মা, মাতৃত্ব

ঘুম কাতুরে রুশা কে আজকাল ঘুমাতে হয় হাই ডোজের ঘুমের ওষুধ খেয়ে! তাও তো সেভাবে ঘুম হয় না, তাই সারাদিন খুব দুর্বলতার কারনে নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকে। অরন্য একটু পর পর কল করে খোঁজ নেয়। কিন্তু রুশা ঠিক বুঝতে পারে দায়িত্ব সবটুকু। ভালোবাসার ছোঁয়া টা যেন দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে!
ঘুমাতে খুব ইচ্ছে করে রুশার, শুধু ঘুমালেই যে মায়া তার কাছে আসে! কিন্তু ঘুম কেনো আসে না।
মা মনি.. আমাকে ধরো, আমাকে ধরো, পারবে না, পারবে না। রুশা দৌড়ে মেয়েকে ধরতে যায় আর মায়া মজা পেয়ে খিলখিল করে হাসতে থাকে, ইসস মেয়েটার হাসি এতো সুন্দর কেন!
কলিং বেলের শব্দ আর মায়ার হাসির শব্দে রুশা ধড়ফড় করে উঠে বুঝতে পারে সে স্বপ্ন দেখছিল। কিন্তু এই সময় কে কলিংবেল বাজাচ্ছে , ভুরু কুঁচকে মায়া উঠে বসে। নাহ অরন্য নয় সে এটা সিউর, কারণ সে দিন অনেক আগেই পার করে এসেছে, এসব ইমোশান আর অরন্যের মধ্যে নাই।
রুশা ঠিক বুঝতে পারে তার হেলুশিনেশন হচ্ছে, মায়া কোত্থেকে আসবে, মায়ার অস্তিত্ব তো শুধু তার কল্পনায়। কিন্তু এ তো ঠিক তার মায়া!
সেই সাদা ফ্রক, মায়াময় সজল চোখ, মিষ্টি হাসি মুখ, বিনুনি কিন্তু খালি পা!
মায়া একবার রুশার দিকে তাকিয়ে ছোট্ট ছোট্ট পায়ে ড্রয়িং রুমে একটু দাড়িয়ে কি যেন ভাবলো আর মায়ার রুমের দিকে যেতে লাগল, রুশা আটকাতে গিয়েও কিছুই করতে পারল না, এই রুমে কারো যাওয়া নিষেধ । অরন্য ও যেতে পারে না। রুশা পুরো হতভম্ব, কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না। দরজায় দাড়িয়ে কিছুক্ষণ এদিক সেদিক দেখল কিন্তু বাচ্চা টা কোথা থেকে এসেছে কিছুই বুঝতে পারছে না, কাউকে না পেয়ে রুশা দরজাটা বন্ধ করে এসে দেখে মেয়েটা মায়ার টেডি বিয়ার টা নিয়ে খুব সহজ ভঙ্গীতে খেলছে, যেন এই রুম এই খেলনা সব তার! আশ্চর্য রুশার কোনো রাগ হচ্ছে না, তার মায়ার খেলনা নিয়ে কেউ খেলছে!
