নীল জলপদ্মের বাগান: যেন রূপবতী পদ্মবতী

বিভিন্ন প্রজাতির শাপলা ফুল। ছবি: লেখক
বিভিন্ন প্রজাতির শাপলা ফুল। ছবি: লেখক

পাঠক ভাবছেন বউকে ফাঁকি দিয়ে কোনো এক সুনয়না সপ্তদর্শী রূপসী কন্যাকে দেখার কথা বলছি। মাথা খারাপ! আমার ঘাড়ে কয়টা মাথা? আবার ভাবছেন না তো ‘পদ্মাবত’ সিনেমার দিপীকা পাড়ুকোনকে দেখে মাথাই নষ্ট? অথবা আলাওলের ‘পদ্মাবতী’কে আজ ভোররাতে স্বপ্নে দেখিছি, যার ঘোর কাটেনি এখনো। হয়তো ভাবছেন সে এমন কেউ ‘তারে আমি চোখে দেখিনি, তার অনেক গল্প শুনেছি, গল্প শুনে তারে আমি অল্প অল্প ভালোবেসেছি’। যার কথা বলছি, তারে আমি চোখেও দেখেছি, ভালোও বেসেছি, চোখের ও মনের ঘোর কোনোটাই এখনো কাটেনি। আপনারা বেশি কিছু কল্পনা করার আগে সেই রূপবতী পদ্মবতীর পরিচয়টা ফাঁস করি।

বলছি অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়া প্রদেশের ইয়ারা জাংশানে অবস্থিত নীল জলপদ্মের বাগানের (Blue lotus water garden) কথা।

বাগান প্রতিষ্ঠার ইতিহাস
১৪ একর জায়গার ওপর প্রতিষ্ঠিত এ বাগানটির আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়েছিল মাত্র ১৪ বছর আগে। ২০০৬ সালে যাত্রা শুরু হলেও এ বাগান গড়ার স্বপ্ন বুনন হয়েছিল তারও ১৬ বছর আগে ১৯৯০ সালে। জিওফ ও ইভন কোচারন দম্পতি তাঁদের উত্তরাধিকারীদের জন্য ভিন্ন রকম কিছু করবেন, এ ভাবনা দিয়ে শুরু করেছিলেন বাগানটি। পূর্ববর্তী সময়ে আগাছা ও ব্ল্যাকবেরিতে ভরা জায়গাটায় প্রথমে একটি সবজিবাগান করলেন। সবজির এত উপকারী ভিটামিন মন ভরাতে পারল না জিওফ দম্পতির। ৯০ দশকের মাঝামাঝি সময়ে জিওফ চিন্তা করলেন ‘Fly fishing resort’ শুরু করার। মানে বেড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বরশি দিয়ে মাছ ধরা, দারুণ এক ভাবনা। তারই ধারাবাহিকতায় ছোট একটা কৃত্রিম হ্রদ, বাঁধ ও কিছু ছোট পুকুরও তৈরি হলো। বাগানে পদ্ম আর শাপলাদের আগমন হয়েছিল মাছের আশ্রয়স্থল হিসেবে। তার সঙ্গে পদ্ম-শাপলার রূপের বাহার তো আছেই। সেই রূপের বাহার দেখে জিওফের মাছ ধরার ভাবনাটি ভুলে যাওয়া এক স্মৃতিতে পরিণত হলো। এ যেন কৈশোরের সুন্দরী কোনো বান্ধবীকে প্রেমের প্রস্তাব দেওয়ার মতো, বর্তমানে জিজ্ঞেস করলে যার উত্তরটা হয় ‘প্রস্তাব দিয়েছিলাম নাকি? মনে পড়ছে না তো’। জিওফওয়ের ব্যতিক্রম কিছু করতে পারলেন না। সিদ্ধান্ত নিলেন সবজির সঙ্গে পদ্ম-শাপলা ফুলেরও বেপারি হবেন। এটা ২০০১ সালের ঘটনা। জিওফ ২০০৪ সালের দিকে পাইকারি ও খুচরা দুভাবেই ফুল বিক্রি শুরু করলেন। পরবর্তী সময়ে ২০০৬ সালে বাগানটি তিনি সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দিলেন।

বিভিন্ন প্রজাতির জলপদ্ম ফুল। ছবি: লেখক
বিভিন্ন প্রজাতির জলপদ্ম ফুল। ছবি: লেখক

কী আছে এই বাগানে
বাগানের সার্বিক সৌন্দর্যের উৎস হলো হাজারো দেশি-বিদেশি পদ্ম, শাপলা ও বিরল প্রজাতির ফুলের সমাহার। বাগানে রয়েছে দুটি লেক, ডজনখানেক পুকুর, যার সবগুলোই মেঠোপথ আর ১৫টি অলংকৃত কাঠের সেতুতে একটা আরেকটার সঙ্গে সংযুক্ত।

