রিতুর অজানা ছোটগল্প

নাছির ভাইকে দেখলেই রিতু দৌড়ে দরজার পেছনে, খাটের কোনায় লুকিয়ে থাকে। তা–ও প্রায়ই নাছির ভাই রিতুকে ধরে ফেলে। দরজার পেছনে লুকালে ধরছি ধরছি বলে পান খাওয়া দাঁতে হাসতে থাকে আর রিতুর জামার ভেতর হাত ঢুকিয়ে দেয়! খাটের কোনায় লুকালে আশপাশে তাকিয়ে একটু একটু করে রিতুর কাছে গিয়ে জোরে জড়িয়ে ধরে গালে কামড় আর জামার ভেতর হাত দেয়, জোরাজোরি করলে পরে বুকে খুব ব্যথা করে।

নাছির ভাইকে ঘরে আসতে দেখলেই রিতুর ভেতরটা শুকিয়ে যায় ভয়ে। মাকে কয়েকবার বলেছে নাছির ভাইকে যেন ঘরে আসতে না দেয়। মা ধমক দিয়ে বলেছেন, ছি শরম, ভাই না, এসব বললে কী ভাববে!

নাছির ভাইয়ের দুটি বাচ্চা, মেয়েটা রিতুর থেকে দুই বছরের ছোট। রিতুর বয়স এখন ৫। রিতু দেখতে বেশ সুন্দর, একদম ধবধবে ফরসা আর স্বাস্থ্যও ভালো।

নাছির ভাইয়ের আরেক ভাই নাদিম। সেও আসে রিতুদের ঘরে। রিতু তাকে দেখলেও ভয় পায়। মা যখন রান্নাঘরে রান্না করেন, সে তখন ঘরে বসে মায়ের সঙ্গে গল্প করে আর রিতুর গায়ে হাত দেয়। রিতু দৌড়ে পালালে মাকে বলে, পানি খাব চাচিম্মা। রিতুরে একটু পানি দিতে বলেন!

রিতু দেখতে সুন্দর বলে এমনিতেই ওকে অনেকে খুব আদর করে, ছোটবেলা সবাই ওকে কোলে নিতে চাইত। গ্রামে অত ফরসা মেয়ে কমই দেখা যায়।

পাশের ঘরের লিটন ভাই রিতুকে খুব আদর করে। মাঝেমধ্যে এটা–সেটা কিনে দেয়। রিতুর বড় ভাইয়ের সঙ্গে রিতুকে ও পড়া শেখায়। একদিন লিটন ভাই মাকে বলে, আজ আমার কলেজ নাই। রিতু পড়তে চাইলে আমার ঘরে পাঠিয়ে দেন। রিতু দুষ্টুমি করছিল। তাই মা রিতুকে বলে বই নিয়ে লিটন ভাইয়ের ঘরে যেতে। লিটন ভাই কলেজে পড়ে। তাই ওনার আলাদা ছোট্ট ঘর। রিতু খুশিমনে যায় কারণ ভাইয়া তাকে অনেক আদর করে আর মজার মজার খাবার খেতে দেয়। শীতের দিন, ভাইয়া কম্বলের নিচে হাত–পা ঢুকিয়ে আছে, রিতুকে পড়া বলে দিচ্ছে আর চিপস খেতে দিয়েছে। ভাইয়া বলে, রিতু, তোর শীত করছে না? আয় আমার সাথে কম্বলের ভেতরে চলে আয়। রিতু কিচ্ছু না ভেবেই ভাইয়ার কাছে চলে যায়!