রুশা পাশে বসে কাঁপাকাঁপা হাতে মেয়েটার মাথায় হাত রাখলে মেয়েটা একবার ওর দিকে তাকিয়ে ফোঁকলা দাঁতে হাসলো মাত্র, তারপর আবার আপন মনে খেলতে লাগল।
রুশা ঘোরের মধ্যে আছে, সে কি করবে বুঝতে পারছে না। আচ্ছা সে কি অরন্যকে ফোন করবে? কিন্তু কি বলবে, যাই বলুক সেইতো পাগল ভাববে। আর অন্য কেউ তো আসে না।
বেশ কিছুক্ষণ পর রুশা বাইরে একটা শোরগোল আর হাল্কা কান্নার শব্দ যেন শুনতে পেল। বারান্দায় দাড়িয়ে দেখতে পেল একজন নারী কাদছে পাশে কয়েকজন মিলে দারোয়ান কে কি যেন বলতেছে।
রুশা এতক্ষণে বুঝতে পারে বাচ্চাটা কোথা থেকে এসেছে। সে এখান থেকে গেটের মানুষগুলো কে ডাকে কিন্তু কেউ তার কথা শুনতে পায় না, একজন পুরুষ মানুষ গাড়ি থেকে নামলে নারী তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে।
রুশা আবার দরজায় কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থাকে কিন্তু কাউকে উপরে আসতে না দেখে আবার বারান্দায় ফিরে যায় আর হাত নাড়তে থাকে। হঠাৎ পুরুষটি রুশাকে দেখতে পায়, রুশা ইশারায় তাকে উপরে আসতে বলে, লোকটি কিছু না বুঝেই দৌড়ে উপরে আসে, রুশা দরজায়ই দাঁড়িয়ে ছিল, ভিতরে ঢুকে মাহিন অবাক, মীরার মা মেয়েকে না পেয়ে অস্থিরহয়ে কাঁদছে আর মেয়ে অপরিচিত এক বাসায় বসে পরিচিতের ন্যায় খেলছে!
সেদিনের পর থেকে রুশার বাসা হয়ে গেছে মীরার বাসা। রুশার আজকাল আর ঘুমের সমস্যা, মানসিক সমস্যা নাই। অরন্যের সাথে যেন আবার সেই সুন্দর দিনগুলোতে ফিরে গেছে। তবে অরন্যের প্রায়শই ভয় ভয় লাগে, এটা তো স্বাভাবিক পরিবর্তন না, যে কোন সময় যে কোন ঝড় আসতে পারে। বিশেষ করে রুশা যেভাবে মীরার সাথে জড়িয়ে যাচ্ছে!
মীতু, মীরার মা ক'দিন থেকেই খুব অসুস্থ। তাই মীরা মানে মায়া বলতে গেলে সারাদিন ই রুশার সাথে থাকে। খাওয়া, ঘুম এমন কি গোসল ও রুশা করিয়ে দেয়। তেমন কোনো সমস্যা হয় না, মীরার জন্য এই বাসায় সব আলাদা করে কেনা আছে।
মিরাকে নিয়েই রুশা ওর পছন্দের ড্রেস, খেলনা সব কিনে আনে।
এই শুনছো, মিতু ভাবির আবার বেবি হবে।
এই কথাটা অরন্যকে বলার সময় রুশার চোখ কেমন চক চক করছিল। অরন্য মনে মনে অবাক হলো আর ভয় ও পেল। রুশা আগে এই ধরনের কথা শুনলে কষ্ট পেতো আর আজ এতো খুশি। অরন্য ঠিক বুঝতে পারে কেনো রুশা এতো খুশি, সে হয়তো মনে মনে মায়াকে নিজের করে পাওয়ার স্বপ্ন দেখছে!

মিতু ভাবিও কথায় কথায় বলে মায়াতো ভাবি আপনারই মেয়ে, আমি মায়ার আশা ছেড়ে দিয়েছি! জানেন ভাবি ডা. বলছে এবার আমাদের ছেলে হবে। মায়া প্রথম সন্তান সে ঠিক আছে কিন্তু আমার আসলে ছেলের শখ ছিল।
কিছু মনে না করলে, ভাবি আপনাদের বিয়েতো হয়েছে শুনলাম চার বছর আর মায়াকে আপনি এতো ভালবাসেন তাহলে আপনারা কেনো বাবু নিচ্ছেন না? মায়ার মুখটা শক্ত করে বুকে জড়িয়ে রুশা চোখ বন্ধ করে রাখে। প্রথম সন্তান আসার বাধভাঙ্গা আনন্দের মাঝে অভিশপ্ত মিসকারেজ! ওর চোখ বেয়ে দু ফোটা পানি গড়িয়ে মায়ার কপালে পড়লে মায়া অবাক হয়ে রুশাকে দেখে আর বলে রুশা মা তুমি কাঁদছো কেনো?
কই মা কাঁদছি না তো !