বাগানের ‘ট্রপিক্যাল ওয়াল্ড’ অংশে রয়েছে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ প্রজাতির শাপলা, জায়েন্ট ওয়াটার লিলি (Victoria cruziana ও Victoria longwood–এর হাইব্রিড)। যাদের একটি পাতার ব্যাসার্ধ ১ মিটার। এর ওপর আপনার পাঁচ বছর বয়সী সন্তানকে বসিয়ে তার ছবি নিতে পারেন, চিন্তা করবেন না আপনার সন্তান নিরাপদেই থাকবে। পাতার বড় সাইজের সঙ্গে এই ফুলের আয়ু ব্যস্তানুপাতিক। ফুলগুলো মাত্র ২ (দুই) দিনেই সাদা থেকে গোলাপি বর্ণ ধারণ করে ঝরে যায়। আপনি ভাগ্যবান হলে তবেই তাদের দেখা মিলবে।

‘ট্রপিক্যাল ওয়ার্ল্ড’ অংশে আরও আছে ‘অস্ট্রেলিয়ান ন্যাটিভ হাউস’। এই অংশে রয়েছে উত্তর অস্ট্রেলিয়ার গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের বর্ণবৈচিত্র্যে ভরপুর পদ্ম ও শাপলা ফুলের (নীল, বেগুনি থেকে সাদা) একটি বিরল সংগ্রহ। ট্রপিক্যাল হাউসে আরও রয়েছে রাতে ফোটা পদ্ম ফুল। মিসরের নীল জলপ্রপাতের ‘নীল পদ্ম’ ট্রপিক্যাল হাউসকে আরও সমৃদ্ধ করেছে। অন্যান্য গ্রীষ্মমণ্ডলীয় লতা-গুল্মের উপস্থিতি ‘ট্রপিক্যাল ওয়ার্ল্ড’ নামকরণকে আরও সার্থক করেছে।

বাগানের বড় (অর্ধ কিলোমিটার দীর্ঘ) লেকটির নাম মোনে’স লেক। এর নামকরণ হয়েছে প্রখ্যাত ফরাসি চিত্রকর ‘ক্লোদ মোনে’–এর নামে। এই লেকে ‘মোনে’স পদ্ম’ ছাড়াও আরও ৭০ প্রজাতির পদ্ম আর শাপলা রয়েছে। লেকটির একপাড়ে দাঁড়িয়ে দেখলে আপনি মোনের প্যাভিলয়নের চিত্রকর্মের বাস্তব রূপটি উপলব্ধি করতে পারবেন।

দ্বিতীয় লেকটিকে পদ্মফুলের ভার্চুয়াল সমুদ্র বললে বাহুল্য হবে না। কারণ প্রতি গ্রীষ্মে সাদা ও গোলাপি মিলে ১০ হাজারের বেশি পদ্ম নাকি এখানে ফোটে। লেকের চারপাশে পথচলার সময় কাছাকাছি পর্বতমালার দৃশ্য ভালোই লাগবে। লেকের পাড়ে রয়েছে বেশ কয়েকটি পিকনিক স্পট ও বিশ্রামের স্থান।

জায়েন্ট ওয়াটার লিলি। ছবি: লেখক
জায়েন্ট ওয়াটার লিলি। ছবি: লেখক

বাগানের একটি অংশে রয়েছে ডাইনোসর যুগের প্রাগৈতিহাসিক ‘ওগা লোটাস’, যা কিনা (জানামতে) পৃথিবীতে বর্তমানে জীবিত পদ্ম প্রজাতির মধ্যে সবচেয়ে পুরোনো প্রজাতি। জাপানি প্রত্নতাত্ত্বিক ‘ড. ওগা’ ১৯৫১ সালে এক প্রত্নতাত্ত্বিক খননকাজের সময় পূর্বে বিলুপ্ত এই পদ্ম প্রজাতির ৩টি বীজ খুঁজে পেয়েছিলেন। যাদের মাধ্যমে এই পদ্ম প্রজাতিটি পৃথিবীতে আবার ফিরে আসে। তাই তাদের ওগা লোটাস বলা হয়। জাপানি শৈলীতে তৈরি আর্চ ব্রিজসহ অন্যান্য শিল্পকর্ম বাগানের এই অংশটি আপনাকে জাপানি কোনো বাগানের অনুভূতি দেবে।
চায়নিজদের সৌভাগ্যের প্রতীক ৮৮ পাপড়িযুক্ত ‘সোনালী পদ্ম’–এর তুলনা সে নিজে। এই বাগানে এই সুন্দরীদের দেখা মেলে ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে।

