করোনায় হোটেল চ্যান্সেলরে

হোটেল চ্যান্সেলরে রাখা হয়েছে অনেককে। ছবি: লেখক
হোটেল চ্যান্সেলরে রাখা হয়েছে অনেককে। ছবি: লেখক

ইউরোপের কয়েকটি দেশে অবিরাম মৃত্যুর মিছিল চলছেই। টিভির পর্দায়, পত্রিকার পাতায় শুধুই মৃত্যুর খবর। প্রতিদিন শত শত মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে। হাসপাতালগুলোয় রোগী রাখার জায়গা নেই। চিকিৎসক, নার্সরা রোগীর চিকিৎসাসেবা দিতে দিতে ক্লান্ত। হাজারো রোগী প্রতিদিন শনাক্ত হচ্ছে। আতঙ্কে দিন কাটছে প্রত্যেক মানুষের।

সব উপাসনালয় বন্ধ। জানি না আগামী দিনগুলোতে পরিস্তিতি কী হবে!

সকালে ঘুম থেকে উঠে রুমের সবাই একসঙ্গে ফজরের নামাজ পড়লাম। সবাই একসঙ্গে নামাজ পড়ার পর ঈদের খুশির মতো মনে হলো।

মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, রোদ-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে প্রত্যেক প্রবাসী অর্থ উপার্জন করে। মাতৃভূমিতে রেখে আসা স্বজনদের জন্য অবিরাম কষ্টের বোঝা বয়ে যায়। কষ্টের বোঝা বইতে বইতে দিন শেষে নিজের দিকে তাকানোর সময়ই হয়ে ওঠে না।

রুম সদস্যরা সন্ধ্যায় বাসায় আসার পর সবাই থাকে ক্লান্ত। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ফোনালাপে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। একে অপরের সঙ্গে মন খুলে কথা বলার সময় খুব কমই হয়। যতটুকু বলা হয়, সবই ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর এক সাগর হতাশা।

আমার দেখা কেউ কেউ আছে নিজের ভেতর সব কষ্ট পুষে রাখে প্রকাশ করতে চায় না। প্রিয়জনদের বুঝতেই দেয় না, সে কেমন আছে। শুধু পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ দিয়েও খেতে দেখেছি।

দিনশেষে যদি হিসাব মেলাতে চান, প্রবাসীরা দেশকে কী দিয়েছেন। বলব, কিছুই না। তাঁরা কিছু দিতে পারেননি। কিছু দিতে পারেন না। কিন্তু যে ত্যাগ স্বীকার করেন দিনের পর দিন, তার কি মূল্য দিয়েছেন আপনারা? বরং সম্মানিত ব্যক্তিরা প্রবাসীর নামের ওপর থুতু নিক্ষেপ করেন বারবার! থাকুক আপনাদের কোট-টাইয়ের সম্মান অক্ষুণ্ন। আলো জ্বাললে নেভার সম্ভাবনা থাকবেই। প্রবাসীরা আলো জ্বালাতে জানেন। একটি পরিবারের বেঁচে থাকার পথ দেখান।

মায়ের মন কোনো কিছুতেই বুঝতে চান না। বারবার কল দিয়ে মা জিজ্ঞাসা করছেন কেমন আছি। কীভাবে আছি। পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন থাকি কি না। পাঁচ তারকা হোটেলে কেমন আছি। বললাম, ভালো আছি।

সারা দিন বাসা থেকে বের হতে পারলাম না। নিরাপত্তাকর্মীদের কাছে নির্দেশ এসেছে গেটের বাইরে কেউ যেতে পারবেন না। হাউস ম্যানেজমেন্টের আদেশ যে ব্যক্তি অমান্য করবেন, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। শত শত মানুষ রুমের ভেতর বন্দী হয়ে রইলেন।

সবেমাত্র এশার নামাজ পড়ে উঠেছি। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে হাউস ম্যানেজমেন্টের লোক এসে বলছে আপনাদের ১৫ মিনিট সময় দেওয়া হলো। তাড়াতাড়ি আপনাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে বাইরে আসুন। আপনাদের অন্য জায়গায় শিফটিং করা হবে। হঠাৎ এমন কথা শুনে সবাই আতঙ্কিত হলাম। কোনো প্রশ্ন করার সময় পর্যন্ত নেই।

প্রতিদিন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্তের কারণে কোম্পানি হয়তো আমাদের নিরাপদ স্থানে রাখবে। জানি না ভাগ্যে কী আছে!