রুশা মনে মনে ঠিক করে সে মিতু ভাবিকে তার মনের কথাটা বলবে, আল্লাহ দিলে মিতু ভাবি তো চাইলেই মা হতে পারবে।
আর ওনিতো বলেছেন মেয়ে ওনার তেমন পছন্দ না। অরন্যকে বলছিল কিন্তু অরন্য ভীষণ রাগ করেছে আর সাবধান করেছে যেন ভুলেও ভাবির কাছে এসব না বলি।
রুশা, মায়াদের বাসায় মিতু ভাবির সাথে গল্প করছে আর মনে মনে সুযোগ খুঁজছে। মিতু ভাবি ছোট্ট টুলে দাড়িয়ে একটু উচুতে থাকা চা ছাকনি টা নিচ্ছিন ঠিক তখন আনমনা রুশা ভাবি বলে ডাক দিলে মিতু ভাবি উল্টে তাকাতে গেলে ব্যালেন্স হারিয়ে নিচে পড়ে যান!
কি হয়েছে সেটা বুঝতে রুশার অনেকটা সময় লেগে যায়। মায়া দৌড়ে মায়ের কাছে গিয়ে দেখে রান্না ঘর রক্তে ভেসে যাচ্ছে! মায়ার চিৎকারে রুশার বোধ ফিরে। রুশা, অরন্যকে কল করে সব বলে।
অরন্য, রুশাকে হসপিটালে যেতে দেয় না। রুশা কে অনেকটা জোর করে ঘরবন্দী করে রাখে। কেননা অরন্য জানতে পেরেছে মিতু ভাবির বাচ্চাটা মারা গেছে আর ভবিষ্যতে সন্তান জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা তিনি হারিয়েছেন! আর এই সবের জন্য ওনারা রুশাকে দায়ী করছেন।
সপ্তাহ খানেক পর মিতু ভাবি বাসায় এসেছে শুনে রুশা ওনাদের বাসায় গিয়েছিল। কিন্তু মিতু ভাবি ওকে দেখে মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। মায়া রুশাকে দেখে কান্না করছিল রুশা মার কাছে যাব, রুশা মার কাছে যাব বলে।
রুশা ঘুমাতে, খেতে পারে না, ওর কানে খালি মায়ার কান্না বেজে ওঠে।
ভোরের দিকে রুশার একটু চোখ লেগে আসে। কিন্তু ঘুমের মধ্যেই রুশার মনে হয় ছোট্ট হাতে কেউ দরজায় নক করছে। ঘুম ঘুম চোখে রুশা দরজা খুলে দেখে মায়া দাঁড়িয়ে আছে চোখ ভরা পানি নিয়ে।
মায়া, মা আমার! মায়াকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে খেতে কাঁদতে থাকে।
মায়া রুশাকে সবটুকু শক্তি দিয়ে জড়িয়ে ধরে বলে, রুশামা আমি তোমাকে ছেড়ে যাব না, আমি তোমার কাছে থাকব।
না মা তুমি কোথাও যাবে না, তুমি রুশা মা'র কাছে থাকবে, মামনি তোমাকে কোথাও যেতে দিবে না সোনা।
মায়া চলে যাচ্ছে! ওকে জোর করে কোলে তুলে নিয়ে চলে যাচ্ছে আর মায়া হাত, পা ছড়িয়ে চিতকার করছে, আমি রুশা মা'র কাছে যাব, রুশা মা'র কাছে যাব!
রুশা জ্ঞান হারিয়ে দরজায় পরে থাকে।
অরন্যর মেয়েটির নাম মায়া! তিন বছর বয়স। তার কলকাকলীতে ঘরটা মুখরিত থাকে। অরন্যর বউ মৌমিতার মাঝে মাঝেই বিরক্ত লাগে। অভিযোগ করে, আল্লাহ মেয়ে না দিয়ে একটা ছেলে দিল না কেনো?
অরন্য প্রতি বুধবার এই মানসিক হাসপাতালে আসে। সবাই ওকে চিনে শুধু একজন চেনে না, রুশা!

লেখক: শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব গিজেন, জার্মানি