পরিবার–পরিজন নিয়ে বাগান দেখতে গেলে শিশুদের জন্য রয়েছে আকর্ষণীয় ‘Fairy Garden’। পাশেই রয়েছে রূপালী লোটাস লেগুন। এখানে সব বয়সী শিশুদের আনন্দের জন্য ১২টি দৈত্যাকারের মাশরুম, বিশাল পরী সিংহাসন ও শৈল্পিক ঘরের সমন্বয়ে রূপকথার একটি আবহ তৈরি করা আছে।

মন আর চোখের তৃপ্তির পাশাপাশি উদরপূর্তির ব্যবস্থাও রয়েছে। বাগানের Lily Pond Cafe-তে রয়েছে পদ্ম ও শাপলার মজাদার অনেক রেসিপি। আইসক্রিম–প্রেমীদের জন্য রয়েছে গুরমেট আইসক্রিম কিউস্ক। এখানে স্কোপড আইসক্রিম, ঠান্ডা পানীয়, কফি, ক্যান্ডি, চিপস এবং অন্যান্য খাবার গ্রহণ করতে পারবেন। অন্যান্য সুবিধার মধ্যে গাড়ি পার্কিং ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন টয়লেট উল্লেখযোগ্য।

বাগানের নার্সারি থেকে আপনার বাড়ির টবে, পুকুরে ও অন্যান্য জলাধারে লাগানোর উপযোগী পদ্ম ও শাপলা ফুল, বীজ ও ফুলের গাছ কিনতে পারবেন। অনেক প্রজাতির জলজ উদ্ভিদও (যেমন: কচুগাছ লতিসহ) ক্রয়ের ব্যবস্থা রয়েছে।

কখন যাবেন
বাগানটি সাধারণত খ্রিষ্ট্রীয় ‘বড়দিন’–এর পরদিন মানে ২৬ ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত সপ্তাহের ৭ দিন (সরকারি ছুটিসহ) দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকে। মেলবোর্নের বাইরের ও বিদেশি বন্ধুরা মেলবোর্ন ভ্রমণের সময় অন্যান্য দর্শনীয় স্থান দেখার ফাঁকে ‘পদ্মবতী’ তথা নীল জলপদ্মের বাগানটিকে একবার দেখে নিতে পারেন।

কীভাবে যাবেন
মেলবোর্ন শহরের কেন্দ্রীয় স্টেশন থেকে ব্যক্তিগত গাড়িতে জিপিএসে ঠিকানা বসিয়ে চালাতে থাকলে ১ ঘণ্টা ১৫ মিনিট লাগবে। বাসেও যেতে পারেন, দুই ঘণ্টা লাগবে। আর ‘পদ্মাবত’ ছবির আলাউদ্দীন খিলজীর মতো ক্রেজি হলে হেঁটেও যেতে পারন। বেশি নয়, ২৪ ঘণ্টা সময় লাগবে।

স্ত্রীর সঙ্গে লেখক
স্ত্রীর সঙ্গে লেখক

পকেট থেকে খসবে কত
রূপবতী এই বাগান দর্শন কিন্তু ফ্রিতে হয় না। পকেট থেকে কিছু অস্ট্রেলিয়ান ডলার তো ছাড়তে হবেই। পূর্ণবয়স্করা দেখতে গেলে ১৮ ডলার। বেশি বয়স্কের (সিনিয়র) জন্য ১৫ ডলার। শিশুদের (০-১৫ বছর) জন্য ফ্রি। কারও পকেটে ছাত্রত্বের প্রমাণপত্র থাকলে (বাংলাদেশের বাসে হাফ ভাড়া হলেও) ওখানে মাত্র দুই ডলার ছাড় পাবেন। আর পুরো সিজনের জন্য টিকিট কিনতে ৩৬ ডলার লাগবে।

পরিশেষে
যদি ইচ্ছা পোষণ করেন, বিদেশি বাগানের সৌন্দর্যের সঙ্গে সঙ্গে একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন অভিজ্ঞতা নিতে পারেন। সেটি হলো আকাশিগাছ (Manna Gums) এবং অন্যান্য সুন্দর অস্ট্রেলীয় উদ্ভিদ ও প্রাণীতে শোভিত ছোট ইয়ারা নদী পাড়ের ছায়াযুক্ত পথ ধরে হাঁটা।
সবচেয়ে আর্কষণীয় বিষয়টি হলো আপনি হাঁটছেন, দুপাশে রয়েছে হাজারো পদ্মফুল। তার মধ্য থেকে কোনো সুন্দরী এক পদ্মিনী আপনাকে বলে উঠল, হ্যালো, আমার সঙ্গে একটি সেলফি নেবে? সেলফি নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আপলোডও করতে পারেন, কারণ বাগানে আছে ফ্রি ওয়াই–ফাই!

*লেখক: অধ্যাপক, অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ক্যানবেরা, অস্ট্রেলিয়া