রিতুর খুব কষ্ট লাগে ও যেখানে যায়, সেখানেই কেউ না কেউ ওকে বুকে ব্যথা দেয়।

আজকাল স্কুলে যেতেও আর ভালো লাগে না রিতুর। রিতু এবার ক্লাস সিক্সে পড়ে। ইংরেজি স্যারের ক্লাস আসলেই রিতুর বুকের ভেতরটা ভয়ে কুকরে যায়। স্যার ক্লাসে এসেই লিখতে দেন। আর ঘুরে ঘুরে সুন্দরী মেয়েদের পাশে দাঁড়ান, এটা–সেটা জিজ্ঞেস করেন। তারপর একফাঁকে জামার ভেতর হাত ঢুকিয়ে দেন। ক্লাসের সব মেয়েরাই জানে, দেখে কিন্তু কেউ কিছু বলতে পারে না, ভয় পায়, নিশ্বাস বন্ধ করে রাখে এরপর কার পালা সেসব ভেবে। একদিন ক্লাসের মনিরার জামার ভেতর হাত দেওয়ার পর সে চিৎকার করে আর বলে ছেড়ে দিতে। কিন্তু সবার সামনে স্যার ওর ওড়না ফেলে দেয় আর তার কুৎসিত কাজটি করতে থাকে! মনিরা সেদিন সাহস করে ক্লাস শেষে সঙ্গে কয়েকজনকে নিয়ে প্রিন্সিপালের রুমে গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে স্যারকে সব বলে দেয়, অন্যরাও সাক্ষী দেয়। তারপর এক সপ্তাহ সেই ইংরেজি স্যার আর ক্লাসে আসেননি। সবাই আতঙ্ক নিয়ে ক্লাস করত আবার কবে সেই স্যার ক্লাসে চলে আসে! কিন্তু মনিরার সেদিনের সেই সাহসিকতায় সবাই সেই আতঙ্ক থেকে বেঁচে যায়। স্যারকে স্কুল থেকে বের করে দেওয়া হয়। তিন বছর ধরে এই স্যার অনেক মেয়ের সঙ্গে এসব করতেন কিন্তু ভয়ে কেউ কখনো প্রিন্সিপালের কাছে বিচার দিতে সাহস পায়নি। অবাক করা বিষয় হলো, অন্য স্যাররাও জানতেন এই স্যারের এসব বাজে কাজের কথা কিন্তু তাঁরাও চুপ ছিলেন! তাই এবার সরাসরি অভিযোগ পেয়ে প্রিন্সিপাল স্যার ভয়ংকর লোকটাকে স্কুল থেকে বের করে দেন। তারপর থেকে স্কুল লাইফটা রিতুর দারুণ কাটে।

রিতু এখন ভার্সিটিতে পড়ে। যে সৌন্দর্য মেয়েদের অহংকার সেই সৌন্দর্যকে রিতু ঘৃণা করে। রিতুর ২২ বছর বয়সে অসংখ্য কুৎসিত লোকের হাত আর দৃষ্টি তার শরীরকে ছুঁয়ে গেছে। সেখানে ভাইয়ের বয়সী থেকে বাবার বয়সী নরপশু কেউই বাদ যায়নি। সইতে সইতে প্রতিবাদ করতে শিখেছে কিন্তু অবাক হয়ে দেখেছে, তার প্রতিবাদে কোনো দিন একজন মানুষও তাকে সমর্থন করে একটি কথাও বলেনি। বরং প্রতিবাদ করাতে লোকজন তাকেই কটাক্ষ করেছে, খারাপ মেয়েমানুষ ভেবেছে! এসব এখন গা সওয়া হয়ে গেছে। আর রিতু কথা বলে দেখেছে, প্রায় প্রতিটা মেয়ের জীবনকাহিনি এই দিকটায় এসে একই রকম!

আর আজকাল পত্রিকা খুললেই তো পাঁচ–সাতটা ধর্ষণের খবর পাওয়া যায়। এসব ধর্ষণের খবর আর মানুষকে সেভাবে নাড়া দেয় না, কটাইবা পত্রিকা বা মিডিয়াতে আসে।

করোনাভাইরাসে সারা পৃথিবী আজ থমকে গেছে। প্রতিদিন হাজারো মানুষ মারা যাচ্ছে। সবাই নিজ নিজ জান বাঁচাতে ব্যস্ত। অথচ এই কেয়ামতের মধ্যেও আমাদের দেশে নিউজ আসে সাত বছরের বাচ্চা মেয়েকে ৭০ বছরের বৃদ্ধের ধর্ষণ! ত্রাণ নিতে গিয়ে কিশোরী মেয়ে ধর্ষিত, অসহায় মা রক্তাক্ত মেয়েকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটছেন!

করোনাভাইরাসের কারণে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। তাই পড়াশোনা সেভাবে হচ্ছে না তবে ইদানীং খুব মুভি দেখা হচ্ছে। ইউটিউব ঘুরতে ঘুরতে হুমায়ুন আহমেদের একটা ছবিতে চোখ আটকে যায়, নাম ‘প্রিয়তমেষু’। নামটা দেখেই ছবিটা দেখতে ইচ্ছে হলো, কী সুন্দর নাম প্রিয়তমেষু!

ভেজা চোখে ছবিটা শেষ করে রিতু একদম থ হয়ে বসে থাকে। হঠাৎ তার ছোটবেলার সেই দিনটির কথা মনে পড়ে। সরল মনে ছোট্ট রিতু সেদিন লিটন ভাইয়ের সঙ্গে কম্বলের ভেতর ঢোকার পর ভাইয়া সেদিন যা করেছিল তা, তা তো ধর্ষণ!