করোনাযুদ্ধে পেনাং দুর্গ

বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেসবুুক পেজে নানান বার্তা দেওয়া হয় সবসময়। ছবি: লেখক
বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেসবুুক পেজে নানান বার্তা দেওয়া হয় সবসময়। ছবি: লেখক

প্রবল ঘুর্ণিঝড় কিংবা জলোচ্ছাসের যেমন পর দেখা যায় মূল ক্ষতিগ্রস্থ এলাকার পাশাপাশি আশেপাশের এলাকাগুলো ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে, ঠিক তেমনিভাবেই করোনাভাইরাসের ভয়াল থাবায় পৃথিবীর অনেক দেশ নাস্তানাবুদ হলেও গ্রাস থেকে রক্ষা পাচ্ছে না কেউই।

পৃথিবীর বড় বড় শহর যেখানে সামর্থ্যের সবটুকু নিংড়ে দিয়ে প্রাণপণ লড়াই করে যাচ্ছে সেখানে মালয়েশিয়ার পেনাং যেন হাজারো দুর্গের শহর। প্রত্যেক বাড়িতে দুর্গ গড়ে তোলার যেন আক্ষরিক বাস্তবায়ন করে চলেছে মালয়েশিয়ার মূল ভুখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন এই দ্বীপ রাজ্যের মানুষ।

অবস্থানগত হিসেবে পেনাং-এর অবস্থান রাজধানী কুয়ালালামপুর থেকে সাড়ে তিন'শ কিলোমিটার দূরে। প্রায় ২৪ লাখ লোক এখানে বসবাস করেন। মালয়েশিয়ার মূল খণ্ডে এই রাজ্যের কিছু অংশ থাকলেও এর বেশিরভাগ অংশ ও প্রাণশক্তি পেনাং দ্বীপ ঘিরেই। রয়েছে রাজ্য সরকারের নিজস্ব পরিচালনা ব্যবস্থা। মুলত সমুদ্র সৈকত ও ঐতিহাসিক নিদর্শন ভিত্তিক পর্যটন এবং শিল্পভিত্তিক রাজ্য হলেও গত ৫০ বছর ধরে এই শহরের হৃদস্পন্দনের ভুমিকা পালন করে আসছে রাজ্যের একমাত্র পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিভারসিটি অফ সায়েন্স মালয়েশিয়া।

উচ্চশিক্ষার খাতিরে বর্তমানে আমার অবস্থান এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পোস্টগ্র্যাজুয়েট ছাত্রাবাসে। মালয়েশিয়ার অন্যান্য রাজ্যের মতোই এখানেও করোনা পরিস্থিতি নিয়ে একটা চাপা উদ্বেগ চলছিল মার্চ মাসের শুরু থেকেই। মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে ধরা পড়ে প্রথম কোভিড-১৯ পজিটিভ রোগী। এরপর রুটিন মাফিক ক্লাস-কারিকুলাম চললেও আমরা ধরেই নিয়েছিলাম খুব বেশিদিন এভাবে চলবে না। এর মধ্যে সরকারিভাবে নিষেধাজ্ঞা আসে সকল প্রকার ব্যক্তি অবস্থানের, যেখানে বলা হয় একসঙ্গে ৩০ জনের বেশি অবস্থান করা যাবে না। গ্রাফ-চার্টের অনুমানকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দেশজুড়ে ঊর্ধ্বমুখী হতে থাকে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা।

পেনাংয়ের গণপরিবহণে স্বাস্থ্য পরীক্ষা চলছে। ছবি: সংগৃহীত
পেনাংয়ের গণপরিবহণে স্বাস্থ্য পরীক্ষা চলছে। ছবি: সংগৃহীত

পরবর্তীতে ১৫ মার্চ ঘোষণা আসে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস বন্ধের। এরপর ১৬ মার্চে রাজ্যজুড়ে লকডাউন। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় নেয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল প্রবেশ এবং প্রস্থান ফটক আটকে দেওয়ার এক কঠিন এবং কার্যকরী সিদ্ধান্ত। যা কার্যকর করা হয় ১৭ মার্চ থেকে।

লকডাউনের প্রথম দিন নানা বিভ্রান্তি থাকলেও সেদিনই বিশ্ববিদ্যালয় এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে আসতে থাকে নানা রকম দিকনির্দেশনা। যা তাদের ফেসবুক পেজ এবং বিভিন্ন হোয়াটসঅ্যাপ গ্রূপের মাধ্যমে নিমিষেই পৌঁছে যায় সবার কাছে। একই দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ে গঠিত হয় 'করোনা নার্ভ সেন্টার' যার মূল দায়িত্বে রয়েছেন উপাচার্য মহোদয়। প্রতিটি নড়াচড়ায় তাঁর নজরদারি, নীতিনির্ধারণে শারীরিক উপস্থিতি এবং ভিডিও বার্তা ছাত্র-শিক্ষক এবং কর্মকর্তাদের মধ্যে নিয়ে আসে একটি সুশৃংখল পরিস্থিতি। একই সাথে পেনাং-এর বাসিন্দাদের জন্য স্বাস্থ্য-মন্ত্রণালয় থেকে আসতে থাকে প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা।

