের দশকের পুরোনো ইংরেজি গান শুনতে বসলাম। ইংরেজি গান শুনতে বসার কারণ হচ্ছে তাহিয়া এখন ইংরেজি গান শোনে। আমরা একে একে লিংকিন পার্কের ‘ইন দ্য ইন্ড নাথিং এলস মেটার’, ক্যারিবিয়ান্সের ‘জম্বি’, মাইকেল জ্যাকসনের, ‘দে ডোন্ট কেয়ার এবাউট আস’—এমন আরও গান শুনে গেলাম। অবশেষে ওরা দুজন ঘরে ফিরে গেলে আমি আইয়ুব বাচ্চুর বেস্ট গানগুলো ছেড়ে দিলাম।

তাহিয়া আর রায়ানের চিৎকারের কারণে তখন পর্যন্ত বুঝিনি যে আশপাশের বাসাতেও সবাই গান বাজাচ্ছে। আমি হঠাৎ আনমনা হয়ে গেলাম। গান শোনা বন্ধ করে দিয়ে আশপাশে দৃষ্টি ফেরালাম। পূর্ব পাশের প্রথম বাসাটার টিভি অ্যানটেনা বাসা থেকে অনেক উঁচুতে। দেখতে অনেকটা আমাদের ছোটবেলায় দেখা উঁচু বাঁশের মাথায় টাঙানো অ্যানটেনার কথা মনে হয়। এর পরের বাসাটা বেশ উঁচু জায়গায় অবস্থিত। তাদের সীমানার মধ্যে একটা জ্যাকারান্ডার গাছ আছে। জ্যাকারান্ডার পাতা বাংলাদেশের কৃষ্ণচূড়ার পাতার মতো। এখন গাছে ফুল নেই, তাই হঠাৎ পাতা দেখে মনে হচ্ছিল এখানে কৃষ্ণচূড়া এল কোথা থেকে। পরে মনে হলো, এটা কৃষ্ণচূড়া না জ্যাকারান্ডা। আমাদের ঠিক পেছনের বাসাটার সীমানার মধ্যে একটা তালসদৃশ গাছ আছে। দেখলে বারবার ছোটবেলায় তাল কুড়ানোর কথা মনে হয়। এই বাসাটার সামনেই একটা বড় উঁচু ঝোপের মতো গাছ। দেখলে মনে হয় এটা আমগাছ হলে কত ভালো হতো, তাহলে আমরা ঝড়ের দিনে ওখানে আম কুড়াতে যেতে পারতাম। তার পাশের বাসাটা সব সময় সরগরম থাকে বাচ্চাদের কোলাহলে। তাদের সঙ্গে আমাদের এখনো পরিচয় হয়নি। আর আমাদের পশ্চিমের বাসাটা জনের। করোনার প্রকোপ শুরু হওয়ার আগে জন আমাদের ডেকে দেখিয়েছিল ওর বাসার পেছনের বারান্দায় একটা পেঁচা এসে আশ্রয় নিয়েছে। তাই আর ওরা এখন পেছনের বারান্দায় খুব একটা আসে না কারণ পেঁচা নিরিবিলি পছন্দ করে। জন বলল, যত দিন ইচ্ছে পেঁচাটা থাকুক। আমাদের বারান্দা থেকেও পেঁচাটা দেখা যায়।

এভাবে পুরো ১৮০ ডিগ্রি দৃষ্টি ঘুরিয়ে এসে বারান্দায় ঝুলন্ত গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখি সেখানে প্রত্যেকটা পাতার মাথায় গোল গোল কুরির মতো কিছু একটা এসেছে। জানি না এগুলো আসলে কী। হঠাৎ বাতাস বন্ধ হয়ে গেল। অস্ট্রেলিয়ার আবহাওয়ার এই এক খেয়াল। কখন যে কী পরিবেশ হবে আগে থেকে জানা যায় না। পুরো আকাশ আজ গাড় নীল। আকাশে কোনো ভাসমান মেঘ পর্যন্ত নেই। আমি বারান্দা থেকে নেমে পেছনের ঘাসের মধ্যে হাঁটা শুরু করলাম। ঘাসগুলো কাটা হয়েছে গত সপ্তাহেই কিন্তু এর মধ্যেই আবার বেশ বড় হয়ে গেছে। ঘাসগুলোর মধ্যে পাতাবাহারের কিছু টব রাখা আছে। সেই জায়গাগুলোর ঘাস মরে গেছে বা সালোকসংশ্লেষণের অভাবে হলুদ হয়ে গেছে। সূর্যের আলো সালোকসংশ্লেষণের অন্যতম প্রভাবক। এমনকি মানুষের মনের ওপরও সূর্যের আলোর প্রভাব প্রকট। উজ্জ্বল সূর্যালোকের দিনে যেমন মানুষের মন ফুরফুরে থাকে আবার তেমনি মেঘলা দিনে মন থাকে বিষণ্ন। আর বিজ্ঞান বলে, আমাদের এই সবুজ পৃথিবী নাকি সূর্যেরই খসে পড়া একটা অংশ। তার মানে আমরা আসলে সূর্যেরই বাসিন্দা এবং সূর্যালোক ছাড়া আমাদের জীবন অসম্ভব। পৃথিবীতে আমাদের এই বসতি সেই অর্থে সূর্যে বসতিরই নামান্তর আর সূর্যই আমাদের এই বিপদের দিনে অভিভাবকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে আমাদের বিলুপ্ত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করবে। আমার কেন জানি মনে হয় শিগগিরই করোনার এই প্রকোপ আমরা কাটিয়ে উঠব। আমরা আবারও আমাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাব। সূর্যের আলোয় অনেক ছোটখাটো রোগজীবাণু নষ্ট হয়ে যায়। জানি না করোনাভাইরাস ধ্বংস হয় কি না। সে যা–ই হোক, সূর্য যেহেতু এখন পর্যন্ত আলো দেওয়া বন্ধ করেনি, তাই মানবসভ্যতা যে টিকে থাকবে, সে ব্যাপারে আমার কোনো সন্দেহ নেই।