মালামাল গুছিয়ে হাউসের নিচে গিয়ে দেখি আমাদের কোম্পানির সবাই দাঁড়িয়ে আছেন। আমিও সারিতে দাঁড়ালাম। মনের মধ্যে আতঙ্ক কাজ করছে। মনে হচ্ছে বুকের মধ্যে কে যেন হাতুড়ি পেটাচ্ছে। আমাদের সবাইকে কি এই মুহূর্তে দেশে পাঠিয়ে দেবে।

নাঈম ভাইকে জিজ্ঞাসা করলাম আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে, কোনো তথ্য জানেন কি না। তিনি বললেন, আমাদের অর্চাড রোডে পাঁচ তারকা হোটেলে নিয়ে যাবে। ওমর ফারুকও একই কথা বললেন। আমার মাথার ওপর থেকে এভারেস্ট পর্বত সরে গেল। তখন আমি একেবারে ফুরফুরে মেজাজে। একটু সামনে তাকিয়ে দেখি আমার সেকশন ম্যানেজার মি. এনজি ওয়াই সিং। আমাকে দেখে বলল, তুমি এখানে থাক? আমি বললাম, হ্যাঁ।

সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে একেক গাড়িতে উঠল। তখন মোবাইলের স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখি রাত ১২টা বেজে ৭ মিনিট। এমন পরিস্থিতির জন্য কখনো প্রস্তুত ছিলাম না। আমাদের ডরমিটরির গেট অতিক্রম করে গাড়ি চলতে লাগল।

করোনাভাইরাস মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমিত হওয়ার কারণে একেকজন এক সিটে বসার জন্য বলা হলো। এত সুন্দর একটা দেশে থাকি, নিয়মকানুনে ভরপুর সুন্দর একটি দেশ। সব সময় নিয়মকানুনের ভেতর থাকতে থাকতে জীবনে অনেক পরিবর্তন এসেছে। এ দেশের মানুষ প্রতিটা বিষয়ে কতটা সচেতন। আর আমার বাংলাদেশের মানুষ হেঁয়ালিতে কানায় কানায় পূর্ণ। কেন আমরা সুন্দর পরিবেশ তৈরি করতে পারি না?

হোটেলে লেখক। ছবি: সংগৃহীত
হোটেলে লেখক। ছবি: সংগৃহীত

এমন একটা দুর্যোগের মুহূর্তে দেশ কাঁপছে, আর সেখানে গার্মেন্টস মালিকেরা দাবার ঘুঁটি–চালাচালি বন্ধ রাখতে চান না! লকডাউনের কারণে রাজধানী থেকে শুরু করে দূরপাল্লার সব পরিবহন বন্ধের ভেতর পোশাকশ্রমিকদের নিয়ে অমানবিক টানাহেঁচড়া করলেন কতিপয় মানুষ! সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, পত্রিকার পাতায়, টিভির পর্দায় গার্মেন্টস খোলার নির্দেশ নিয়ে সমালোচনা।

গাড়ির ভেতর বসে ভাবছি, এই তো জীবন! মানুষ আজ এখানে, আগামীকাল অন্য কোথাও। তবু মানুষের কেন এত উঁচু গলাবাজি? কেন এত ভেদাভেদ?

গাড়ি এসে থামল হোটেল চ্যান্সেলরের সামনে। গাড়ি থেকে মালামাল নামিয়ে রিসেপশনে নাম–ঠিকানা রেজিস্ট্রেশন করলাম। রুমের ভেতর গিয়ে সাজানো–গোছানো পরিপাটি রুম দেখে মনটা চাঙা হয়ে উঠল।

ক্ষুদ্র একটা ভাইরাস পৃথিবীটা ওলট–পালট করে দিচ্ছে। মানুষের অহংকার সবই ধুলায় মিশে যাচ্ছে।
পৃথিবীর ক্ষমতাধর দেশ বাঁচার উপায় খুঁজতে খুঁজতে দিশেহারা। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মুখে ফুটে উঠেছে অসহায়ত্বের ছাপ। বাংলাদেশের মানুষ প্রিয়জন হারানোর বেদনায় বুকে পাথর বাঁধছে। আকাশে–বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে শুধুই কান্নার করুণ সুর।