প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার পর আসতে থাকে পরবর্তী নির্দেশনা। শহরের সকল গণপরিবহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা, রাস্তার মোড়ে মোড়ে বসানো পুলিশ চেকপোস্ট এবং এলাকা ভিত্তিক নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দোকান ভাগ করা। এতে বিচ্ছিন্ন হয় সামাজিক যোগাযোগের অনেকটাই। আর সাথে ব্যক্তি পর্যায়ে অফিস-আদালতসহ সকল প্রতিষ্ঠান এবং বাসস্থানগুলো রুপ নেয় একেকটি অভেদ্য দুর্গে। নৈশজীবনের জন্য বিখ্যাত পেনাং এর রাজধানী 'জর্জটাউন' পরিণত হয় এক ভূতুড়ে নগরীতে।

লেখক
লেখক

এরপর আমরা পুরোপুরিভাবেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটের বাইরের পৃথিবী থেকে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে আসা নির্দেশনার পাশাপাশি আবাসিক শিক্ষার্থীদের জন্য আসতে থাকে প্রতি সপ্তাহে টোকেন। যা দিয়ে কেনা যাবে খাবার ও খাদ্য সামগ্রী। বিশ্ববিদ্যালয় তাদের সকল ক্যানটিনকে নির্দেশ দেয় রাত নয়টা পর্যন্ত খোলা রেখে শুধু পার্সেল সার্ভিস চালু রাখার। আগে সাধারণত বিকেল পাঁচটা'র মধ্যেই বন্ধ হয়ে যেত ক্যানটিনগুলো, দুই-একটি বাদে। আর আমাদের প্রধান ক্যাম্পাসে এখনো কোনো কোভিড-১৯ এ কেউ শনাক্ত হয়নি।

২৫ মার্চ নার্ভ সেন্টার থেকে প্রতিটি দেশের একজন প্রতিনিধি নিয়ে গঠিত হয় স্বেচ্ছাসেবক দল। এদের দায়িত্ব দূরত্ব বজায় রেখে নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যেও ঝুঁকি নিয়ে সপ্তাহে একদিন নিজ নিজ দেশের প্রতিনিধি হয়ে সকলের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কেনা (যেগুলো ক্যাম্পাসে পাওয়া যায় না)। স্বেচ্ছাসেবীদের পুরো দলের নেতৃত্বে আছেন ব্যবসায় প্রশাসনের পিএইচডি গবেষক বাংলাদেশের আশিক রহমান।

এভাবেই কাটতে থাকে আমাদের উদ্বেগের দিনগুলো। এরই মধ্যে এখানকার পরিস্থিতি নিয়ে নয়, বরং আমাদের মনগুলো পড়ে থাকে বাংলাদেশে পরিবারের কাছে আর চোখগুলো ল্যাপটপ ও মোবাইলের পর্দায় খুঁজে বেড়ায় বাংলাদেশ। শুধু সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্তের কারণেই পেনাং–এ আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা (১২ এপ্রিল পর্যন্ত ১০৮ জন) যা মালয়েশিয়ার অনেক রাজ্যের তুলনায় অনেক কম। তবুও লকডাউন চলছে। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ থাকবে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যা বর্তমানে চলছে অনলাইন ভিত্তিক।

এখানে ঘটনাপ্রবাহ এবং দিকনির্দেশনাগুলো লক্ষ্য করলে যা নজরে আসে, সঠিক সময়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা, প্রয়োজনে কঠিন হওয়ার মতো নেতৃত্ব, সিদ্ধান্তের প্রতি সকলের আন্তরিকতার সাথে একাত্বতা প্রকাশের নীতি এবং সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ আইন ও নিয়মের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন। লকডাউন-এর সময়ে বাসিন্দাদের সবাই মিলে শহরের একেকটি বাড়ি এবং প্রতিষ্ঠানকে একেকটি দুর্গ হিসেবে ব্যবহার করেই এখনো করোনাযুদ্ধে মাথা উঁচু করে শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে ভালোবাসার এই শহরটি।

*লেখকঃ প্রভাষক, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ও পিএইচডি গবেষক, স্কুল অফ কমিউনিকেশন, ইউনিভার্সিটি অফ সায়েন্স মালয়েশিয়া। [email protected]